হিজরি সপ্তম বছরের মহররম মাসে সংঘটিত খাইবার যুদ্ধ ছিল ইসলামের ইতিহাসে এক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এটি নবীজি ও সাহাবিদের অন্যান্য যুদ্ধের মতো শুধুই একটি যুদ্ধ ছিল না; বরং এর মাধ্যমেই মদিনা রাষ্ট্র রাজনৈতিক, সামরিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এ যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর বিজয়ের ফলে ইহুদিদের ষড়যন্ত্র ভেঙে যায় এবং তারা কার্যত মদিনা থেকে চিরতরে বিতাড়িত হয়। নবীজি ও সাহাবিরা মক্কা থকে মদিনায় হিজরত করার পর শুরু থেকেই ইহুদি গোত্রগুলোর সঙ্গে মুসলমানদের সম্পর্ক অশান্ত হয়ে ওঠে। প্রথমদিকে বনি কাইনুকা, বনি নাজির ও বনি কুরায়জা—এই তিন প্রধান ইহুদি গোত্রের সঙ্গে মুসলমানদের চুক্তি হয়েছিল, কিন্তু তারা একে একে চুক্তি ভঙ্গ করে মুসলমানদের শত্রুতে পরিণত হয়। এর মধ্যে বনি নাজির ও বনি কুরায়জা সরাসরি বিশ্বাসঘাতকতা করে এবং বিভিন্ন যুদ্ধে মুশরিকদের সহযোগিতা করে। খন্দকের যুদ্ধের সময় তাদের ষড়যন্ত্র ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ।
এ বিশ্বাসঘাতকতার কারণে বনি নাজির ও বনি কুরায়জা মদিনা থেকে বিতাড়িত হয় এবং তাদের অনেকেই উত্তর আরবের সমৃদ্ধ এলাকা খাইবারে গিয়ে বসতি স্থাপন করে। খাইবার ছিল কৃষি ও সম্পদের দিক থেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ। আর সেখানকার দুর্গগুলো ছিল শক্তিশালী প্রতিরক্ষায় সুরক্ষিত। এখানে গিয়ে ইহুদিরা মুসলিম সমাজের বিরুদ্ধে নতুন ষড়যন্ত্র আঁটতে শুরু করে। তারা কুরাইশদের সঙ্গে আঁতাত করে মুসলমানদের ধ্বংস করার পরিকল্পনা করছিল। ফলে তাদের মোকাবিলা করা ছিল সময়ের দাবি। সপ্তম হিজরির মুহররম মাসে নবীজি প্রায় ১ হাজার ৬০০ সাহাবির এক বাহিনী সঙ্গে নিয়ে খাইবারের উদ্দেশে যাত্রা করেন। খাইবারে পৌঁছে মুসলমানরা একে একে দুর্গগুলো ঘিরে ফেলে। ইহুদিরা প্রথমে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলে, কারণ তাদের দুর্গগুলো খাদ্য ও অস্ত্রশস্ত্রে ভরপুর ছিল। মুসলমানরা দীর্ঘদিন অবরোধ চালান। সবচেয়ে কঠিন ছিল কামুস দুর্গ জয়। নবীজি যুদ্ধের পতাকা আলি ইবনে আবি তালিব (রা.)-এর হাতে তুলে দেন এবং তিনি অসাধারণ বীরত্ব দেখিয়ে দুর্গটি দখল করেন। অবশেষে ধারাবাহিকভাবে সব দুর্গ মুসলমানদের হাতে চলে আসে। যুদ্ধের শেষদিকে ইহুদিরা বুঝতে পারে, মুসলমানদের পরাজিত করা আর সম্ভব নয়। তখন তারা আত্মসমর্পণের প্রস্তাব দেয়। নবীজি তাদের সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করেননি; বরং শর্তারোপ করেন যে, তারা খাইবারের জমিতে কাজ করবে, তবে উৎপাদনের অর্ধেক অংশ মুসলমানদের দিতে হবে। এ ব্যবস্থার মাধ্যমে তারা কিছুটা জীবনধারণ করতে পারে, কিন্তু ক্ষমতা ও প্রভাব হারায়। যুদ্ধ-পরবর্তী চুক্তি অনুযায়ী, ইহুদিরা মুসলমানদের নিরাপত্তার জন্য আর কোনো হুমকি হতে পারবে না। তবে পরে তারা আবারও কিছু ক্ষেত্রে ষড়যন্ত্রের চেষ্টা করলে খলিফা ওমর (রা.) তাদের আরব উপদ্বীপ থেকে সম্পূর্ণরূপে বিতাড়ন করেন। এভাবেই মদিনা ও এর আশপাশ থেকে ইহুদিদের প্রভাব চিরতরে শেষ হয়। খাইবার যুদ্ধের প্রভাব অনেক গভীর। রাজনৈতিকভাবে মুসলমানরা আরবের অন্যতম শক্তিশালী গোষ্ঠীতে পরিণত হয়। শত্রুরা বুঝতে পারে, ইসলামী রাষ্ট্রকে ধ্বংস করা আর সম্ভব নয়। অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হয় মুসলমানরা। খাইবারের উর্বর জমি ও সম্পদ মুসলমানদের অর্থনৈতিক অবস্থান শক্তিশালী করে। যুদ্ধলব্ধ সম্পদ সাহাবিদের মধ্যে বণ্টন করা হয় এবং এর মাধ্যমে ইসলামী রাষ্ট্র সমৃদ্ধ হয়। যুদ্ধ-পরবর্তী আচরণে ইসলামী ন্যায়নীতি ও সহনশীলতার শিক্ষা প্রকাশ পায়। নবীজি প্রতিশোধ না নিয়ে দয়া প্রদর্শন করেন, যদিও ইহুদিদের বিশ্বাসঘাতকতা সুস্পষ্ট ছিল। সবচেয়ে বড় কথা, এর মাধ্যমে মদিনা থেকে ইহুদিদের বিতাড়ন ঘটে। বনি নাজির ও কুরায়জা যখন মদিনা থেকে চলে গিয়েছিল, তখনো তারা আশপাশে শক্ত ঘাঁটি তৈরি করে মুসলমানদের জন্য হুমকি সৃষ্টি করছিল। খাইবার যুদ্ধ তাদের সেই শক্তি ভেঙে দেয়। পরবর্তীকালে খলিফা ওমর (রা.)-এর সময় আরব উপদ্বীপ থেকে ইহুদিদের চূড়ান্তভাবে সরিয়ে দেওয়া হয়। বলা যায়, খাইবার যুদ্ধ ইসলামের ইতিহাসে মুসলমানদের শুধু সামরিক বিজয়ই দেয়নি, বরং তাদের অর্থনীতি, রাজনীতি ও সামাজিক নিরাপত্তার ভিতকেও দৃঢ় করে। সর্বোপরি, এটি প্রমাণ করেছেÑইসলামী নেতৃত্ব বিশ্বাসঘাতকতা সহ্য করে না, তবে প্রতিশোধের পরিবর্তে ন্যায় ও দয়ার নীতি অনুসরণ করে। খাইবার যুদ্ধের মাধ্যমে মদিনা ও আরব উপদ্বীপ থেকে ইহুদিদের প্রভাব চিরতরে নির্মূল হয় আর ইসলামী রাষ্ট্র পরবর্তী সময়ে আরও শক্তিশালী ভিত্তি লাভ করে।
লেখক: মাদ্রাসা শিক্ষক