খাজা মুইনুদ্দিন চিশতি (রহ.) ছিলেন দক্ষিণ এশিয়ায় ইসলামের আধ্যাত্মিক বিস্তারের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পুরোধা ব্যক্তিত্ব। তিনি ‘গরিব নেওয়াজ’ উপাধিতে সর্বাধিক পরিচিত। চিশতিয়া তরিকার মাধ্যমে তিনি ভারতবর্ষে সুফি আদর্শ ও মানবকল্যাণের শিক্ষা ছড়িয়ে দেন। খাজা মুইনুদ্দিন চিশতি (রহ.) ১১৪১ খ্রিষ্টাব্দে খোরাসানের সিস্তান অঞ্চলের সানজর নগরে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম খাজা গিয়াসউদ্দিন হাসান এবং মাতার নাম বিবি মাহে নুর। পিতা ছিলেন একাধারে ধনী জমিদার ও ধর্মপরায়ণ ব্যক্তি। শৈশবেই তিনি কোরআন ও প্রাথমিক ইসলামী শিক্ষা লাভ করেন। অল্প বয়সেই পিতা-মাতা ইন্তেকাল করলে তিনি সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হন, কিন্তু দুনিয়াবি ভোগবিলাস তার মনকে টানেনি। একদিন বাগানে কৃষিকাজের সময় এক দরবেশের সাক্ষাৎ পেয়ে তার অন্তরে আধ্যাত্মিক চেতনার স্ফুরণ ঘটে এবং দুনিয়াবি সব সম্পদ বিক্রি করে আল্লাহর পথে নিজেকে উৎসর্গ করেন।
খাজা মুইনুদ্দিন চিশতি (রহ.) জ্ঞান ও আধ্যাত্মিকতার খোঁজে বহু শহর ভ্রমণ করেন। তিনি বুখারা ও সমরকন্দে প্রসিদ্ধ আলেমদের কাছে কোরআন-হাদিসের ইলম অর্জন করেন। পরে ইরানের চিশত নামক স্থানে গিয়ে খাজা উসমান হারুনি (রহ.)-এর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেন এবং চিশতিয়া তরিকার মুরিদ হন। ২০ বছর তিনি তার পীরের সোহবতে থেকে ত্যাগ, সাধনা ও সেবার কঠিন পরীক্ষা উত্তীর্ণ হন। তারপর আধ্যাত্মিক ইশারা পেয়ে খাজা মুইনুদ্দিন চিশতি (রহ.) ভারতবর্ষে আগমন করেন। প্রথমে লাহোর, পরে দিল্লি এবং অবশেষে আজমিরকে তার কেন্দ্র হিসেবে বেছে নেন। সে সময় আজমির ছিল রাজপুত শাসক পৃথ্বীরাজ চৌহানের অধীনে। তিনি কোনো রাজনৈতিক সংঘাতে জড়াননি, বরং দাওয়াত ও মানবসেবার মাধ্যমে মানুষের হৃদয় জয় করেন। হিন্দু, মুসলিম, শিখ—সব ধর্মাবলম্বীর মানুষের কাছে তিনি সমানভাবে শ্রদ্ধেয় হয়ে ওঠেন।
খাজা মুইনুদ্দিন চিশতি (রহ.)-এর দাওয়াতের মূল ভিত্তি ছিল প্রেম, সহমর্মিতা ও আত্মত্যাগ। তিনি দরিদ্র, এতিম, রোগী ও পথহারা মানুষকে সেবা দিতেন। তার খানকায় আশ্রয় পাওয়া যেত সবার জন্য, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে। তিনি বলতেন, ‘খোদার প্রেমে এমন হও, যাতে তোমার হৃদয়ে কারও জন্য কোনো ঘৃণা না থাকে।’ তার শিক্ষার মূল ছিল—আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা ও তাওয়াক্কুল, মানুষের সেবা করাকে ইবাদত মনে করা, অহংকার-হিংসা ও লোভ থেকে মুক্ত থাকা। খাজা মুইনুদ্দিন চিশতি (রহ.)-এর অসংখ্য মুরিদ ও খলিফা ছিলেন, যারা ভারতবর্ষের নানা স্থানে চিশতিয়া তরিকার আলো ছড়িয়ে দেন। তাদের মধ্যে খাজা কুতুবুদ্দিন বখতিয়ার কাকি, বাবা ফরিদ, নিজামউদ্দিন আউলিয়া প্রমুখ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তার শিক্ষার প্রভাবে ভারতীয় সুফিবাদ মানবিকতা, ভ্রাতৃত্ব ও সহাবস্থানের এক মডেল হয়ে ওঠে।
১২৩৬ খ্রিষ্টাব্দের ৬ রজব তিনি ইন্তেকাল করেন। তার মাজার আজমিরে অবস্থিত, যা আজও কোটি মানুষের জন্য আধ্যাত্মিক প্রেরণার কেন্দ্র। প্রতি বছর তার ওরস শরিফে বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে ভক্তরা সমবেত হন। খাজা মুইনুদ্দিন চিশতি (রহ.)-এর জীবন ও শিক্ষা শুধু মুসলমানদের জন্য নয়, সমগ্র মানবজাতির জন্য এক চিরন্তন বার্তা, যে বার্তা প্রেম, শান্তি ও সেবার। তার ত্যাগ ও আদর্শ আজও মানুষকে মানবতার পথে আহ্বান জানায়।