খায়রুল হকের শুনানি ঘিরে যা কিছু ঘটেছিল এজলাসকক্ষে

1 month ago 6

জুলাই আন্দোলনের সময় যাত্রাবাড়ীতে আবদুল কাইয়ুম হত্যা মামলা বাতিল ও জামিন চেয়ে সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের করা আবেদনের শুনানি ঘিরে আবেদনকারীপক্ষ ও রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের মধ্যে হট্টগোল, কথা কাটাকাটি ও ধাক্কাধাক্কির ঘটনা ঘটে।

গতকাল সোমবার (১১ আগস্ট) হাইকোর্টের বিচারপতি জাকির হোসেন ও বিচারপতি কে এম রাশেদুজ্জামান রাজা সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চে এ ঘটনা ঘটে।

ওইদিন আবেদনটির শুনানি শুরু হওয়ার কথা ছিল সকালে। কিন্তু সেটি গড়ায় বিকেলে।

বিকেল ৩টায় শুনানি শুরু হলে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল রাসেল আহমেদ আদালতকে বলেন, অ্যাটর্নি জেনারেল এক সপ্তাহ সময় নিতে বলেছেন। আগামী সপ্তাহে দিন ঠিক করেন, এক সপ্তাহ পর তিনি এটির ওপর শুনানি করবেন।

এসময় আবেদনকারীপক্ষের আইনজীবী মোহাম্মদ মোহসীন রশিদ ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেলকে বলেন, আপনি আদালতকে এভাবে নির্দেশনা দিতে পারেন না।

এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে আবেদনকারীপক্ষের আইনজীবী ও রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের মধ্যে হট্টগোল ও হইচই শুরু হয়ে যায়। কিছুটা ধাক্কাধাক্কির ঘটনাও ঘটে। এসময় মোহসীন রশিদের দিকে তেড়ে আসতে চাইলে রাষ্ট্রপক্ষের কয়েকজন তাদের থামাতে চেষ্টা করেন।

আদালত তখন বারবার উভয়পক্ষের আইনজীবীদের নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেন। একপর্যায়ে আদালত পরবর্তী শুনানির জন্য আগামী রোববার (১৭ আগস্ট) দিন ধার্য করেন।

ধাক্কাধাক্কির ঘটনায় বিল্লাল হোসেন নামে একজন আইনজীবী আহন হয়েছেন বলে দাবি করেন আবেদনকারী আইনজীবীরা। এছাড়া একজন নারী আইনজীবীসহ অন্যদের মধ্যে ধাক্কাধাক্কির ঘটনা ঘটে।

ওইদিন এ বি এম খায়রুল হকের পক্ষে শুনানি করতে আদালতে উপস্থিত ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এম কে রহমান, সাবেক বিচারপতি মনসুরুল হক চৌধুরী, সিনিয়র অ্যাডভোকেট কামরুল হক সিদ্দিকী, অ্যাডভোকেট জেড আই খান পান্না, অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ, অ্যাডভোকেট শেখ আওসাফুর রহমান বুলু, অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ মোহসীন রশিদ, অ্যাডভোকেট মোতাহার হোসেন সাজু, অ্যাডভোকেট সৈয়দ মামুন মাহবুব, অ্যাডভোকেট এবিএম সিদ্দিকুর রহমানসহ আওয়ামীপন্থি আইনজীবীরা।

এজলাসকক্ষে আগে থেকে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা উপস্থিত ছিলেন। অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল রাসেল আহমেদ, সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল উজ্জল হোসেন, সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল জসিম উদ্দিন, সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল শাফওয়ান করিম, সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল এমরান খান রবিন ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল ইব্রাহিম খলিল।

আরও পড়ুন

ওইদিন শুরুতেই আবেদনকারী আইনজীবীরা আদালতকে বলেন, আমরা বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হককে চিনি না। তার জন্য এখানে আসিনি। আমরা এখানে এসেছি জুডিশিয়ারির মতো একটি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে।

তখন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা বলছিলেন, সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এসকে) সিনহাকে যখন দেশছাড়া করা হলো তখন আপনারা কোথায় ছিলেন? আজ খায়রুল হকের মতো গণতন্ত্র ধ্বংসকারী কুলাঙ্গারের জামিন চাইতে এসেছেন। ওনি বাংলাদেশের না, পুরো পৃথিবীর ইতিহাসে একজন কুলাঙ্গার ও বিতর্কিত বিচারক ছিলেন।

ওইদিন বিকেলে ৩টা ১ মিনিটের দিকে খায়রুল হকের পক্ষের আইনজীবী এম কে রহমান শুনানির জন্য ডায়েসে গিয়ে আদালতকে বলেন, এ বি এম খায়রুল হক দেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি। আমরা দেখেছি, তার পেছনে হাতকড়া পরিয়ে আদালতে তোলা হয়েছে। এটি বিচার বিভাগের জন্য অমর্যাদাকর। বিচার বিভাগ এসময় নীরব ভূমিকা পালন করতে পারে না।

তিনি বলেন, এক বছর আগের একটি মামলায় এ বি এম খায়রুল হককে গ্রেফতার করা হয়েছে। এটি বিএনপির নির্দেশনায় করা হয়েছে।

এসময় রাষ্ট্রপক্ষের ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল রাসেল আহমেদ আদালতকে জানান, রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল শুনানি করবেন। আমরা নট দিস উইক (এ সপ্তাহে নয়) চাই। আগামী সপ্তাহে দিন ঠিক করেন, ওইদিন তিনি শুনানি করবেন।

এসময় আবেদনকারীর পক্ষের আইনজীবী মনসুরুল হক চৌধুরী আদালতকে বলেন, শুনানি করে রুল জারি করা হোক। এরপর রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা শুনানি করবেন।

ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল রাসেল আহমেদ আদালতকে বলেন, রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল এক সপ্তাহ সময় নিতে বলেছেন। তিনি এ মামলায় শুনানি করবেন। এক সপ্তাহ পর এটি শুনানির জন্য রাখেন।

তখন আইনজীবী মোহসীন রশিদ ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেলকে বলেন, আপনি আদালতকে এভাবে নির্দেশনা দিতে পারেন না। এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে খায়রুল হকের আইনজীবী ও রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের মধ্যে হট্টগোল ও হইচই শুরু হয়। কিছুটা ধাক্কাধাক্কির ঘটনাও ঘটে।

পরে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল রাসেল আহমেদ আদালতকে বলেন, মাননীয় আদালত, আমি বলতে চাই- ২০২৪ এর জুলাইয়ে বাংলাদেশে যে সাধারণ মানুষ হত্যা হয়েছে এজন্য খায়রুল হক সাহেব দায়ী। ওনি (বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক) বাংলাদেশের না, পুরো পৃথিবীর ইতিহাসে একজন কুলাঙ্গার ও বিতর্কিত একজন বিচারক ছিলেন। আবেদনকারী আইনজীবীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, যেসব সিনিয়রা (আইনজীবীরা) এখানে সাবমিশন দিয়েছেন তারা তখন কোথায় ছিলেন।

এ পযার্য়ে সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল উজ্জল হোসেন আদালতকে বলেন, আমার নামে আটটি মামলা দিয়েছে, আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। আমি কোনো অপরাধ করিনি। তারা কেউ তো তখন কোনো কথা বলেননি। এই খায়রুল হক জুডিশিয়ারি পুরোপুরি ধ্বংস করেছে। তখন ওনারা কোথায় ছিলেন?

জানতে চাইলে আইনজীবী এম কে রহমান জাগো নিউজকে বলেন, আমরা এ বি এম খায়রুল হকের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা বাতিল ও তার জামিন চেয়ে গত ৭ আগস্ট আবেদন করেছি। ১০ আগস্ট আবেদনটি শুনানির জন্য উপস্থাপন করেছিলাম। ওইদিন রাষ্ট্রপক্ষের ‘নট টু ডে’ আর্জি গ্রহণ করে শুনানির জন্য ১১ আগস্ট সকালে সময় ধার্য করা হয়।

তিনি বলেন, নির্ধারিত দিনে (সোমবার) আবেদনটি শুনানির জন্য উপস্থাপন করা হলে তারা (রাষ্ট্রপক্ষ) দুপুর ২টার সময় শুনানির জন্য আবেদন জানান। আমরা ২টায় শুনানি করতে চাইলে বলা হয় অ্যাটর্নি জেনারেল শুনানি করবেন। শুনানি শুরু হবে বিকেল ৩টায়। কিন্তু অ্যাটর্নি জেনারেল আসেননি। পরে এজলাসকক্ষে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেলের আচরণে হট্টগোল সৃষ্টি হয়।

এ বি এম খায়রুল হক ২০১০ সালের ১ অক্টোবর থেকে ২০১১ সালের ১৭ মে পর্যন্ত প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার নেতৃত্বাধীন আপিল বেঞ্চ ২০১১ সালের ১০ মে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে রায় দিলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা অবৈধ হয়ে যায়।

খায়রুল হক অবসরে যাওয়ার পর ২০১৩ সালের ২৩ জুলাই তাকে তিন বছরের জন্য আইন কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। মেয়াদ শেষেও তাকে কয়েক দফা পুনর্নিয়োগ দেওয়া হয়।

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে ১৩ আগস্ট আইন কমিশন থেকে পদত্যাগ করেন খায়রুল হক। এরপর তার বিরুদ্ধে কয়েকটি মামলা হয়।

এর ৯ মাসের মাথায় গত ২৪ জুলাই রাজধানীর ধানমন্ডির বাসা থেকে এ বি এম খায়রুল হককে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। ওইদিনই তাকে যাত্রাবাড়ীতে যুবদল কর্মী আবদুল কাইয়ুম আহাদ হত্যা মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়।

এফএইচ/এমকেআর/এমএস

Read Entire Article