আদালতে মামলা চলমান থাকলেও খেলাপি ঋণ আদায়ে গ্রহীতার বাড়ির সামনে ব্যানার টানিয়ে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছেন এক্সিম ব্যাংক কর্মকর্তারা। শুধু অবস্থান কর্মসূচিতেই সীমাবদ্ধ না থেকে ওই ব্যক্তিকে সামাজিকভাবে বয়কট করতে পুরো এলাকায় মাইকিং করে প্রচারণা চালিয়েছেন তারা। মঙ্গলবার (৩ ডিসেম্বর) বিকেলে নগরীর মজুমদারি এলাকায় এ ঘটনা ঘটেছে।
এনিয়ে অনেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকে বিরূপ মন্তব্য করেছেন। আইনজীবীরাও বলছেন, বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে বেআইনি। ঋণ গ্রহীতার বাড়িতে গিয়ে তাকে সামাজিকভাবে হেয় করা অর্থ ঋণ আদালত আইনে এরকম কোনো বিধান নেই বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা।
ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, সিলেট নগরীর মজুমদারি এলাকার ১৩১ মজুমদার বাড়ির বাসিন্দা মকসুদ আহমদ চৌধুরী ২০০৯ সালে তার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স মকসুদ আহমদ চৌধুরী নামে এক্সিম ব্যাংকের জিন্দাবাজার শাখা থেকে ৭ কোটি টাকা ঋণ নেন। পরে ঋণের টাকা কয়েক দফায় ফেরত দিয়েছেন। আবার আরও ঋণও নিয়েছেন। সব মিলিয়ে তিনি ব্যাংক থেকে ১১ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন। কিন্তু সুদসহ বর্তমানে ঋণের পরিমাণ ১৯ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।
এক্সিম ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ২০২৩ সাল পর্যন্ত মকসুদ আহমদ ব্যাংকে ঋণের টাকা জমা দিয়েছেন। কিন্তু ঋণের পরিমাণ বড় হওয়ায় ব্যাংকের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হয়। পরে ২০২৩ সালে ব্যাংকের কাছে দায়বদ্ধ জমি বিক্রি করে দুই কোটি টাকা ফেরত নেয় ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। কিন্তু ঋণের সমপরিমাণ জমির দাম না হওয়ায় ২০২৩ সালের ৬ জুন ব্যাংক কর্তৃপক্ষ আদালতে তার বিরুদ্ধে দায়ের করে। সেই মামলা এখনও চলমান।
এ অবস্থায় মঙ্গলবার (৩ ডিসেম্বর) বিকেলে খেলাপি ঋণ আদায়ে এক্সিম ব্যাংকের সিলেটের কয়েকটি শাখার ম্যানেজার ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা মকসুদ আহমদ চৌধুরীর বাসার সামনে গিয়ে ব্যানার টানিয়ে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন। এক পর্যায়ে তারা পুরো এলাকায় ঘুরে মকসুদ আহমদকে ঋণ খেলাপির কারণে সামাজিকভাবে বয়কট করার আহ্বান জানান।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে ব্যাংক কর্মকর্তারা বলেন, মকসুদ আহমদ চৌধুরী তার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নামে এক্সিম ব্যাংক সিলেটের জিন্দাবাজার শাখা থেকে বিনিয়োগের নামে ঋণ নেন। বর্তমানে ১৯ কোটি ঋণ নেন। বিলাসী জীবনযাপন করা মকসুদ আহমদ গত ১৬ বছরে একটি টাকাও ফেরত দেননি। ঋণের টাকা পরিশোধ না করে টালবাহানা করে ১৬ বছর কাটিয়ে দেন। বিগত বছরগুলোতে তাকে নোটিশের পর নোটিশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। ব্যাংকের লোকজন প্রতিনিয়ত তার বাসায় আসলেও কোনো লাভ হয়নি। তাই বাধ্য হয়ে গ্রাহকের বাসার সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত নেন তারা।
অবস্থান কর্মসূচির ব্যানার সামনে নিয়ে আরেক ব্যাংক কর্মকর্তারা বলেন, ব্যাংকের নিজস্ব কোনো টাকা নেই, জনগণের টাকা থেকে ব্যবসা বাণিজ্য করার জন্য ঋণ দেওয়া হয়। কিন্তু ঋণ গ্রহীতা মকসুদ আহমদ চৌধুরী আয়েশি জীবনযাপন করার পরও ব্যাংকের টাকা ফেরত দিচ্ছেন না। যে কারণে আমরা গ্রাহকদের টাকা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এজন্য ঋণ ফেরত দিতে সচেতন নাগরিকদের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
এসময় মকসুদ চৌধুরীর ভাগনি সম্পর্কে এক নারী বলেন, ঋণের বিষয়টি তিনি জানেন। তার মামা অল্প অল্প করে দিয়ে যাচ্ছেন। তারাও (ব্যাংকের) কাছে সময় চেয়েছেন। তারা সমাধানের সময় দিয়েও বাসার সামনে এনে অবস্থান করছেন। এলাকায় একটা মানসম্মান আছে। এটা ঠিক নয়।
মকসুদ আহমদ চৌধুরী পানি উন্নয়ন বোর্ডের একজন প্রতিষ্ঠিত ঠিকাদার। এ ঘটনার পর তার বক্তব্য নিতে একাধিকবার মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি। এমনকি মজুমদারি এলাকায় তার বাসায় গিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে এক্সিম ব্যাংক জিন্দাবাজার শাখার ব্যবস্থাপক মাসুম ইয়াসিন জাগো নিউজকে বলেন, হেড অফিসের অনুমতি ও নির্দেশনার ভিত্তিতে ঋণ গ্রহীতার বাড়িতে গিয়ে এ কর্মসূচি পালন করা হয়েছে। এটা দেশের ইতিহাসে প্রথম কোনো ঘটনা না। দেশের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন ব্যাংক ঋণ আদায়ে এরকম কর্মসূচি পালন করেছে।
আদালতে মামলা চলমান অবস্থায় এরকম কর্মকাণ্ড কতটুকু যৌক্তিক প্রশ্নে তিনি বলেন, মামলা একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। মামলা দিলেই টাকা আদায় করা যায় না। মামলা মামলার মতো চলছে। আমরা টাকা আদায় করতে এ উদ্যোগ নিয়েছি।
তিনি আরও বলেন, ২০০৯ সালে তিনি এক বছর মেয়াদে প্রায় ৭ কোটি টাকা সিসি ঋণ নিয়েছেন। এরপরে তিনি কয়েক দফায় টাকা দিয়েছেন। আরও ঋণও নিয়েছেন। তিনি প্রায় ১১ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন। গত বছর ব্যাংকের কাছে দায়বদ্ধ জমি বিক্রি করে ২ কোটি টাকা আদায় করা হয়েছে। কিন্তু তার জমির দামের তুলনায় ঋণের পরিমাণ আরও অনেক বেশি। তাই টাকা উদ্ধারে এ পন্থা অবলম্বন করা হয়েছে।
এ বিষয়ে অ্যাডভোকেট আশফাকুজ্জামান চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, এমন অপেশাদার কর্মকাণ্ড অর্থঋণ আদালত আইনসহ প্রচলিত কোনো আইন সমর্থন করে না। কেউ আদৌ ঋণ খেলাপী কী না, তা মোকদ্দমা দায়েরের পর তা আদালত সাক্ষ্য প্রমাণ ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত দেবেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সিলেটের একজন সিনিয়র আইনজীবী জাগো নিউজকে বলেন, আদালতে মামলা চলমান অবস্থায় কোনোভাবে এমন কর্মকাণ্ড করা যায় না। আদালতের রায় হলে তাকে খেলাপি ঋণ গ্রহীতা হিসেবে প্রমাণিত করা যায়। কিন্তু তারা বাড়িতে গিয়ে এমন কর্মকাণ্ড কোনো আইনে নেই। কাজটি সম্পূর্ণ বেআইনি।
আহমেদ জামিল/আরএইচ/জেআইএম