গণকবরস্থানের টাকাও আত্মসাৎ!
লক্ষ্মীপুরের রামগতিতে গণকবরস্থান নির্মাণ না করে টাকা উত্তোলন করে তা আত্মসাৎ করার অভিযোগ উঠেছে প্রশাসন ও প্যানেল চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে।
জানা গেছে, ‘আমার গ্রাম আমার শহর’ প্রকল্পের আওতায় উপজেলার চরবাদাম ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের পূর্ব চরসীতা গ্রামকে পাইলট গ্রাম হিসেবে গ্রহণ করে বিভিন্ন উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়িত হচ্ছে। সে মোতাবেক সেখানে সিডিএসপি কলোনি সংলগ্ন সরকারের ২৪ একর খাস জমির ওপর একটি খেলার মাঠ নির্মাণ ও স্থানীয় সরকারের উন্নয়ন সহায়তা তহবিল ২০২৩-২৪ অর্থবছরে গণকবরস্থান নির্মাণের জন্য ৭ লাখ ৯২ হাজার টাকার অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়।
২০২৩ সালে উন্নয়ন সহায়তা তহবিল থেকে অতিদরিদ্র কর্মসৃজন প্রকল্পের আওতায় গণকবরস্থানের অবকাঠামো নির্মাণের জন্য প্রকল্প নেওয়া হয়। ইউএনও, ইউপি চেয়ারম্যান, মেম্বার ও গণ্যমান্যরা সরেজমিনে প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করলেও অদৃশ্য শক্তির চাপে চরবাদাম ইউনিয়নের পূর্ব চরসীতা গ্রামে গণকবরস্থান নির্মাণ থেকে সরে আসেন তারা। সরকারের ওই জায়গায় গণকবরস্থান না করে পাশের খাল পাড়ে পরিত্যক্ত জায়গায় নির্মাণের প্রস্তাবনা দেন সংশ্লিষ্ট দপ্তর।
পরে সেখান থেকেও সরে এসে চরবাদাম ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের দিনামাঝির খেয়া নামক ভুলুয়া নদীর পাড়ে গণকবরস্থানের একটি সাইনবোর্ড লাগিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু শর্ত ছিল এটি ঘনবসতি বা আশ্রয়ণ প্রকল্পকেন্দ্রিক করার কথা। তা না করে একেবারে নদীর পাড়ে প্রকল্পটি গ্রহণ করে। তাও গণকবরস্থানে যাওয়ার কোনো রাস্তা নেই। এপাড়ে নদী ওপাড়ে ধুধু ভূমি। মাঝখানে গণকবরস্থানের জায়গা।
অভিযোগ উঠেছে, মাটি ভরাট করে ৭ লাখ ৯২ হাজার টাকা লুটে নেন প্রকল্পের সভাপতি, প্যানেল চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্টরা। শুধু একটি সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে প্রকল্পের কাজ শেষ দেখান ২০২৩ সালেই।
বিষয়টি নিয়ে বক্তব্য জানতে চাইলে নড়েচড়ে বসেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সৈয়দ আমজাদ হোসেন। তিনি উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও), স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ও মেম্বারকে আবার সরেজমিনে গিয়ে মাটি ভরাট করার নির্দেশনা দেন। গত বছরের গণকবর নির্মাণ প্রকল্পটি কাগজে-কলমে বাস্তবায়ন দেখিয়ে সমুদয় টাকা উত্তোলন করে এখন আবারও কাজ করার নির্দেশনায় বিব্রত হয়ে ওঠেন পিআই-চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্টরা।
তবে এ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সময়ে চরবাদাম ইউপি চেয়ারম্যান অসুস্থ থাকায় প্যানেল চেয়ারম্যান তারহীদ রাব্বানী তুহিন নয়-ছয় দেখিয়ে সম্পূর্ণ টাকা আত্মসাৎ করেছেন বলে একটি সূত্র জানিয়েছেন। সূত্র জানান, তুহিন আওয়ামী লীগ নেতা হওয়ায় তার দাপটে তটস্থ ছিল গোটা ইউনিয়নটি। ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে প্রশাসনকে ম্যানেজ করে তুহিন কবরস্থান নির্মাণের টাকা মেরে খেয়েছেন।
বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় উঠলে এ প্রকল্পের সম্পূর্ণ দায়ভার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) ওপর ন্যস্ত করে চরবাদাম ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান তারহীদ রাব্বানী তুহিন বলেন, বিষয়টি নিয়ে আমি কথা বলতে পারব না। ইউএনও স্যার ভালো বলতে পারবেন। এটা সম্পূর্ণ ইউএনও সার দেখভাল করেছেন।
স্থানীয় ফয়সাল আহমেদ জানান, নদীর ওই পাড়ে কোনো বাড়িঘর নেই। রাস্তাঘাটও নেই। নদীর ওপর ব্রিজও নেই। কিন্তু হঠাৎ দেখি গণকবরস্থানের একটি সাইনবোর্ড। মানুষ মারা গেলে কবর দিতে ওই পাড়ে যাওয়ার কোনো রাস্তা নেই। সরকারি টাকা লুটপাট করে খাওয়ার আয়োজন ছাড়া আর কিছুই নয়।
স্থানীয়রা জানান, গণকবরস্থানটি খালপাড়ের পরিত্যক্ত যায়গায় নির্মাণের প্রস্তাবনা নিয়ে স্থানীয়দের মাঝে শুরু থেকেই সন্দেহ তৈরি হয়। ঘনবসতিপূর্ণ জায়গায় গণকবর নির্মাণ না করে পরিত্যক্ত জায়গায় খালপাড়ে অরক্ষিত স্থানে নির্মাণের প্রস্তাবনায় সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভও দেখা দেয়। হঠাৎ গণকবরের ওই সাইনবোর্ডটি পাল্টিয়ে আবার উপজেলার চরবাদাম ইউনিয়নে ৭ নম্বর ওয়ার্ডের দিনামাঝির খেয়া নামক স্থানে লাগানো হয়েছে।
জানা গেছে, ৩৩ দিনের প্রকল্পে দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে ৬০ জন শ্রমিক ৪০০ টাকা হাজিরা ভিত্তিতে কাজ করে শ্রমিকদের প্রত্যেকের মোবাইল অ্যাকাউন্টে টাকা নেওয়ার কথা থাকলেও বাস্তবিক অর্থে কোনো শ্রমিক ছিল না। শুধু একটি ভেকু মেশিন দিয়ে মাত্র ৩-৪ ঘণ্টা মাটি ফেলেই কাজ শেষ দেখানো হয়। কবরস্থানের মাঝখানে একটি পুকুর খনন করে সেখানে মাছ চাষ করা হচ্ছে।
স্থানীয় ৭ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আব্দুস সহিদ বলেন,এই গণকবরস্থানটি কয়েকবার স্থান পরিবর্তন করে সর্বশেষ এখানে দেওয়া হয়েছে। আমরা সাইনবোর্ড লাগিয়েছি। ইউএনও, এসিল্যান্ডসহ সবাই এসে দেখে গেছে। কত টাকার মাটি ফেলেছেন এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এগুলো ইউএনও বলতে পারবেন। আমরা জানি না।
এ বিষয়ে জানতে প্রকল্পের সভাপতি রোকসানা বেগমের মুঠোফোনে একাধিকবার কল দিলেও সেটি রিসিভ হয়নি।
প্রকল্পের সেক্রেটারি মাহফুজুর রহমান বলেন, প্রথমে সিডিএসপি কলোনিতে স্থান নির্ধারণ করা হয়। পরে সেটা পরিবর্তন করে খালপাড়ে নেওয়া হয়। আবার ইউএনও স্যারের নির্দেশে ভুলুয়া নদীর পাড়ে নেওয়া হয়। সেখানে সাইনবোর্ডও রয়েছে।
চরবাদাম ইউপি চেয়ারম্যান শাখাওয়াত হোসেন জসিম বলেন, গত বছর এ প্রকল্পের কাজ শেষ করে টাকা উত্তোলন করা হয়। তখন আমি হাসপাতালে ছিলাম। এখন হঠাৎ আবার কাজ করার জন্য বলা হচ্ছে।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) জহিরুল ইসলাম বলেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সময় আমি হজে ছিলাম। আমি এলাকায় থাকলে এমন ঘটনা ঘটত না। বিষয়টি নিয়ে সংবাদ প্রকাশ না করতে এ প্রতিবেদককে বিশেষ অনুরোধ করেন তিনি।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সৈয়দ আমজাদ হোসেন জানান, কোথায় গণকবর? আমাদের এ অঞ্চলে তো কোনো গণকবর নেই। কে সাইনবোর্ড লাগিয়েছে? আপনি একটা ছবি তুলে আমাকে পাঠান। পরে আবার এ প্রতিবেদককে ফোন করে বলেন, আসলে বিষয়টি আমি বুঝতে পারিনি। গণকবরস্থানের ওই জায়গাটি দেখে আমারও খটকা লেগেছে। যাতায়াত ব্যবস্থা নেই। কাজও হয়নি। প্রয়োজনে আমি আবারও লোক পাঠিয়ে কাজ সম্পূর্ণ করে দেব।