গৃহপরিচারিকা থেকে চা দোকানি—জুয়ায় নিঃস্ব সবাই

1 day ago 6

‌‘চা বিক্রির ফাঁকে ফাঁকে অনলাইনে জুয়া খেলে করি। প্রথমে কিছু টাকাও পেয়েছি। পরবর্তীতে আমার ওপর লোভ পেয়ে বসে। বেশি টাকা জেতার আশায় আমার দোকানসহ বাড়ির অনেক মূল্যবান সম্পদ নষ্ট করেছি। যখন বুঝতে পারলাম তখন সব শেষ। জুয়া খেলে আমি নিঃস্ব হয়ে গেছি। এ কঠিন নেশা।’

কথাগুলো বলছিলেন যশোরের শার্শা উপজেলার চা দোকানি আনোয়ার হোসেন। শুধু তিনি নন, তার মতো শত শত বিভিন্ন পেশার মানুষ অনলাইন জুয়ায় আসক্ত হয়ে নিঃস্ব হচ্ছেন। উপজেলার বাগআঁচড়া, গোগা, কায়বা, শার্শা, উলাশী, লক্ষণপুর এবং একমাত্র পৌরসভা বেনাপোলে জুয়ার বিস্তার শহর থেকে গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে।

প্রতিদিন হাজারো যুবক অনলাইনে বাজি ধরে নিঃস্ব হয়ে ফিরছেন। এক ক্লিকে লাখ লাখ টাকা উড়ে যাচ্ছে। কলেজছাত্র থেকে ব্যবসায়ী বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ এতে জড়িয়ে পড়ছেন। ফুটপাতের চা দোকানি, সেলুনকর্মী, হকার, বাড়ির নিরাপত্তাপ্রহরী, বিক্রয়কর্মী, ভবঘুরে, বাস-ট্রাক চালক, সিএনজিচালক, নির্মাণশ্রমিক, গৃহপরিচারিকা, রিকশাচালক ও দিনমজুর অনেকেই দিনের একটি নির্দিষ্ট সময় অনলাইনে বাজি ধরায় ব্যস্ত থাকছেন।

এদের মধ্যে অনেকেরই শুরু হয় এক হাজার টাকা বা আরও বেশি টাকা দিয়ে। পরবর্তী পর্যায়ে তা ১০ হাজার কিংবা তারও বেশি পরিমাণ টাকার অংক ছাড়িয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত শেষ হয়ে যায় সম্পদ।

এলাকাবাসীর অভিযোগ, অনলাইনে হারানো টাকা জোগাড় করতে না পেরে অনেক তরুণ চুরি-ছিনতাইয়ের পথে নামছেন। নাভারন, শার্শা, বেনাপোল ও বাগআঁচড়া এলাকায় চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনা বাড়ছে। কিশোররা জোটবদ্ধ হয়ে গ্যাং গঠন করে রাতে চেতনানাশক স্প্রে প্রয়োগ করে সর্বস্ব লুট করছে। এ ধরনের ঘটনায় এলাকাবাসী আতঙ্কে আছেন।

এর ভুক্তভোগী সাতক্ষীরার কলারোয়ার বাসিন্দা মো. আনারুল। তিনি বলেন, ‘বাসে যশোর যাওয়ার পথে কিশোর গ্যাং চেতনানাশক স্প্রে ব্যবহার করে আমার কাছে থাকা সব টাকা ছিনিয়ে নেয়। পরে স্থানীয়রা অচেতন অবস্থায় আমাকে উদ্ধার করে নাভারন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করেন। আমি আগে কখনো এরকম ঘটনার শিকার হইনি।’

বেনাপোলের বাসিন্দা আরাফাত রহমান। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, মোবাইলে জুয়া খেলে টাকা ইনকামের নেশায় কিশোর-তরুণরা নিঃস্ব হয়ে পড়ছে। আর সেই টাকার জোগান দিতে গিয়ে তারা চুরি-ডাকাতির মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। আমরা প্রতিনিয়ত আতঙ্কে আছি। আমাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি।

নিয়মিত অনলাইনে জুয়া খেলতেন আহসান (ছদ্মনাম)। তিনি বলেন, ‘একটি সাইটে জুয়া খেলতাম। প্রথমে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে খেলা শুরু করি। এক রাতে পাঁচ হাজার টাকা থেকে এক লাখ টাকা লাভ হয়। পরদিন ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকায় খেলতে গেলে পুরো টাকা হেরে যাই। পরবর্তী সময়ে দুই লাখের মতো ইনভেস্ট করি। সেখানে খেলতে গিয়েও হেরে যাই। বড় অংকের টাকা হেরে গিয়ে পরে পাঁচ থেকে ১০ হাজার টাকার মধ্যে খেলা শুরু করি আবার। সেখানে অনেক সময় দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ পর্যন্ত লাভ হয়। আবার অনেক সময় পুরো টাকাই হেরে যাই। এটি নেশার মতো। খেলতে শুরু করলে যতক্ষণ টাকা থাকে ততক্ষণ পর্যন্ত খেলতে ইচ্ছা করে। টাকা শেষ হলে আবারও টাকা ইনভেস্ট করে খেলা শুরু করতে ইচ্ছা হয়।’

আরও পড়ুন:
দুধ দিয়ে গোসল করে অনলাইন জুয়া ছাড়লেন যুবক
বন্ধ হচ্ছে হাজারের বেশি মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট
ভয়ংকর স্মার্টফোন, প্রত্যন্ত অঞ্চলেও জুয়ার থাবা
অনলাইন জুয়ার টাকা দিয়ে ডাটা কেনা কি জায়েজ হবে?
অনলাইনে জুয়া: মাস্টার দুই এজেন্ট হাতিয়ে নেন ২০ কোটি টাকা

জুয়া খেলে নিঃস্ব হয়েছেন যুবক আব্দুল্লাহ। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘নেশায় পড়ে লাখ লাখ টাকা হারিয়েছি। ধার করে খেলেছি, এখন দেনার দায়ে এলাকা ছেড়ে পালিয়েছি। কেউ টাকা দিতে চায় না।’

শার্শা বাজারের মুদি দোকানের কর্মচারী আহাদ বলেন, ‘আমি দোকান থেকে রাতে বাড়ি গিয়ে জুয়া খেলা করি। এটা এমন এক নেশা যারা খেলে তারাই বুঝতে পারে। আমার জমানো প্রায় ৭০ হাজার টাকা খুইয়েছি। দোকানের মালিক কাজ থেকে বাদ দিয়েছিল। আর খেলবো না বলে হাতে-পায়ে ধরে আবার কাজে মনোযোগ দিয়েছি।’

বেনাপোলের ইজিবাইক চালক খলিলুর রহমান বলেন, ‘অনলাইন জুয়া খেলা বুঝতাম না। বাড়ির পাশের এক যুবক বলার পর এ খেলায় আসক্ত হই। নিজের গাড়ি সারাদিন চালিয়ে যে টাকা পাই, সেই টাকা অনলাইন জুয়ায় শেষ করি। আমার একটা টাচ মোবাইল ছিল, সেটাও পরে বিক্রি করে দেই। সংসারের জিনিসপত্রও বিক্রি করেছি। পরে পরিবারের লোক নানা বাজে কথা বলার পর জুয়া খেলা বন্ধ করে দিয়েছি।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে নাভারনের এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক জানান, তার ছেলে স্থানীয় উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ালেখা করে। কিন্তু অনলাইন জুয়ার কারণে পড়ালেখায় মনোযোগ নেই। কৌশলে টাকা নিয়ে এটা খেলে। কোনোভাবেই বিরত রাখা যাচ্ছে না। ছেলের ভবিষ্যৎ অনলাইন জুয়া নষ্ট করে দিচ্ছে।

এ বিষয়ে বেনাপোল পোর্ট থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এসআই মানিক কুমার সাহা বলেন, নানা কারণে সর্বস্বান্তরা থানায় আসতে ভয় পান। মোবাইলে জুয়ার বিরুদ্ধে আমরা তৎপর আছি। অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বেনাপোল কলেজের অধ্যক্ষ কামরুজ্জামান শান্তি বলেন, ‘তরুণদের মধ্যে কারও কারও মধ্যে বিনা পরিশ্রমে হুট করে অধিক অর্থ উপার্জনের যে লোভ বা আকাঙ্ক্ষা, এটি তাদের ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সরকারের কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণসহ নৈতিক শিক্ষা এবং পারিবারিক বন্ধন জোরালো না হলে এই অবক্ষয় ঠেকানো সম্ভব হবে না।’

এ বিষয়ে শার্শা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কাজী নাজিব হাসান জানান, অনলাইন জুয়ায় জড়িতদের দ্রুত চিহ্নিত করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য নির্দেশনা দেওয়া আছে। জনগণকে সচেতন করতে সভা-সেমিনার, বিদ্যালয়-মাদারাসায় সচেতনতামূলক কার্যক্রম ও গণমাধ্যমে প্রচারণা চালানো হচ্ছে। আমাদের লক্ষ্য শুধু অপরাধ দমন নয়, বরং মানুষকে বোঝানো যে, অনলাইন জুয়া তাদের পরিবার, শিক্ষা ও ভবিষ্যৎ ধ্বংস করছে।

জেইউডি/এসআর/জেআইএম

Read Entire Article