বাড়ির কোণায় ছিপ তৈরির বাঁশঝাড়। বাড়িতে চুলায় জ্বলছে মিটিমিটি আগুন। আগুনে চিকন বাঁশকে বিভিন্ন কৌশলে সেঁক দেওয়া হচ্ছে। এতে সোজা হচ্ছে আঁকাবাকা বাঁশ। আগুনে পুড়ে বাঁশের রঙেও আসছে ভিন্নতা। একপর্যায়ে তৈরি হচ্ছে ছিপ। এগুলো উঠানে তো বটেই ঘরের ভেতরেও সারি সারি করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে।
এটি ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা উপজেলার মানকোন ইউনিয়নের বাদেমাঝিরা গ্রামের চিত্র। ঘরে ঘরে ছিপ তৈরির এমন দৃশ্য কেবল এই গ্রামটিতেই দেখা যায়। ফলে গ্রামটি ছিপ তৈরির গ্রাম হিসেবেও পরিচিতি পেয়েছে।
গ্রামটিতে ছিপ তৈরির এমন দৃশ্য কয়েক বছরের নয়। বংশপরম্পরায় প্রায় শত বছর ধরে চলছে এই কর্মযজ্ঞ। এতে অনেকের পরিবারে ফিরেছে স্বচ্ছলতা। অনেকে বাড়তি আয়ের আশায় কৃষি কাজের পাশাপাশি ছিপ তৈরিতে মনোযোগ দিয়েছেন। এতে জীবিকা নির্বাহ করা তাদেরও সহজ হয়েছে।
স্থানীয়রা জানান, গ্রামটির গুটিকয়েক লোকজন ছাড়া প্রায় সবাই কৃষিকাজ করেন। অনেকে আবার কাজকর্ম না পেয়ে বেকার। এসব ব্যক্তিরা বাঁশের ছিপ তৈরির কাজে মনোনিবেশ করেছেন। এতে যে টাকা রোজগার হচ্ছে, তাতে তাদের পরিবারের ভরণপোষণ করা যাচ্ছে। এছাড়া বাড়ির নারীরাও মনোযোগ দিয়ে ছিপ চাঁছার (ছাঁটাই) কাজসহ ছিপ তৈরি করছেন। এতে তারাও ঘরে বসে বাড়তি টাকা আয় করতে পারছেন।
বাদেমাঝিরা গ্রামের বাসিন্দা আহম্মেদ আলী জাগো নিউজকে বলেন, ‘এই গ্রামে তৈরি করা ছিপ সারাবছরই বিক্রি হয়। তবে বর্ষাকালে পাইকাররা সবচাইতে বেশি ছিপ কিনে নেন। কারণ তখন নদ-নদী, খাল-বিল ও বিভিন্ন জলাশয় পানিতে ভরে যায়। দেশের বিভিন্ন এলাকায় বন্যা হয়। ফলে ছিপ বেচা-কেনা জমজমাট হয়ে ওঠে।’
ছিপ তৈরির কারিগররা জানান, গ্রামে ছিপ বানানোর উপযোগী বাঁশের চাষ খুবই কম। ফলে ছিপ তৈরির বাঁশ সিলেট ও সুনামগঞ্জ থেকে সংগ্রহ করতে হয়। একেকটি বাঁশ কেনা থেকে শুরু করে একেকটি ছিপ তৈরিতে ২৩ থেকে ৩০ টাকা পর্যন্ত খরচ হয়। এরপর একেকটি ছিপ ২৫ থেকে ৪০ টাকায় বিক্রি হয়। বন্যা ও বৃষ্টির পানি বেশি হলে ছিপের দাম বেড়ে যায়।
ছিপ তৈরির কারিগর আমিনুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘অভাবের সংসার হওয়ায় পড়ালেখা করতে পারিনি। অন্যের জমিতে কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতে হত। গ্রামের অনেকে ছিপ তৈরি করে স্বাবলম্বী হয়েছেন, এটি দেখে নিজেও ছিপ তৈরির কাজ শুরু করি। বর্তমানে আমার কারখানায় নারী-পুরুষসহ ২০ জন কর্মচারী কাজ করছেন। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পাইকাররা এসে ছিপ কিনে নিচ্ছেন। সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতা পেলে আরও উন্নত ও আকর্ষণীয় ছিপ তৈরি করা যেত। এতে এই পেশার সঙ্গে আরও অনেকে জড়িত হতেন। ফলে আরও অনেকের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হত।’
আব্দুল কাদির নামের আরেকজন কারিগর বলেন, ‘গ্রামের নারীরা ছিপ চাঁছার কাজ করেন। অনেক নারী ছিপ তৈরির কাজও করেন। তবে ছিপ তৈরির কাজটি পুরুষরাই বেশি করেন। বাড়ির আঙিনায় চুলার আগুনে চিকন বাঁশ সেঁক (তাপ) দেন। এতে আঁকাবাকা বাঁশগুলো ছিপে পরিণত হয়। এরপর ছিপে রঙবেরঙের নকশা আঁকা হয়। শৌখিন মৎস্য শিকারিদের বিশেষভাবে আকৃষ্ট করে এই নকশা। ফলে ভালো বেচা-কেনা হয়।’
গৃহস্থালি কাজের পাশাপাশি ছিপ চাঁছার কাজ করেন আসমা আক্তার। তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন অর্ধশতাধিক ছিপ চাঁছতে পারি। এতে আমার প্রতিদিন আয় হয় ১৫০ থেকে ২০০ টাকা। এ টাকা সন্তানদের লেখাপড়ায় খরচ করি। আমার মতো গ্রামের অনেক নারী এই কাজ করে টাকা আয় করছেন।’
উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা তারিকুল ইসলাম বলেন, ‘শৌখিন লোকেরা সারা বছর ছিপ দিয়ে মাছ ধরেন। আর বৃষ্টিতে খাল-বিলসহ নদ-নদীর পানি বাড়লে অনেক এলাকায় বন্যা হয়। তখন ছিপ বিক্রির ধুম পড়ে। তখন ছিপের দামও বেড়ে যায়। এই গ্রামের অনেক বাড়ি ছিপের কারখানা হয়ে গেছে। গ্রামের পুরুষরা ছিপ তৈরি করে স্বাবলম্বী হচ্ছেন, নারীরাও বাড়তি টাকা আয় করছেন। অথচ একসময় পুরুষরা অন্যের জমি চাষাবাদ করে কোনোরকমে দিন পাড় করতেন।’
এ বিষয়ে মুক্তাগাছা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘মাছ ধরার জন্য ছিপের যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। সেই চাহিদা পূরণ করতে বাদেমাঝিরা গ্রামের মানুষেরা ছিপ তৈরি করছে। এসব ছিপ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিক্রি হচ্ছে। এর ফলে এই গ্রামের মানুষের ভাগ্যেও পরিবর্তন ঘটছে। তাদের সহযোগিতার বিষয়ে উচ্চপর্যায়ে জানানো হবে।’
- আরও পড়ুন
- ২১ নাকি ২২ ক্যারেট সোনা ভালো, আসল নকল চিনবেন যেভাবে
- যেসব দেশে পরিচ্ছন্নতার জন্য আছে আইন, না মানলে জেল-জরিমানা
কামরুজ্জামান মিন্টু/কেএসকে/জিকেএস