ব্যস্ত নগরীর ভিড় ঠেলে হেঁটে গেলে বিকেলের হালকা আলোয় দোয়েল চত্বরে চোখ পড়ে সাজিয়ে রাখা বেতের তৈরি ঝুড়ি, ডালা, খলুই, কুলা, খাঁচা, আয়না কিংবা ফুলের ঝুড়িতে।
এগুলো দেখতে যেমন আকর্ষণীয়, তেমনি ঘর সাজানোর জন্যেও অনন্য। মাটির হাড়ি-কলসি আর ঘর সাজানোর পণ্যের পাশেই বসেছে দোকানগুলো। মাটির গন্ধের সঙ্গে মিশে যায় বেতের প্রাকৃতিক ঘ্রাণ। ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে দাঁড়িয়েও যেন গ্রামবাংলার টান ফিরিয়ে আনে এই দোকানগুলো।
এখানে টানা ২০ বছরের বেশি সময় ধরে বেতের তৈরি পণ্যের ব্যবসা করছেন আব্দুল গফুর। দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি বললেন, ‘এটা আসলে আমাদের পুরনো ঐতিহ্য। আগে গ্রামে প্রতিটি ঘরেই বেতের মোড়া, ঝুড়ি থাকত। এখন গ্রামে তেমন ব্যবহার হয় না, কিন্তু শহরে যারা সৌখিন, তারা ঘর সাজানোর জন্য এগুলো নেয়। চাহিদা কমলেও আমরা এই ব্যবসা ছাড়তে পারিনি।’
বেত ও পাটের পসরা দিয়ে সাজানো পণ্য। ছবি/মামুনূর রহমান হৃদয়
বেত দিয়ে তৈরি হয় নানা জিনিসপত্র -- মোড়া, চেয়ার, টেবিল, ফুল রাখার ঝুড়ি, নাস্তা রাখার ট্রে, বইয়ের তাক, ঝাড়লণ্ঠন, দেয়ালে ঝোলানোর সাজসজ্জার জিনিস, এমনকি ছোটখাটো বেতের হাতব্যাগও।
দোয়েল চত্বরে দোকান ঘুরলে দেখা যায়, সাধারণ মোড়া ৫০০ টাকা থেকে শুরু। আবার হালকা ডিজাইনের সৌখিন বেতের আয়নার দাম ৮০০-১০০০ টাকার মধ্যে। দাম তুলনামূলক কম বা বেশি হলেও অনেকেই শখ করে কিনে নিচ্ছেন।
বেতের সঙ্গে পাশাপাশি পাওয়া যায় শন, পাট, কাঠ ও বাঁশজাত পণ্যও। শন দিয়ে তৈরি দড়ি বা ঝুলানো শোপিস, পাটের তৈরি হ্যান্ডব্যাগ, ঝুড়ি কিংবা ওয়াল হ্যাঙ্গিং অনেকের পছন্দের তালিকায়। কেউ আবার কিনে নেন কাঠের চিরুনি। দোকানিদের মতে, নানা পণ্যের ভিড়ে বেতের তৈরি জিনিস ভালোই বিক্রি হয়।
রয়েছে কাঠের চিরুনিসহ আরও কারুকাজের পণ্য। ছবি/মামুনূর রহমান হৃদয়
গফুর জানালেন, বেতের জিনিস বানাতে অনেক সময় লাগে। কাঠামো বাঁধা থেকে শুরু করে বুনন সবই হাতের কাজ। কোনো কোনো জিনিস বানাতে দুই-তিন দিন পর্যন্ত সময় লাগে। সচরাচর ঢাকায় বেতের তৈরি জিনিসপত্র গাজীপুর ও ময়মনসিংহ থেকে আসে। বিশেষ করে, গাজীপুরের শ্রীপুরে অবস্থিত বরমী হাট বেতের পণ্যের জন্য একটি প্রাচীন ও গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র।
তিনি বলেন, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা কারিগররা সাপ্তাহিক হাটে সেগুলো বিক্রি করে থাকেন। এছাড়াও যাদের সঙ্গে চুক্তি করা থাকে তারা ঢাকায় নিয়ে আসেন।
জানা যায়, সব ঠিকঠাক চললে একটা বেতের চেয়ার তৈরি করতে দুই-তিন দিন সময় লেগে যায়। তার ওপর এখন কাঁচামালের দাম বেড়েছে। আগে বেত পাওয়া যেত কম দামে, এখন জঙ্গলে কম পাওয়া যায়। আবার বাইরের জেলা থেকে আনতে হয়, ফলে খরচও বাড়ে।
বেতের তৈরি আয়না কিনতে দোকানে আসেন নার্সিং পড়ুয়া শিক্ষার্থী ফারিয়া আক্তার। তিনি বলেন, দোয়েল চত্বরের এখানে মাটির তৈরি কিংবা বেতের পণ্যগুলো খুবই ভালো মানের। আমি একটি বেতের তৈরি আয়না নিয়েছি। যারা গ্রামীণ আবহে ঘর সাজাতে চায় তাদের জন্য এই স্থানের পণ্য 'বেস্ট চয়েস'। প্লাস্টিক বা লোহার চেয়ে বেতের জিনিসে এক ধরনের প্রাকৃতিক আবহ আছে।
অন্যদিকে, গৃহিণী শেফালি আক্তার বলেন, আমি উপহার কেনার জন্যই এখানে আসি। আমার এক বান্ধবীকে গতবার বেতের শোপিস দিয়েছিলাম, সবাই খুব পছন্দ করেছে। দামও বেশি নয়, অথচ জিনিসটা আলাদা ধরনের।
বেত, বাঁশ, পাট সবই মিলবে এক ছাদের তলায়। ছবি/মামুনূর রহমান হৃদয়
বেত শিল্প টিকিয়ে রাখার লড়াই মৃৎশিল্পের মতোই কঠিন। একদিকে কাঁচামালের সংকট, অন্যদিকে দামী সিরামিক, প্লাস্টিক বা লোহার আসবাবের বাজারে প্রতিযোগিতা। তবু দোয়েল চত্বরের দোকানিদের চোখে ভরসা। বিক্রেতারা বলেন, শহরের সৌখিন মানুষের কাছে বেতের জিনিসপত্র সবসময়ই আলাদা মর্যাদা পাবে।
আব্দুল গফুরের কণ্ঠে দৃঢ়তা শোনা গেল, আমরা জানি এই ব্যবসা আগের মতো লাভজনক নয়। কিন্তু এটাই আমাদের পেশা, আমাদের ঐতিহ্য। যতদিন পারব, মাটির সঙ্গে যেমন টিকে আছি, তেমনি বেতের সঙ্গেও থাকব।
দোয়েল চত্বরে সাজানো বেতের ঝুড়ি বা শোপিসগুলো তাই শুধু বাজারের পণ্য নয়, এগুলো একেকটা শিল্পকর্ম। হাতে গড়া এই শিল্প যেন বলতে চায়, আমাদের শেকড় এখনো প্রাকৃতিক বুননে বাঁধা। শহরের কংক্রিটের ভিড়েও সেই শেকড়কে জিইয়ে রাখছে দোয়েল চত্বরে দাঁড়িয়ে থাকা বেত শিল্প।
এএমপি/এমএস