ঘাতক রোগ এইডস প্রতিরোধে আশার আলো
এন্টিরেট্রো ভাইরাল চিকিৎসা দেখিয়েছে, অ্যাকোয়ার্ড ইমিউনো ডেফিসিয়েন্সি সিনড্রোম (এইডস) এখন আর মৃত্যুদণ্ডাদেশ নয়। এন্টিরেট্রো আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে এইচআইভি ভাইরাস বংশবৃদ্ধি করতে এবং সক্রিয় হতে বাধা দেয়। ফলে এইডস এখন দীর্ঘস্থায়ী কিন্তু নিয়ন্ত্রণযোগ্য রোগ। বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা ও ইউএনএআইডিএস-এর হিসেবে অতিউন্নত দেশগুলোতে, যেখানে এ চিকিৎসা পাওয়া যাচ্ছে, সেখানে এ চিকিৎসার প্রবর্তন ও ব্যাপক এইডস ব্যবস্থাপনার পর থেকে এইডস সংক্রান্ত মৃত্যু শতকরা ৭০ শতাংশ কমেছে। গত দশকে এন্টিরেট্রো ভাইরাল এইডস চিকিৎসার ব্যয় অনেক কমেছে। ১৯৯০-এর দশকে বছরে ১০ হাজার ডলার থেকে ১৫ হাজার ডলার করে কমতে কমতে আজ কোনো কোনো জেনেরিক মিশ্রন ৩শ ডলারে নেমে এসেছে। তবে এই মূল্যও কোনো কোনো ক্ষতিগ্রস্ত ও এইডস-এ আক্রান্ত দেশগুলোর সংখ্যাগরিষ্ঠ রোগীদের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে। উদাহরণ হিসেবে মালাবির কথাই ধরা যাক। মালাবিতে শতকরা ১৪ দশমিক ২ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ এইচআইভি সংক্রমিত। অথচ সারা বছরে একজন প্রাপ্তবয়স্ক লোক গড়ে আয় করে ১শ ৭০ ডলার। আশার কথা, বিশ্বের প্রথম এইডস টিকা আবিষ্কার করছে রাশিয়া। তাদের এই দাবি যদি সত্যি হয়, আর এই প্রকল্প সফল হ
এন্টিরেট্রো ভাইরাল চিকিৎসা দেখিয়েছে, অ্যাকোয়ার্ড ইমিউনো ডেফিসিয়েন্সি সিনড্রোম (এইডস) এখন আর মৃত্যুদণ্ডাদেশ নয়। এন্টিরেট্রো আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে এইচআইভি ভাইরাস বংশবৃদ্ধি করতে এবং সক্রিয় হতে বাধা দেয়। ফলে এইডস এখন দীর্ঘস্থায়ী কিন্তু নিয়ন্ত্রণযোগ্য রোগ।
বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা ও ইউএনএআইডিএস-এর হিসেবে অতিউন্নত দেশগুলোতে, যেখানে এ চিকিৎসা পাওয়া যাচ্ছে, সেখানে এ চিকিৎসার প্রবর্তন ও ব্যাপক এইডস ব্যবস্থাপনার পর থেকে এইডস সংক্রান্ত মৃত্যু শতকরা ৭০ শতাংশ কমেছে। গত দশকে এন্টিরেট্রো ভাইরাল এইডস চিকিৎসার ব্যয় অনেক কমেছে। ১৯৯০-এর দশকে বছরে ১০ হাজার ডলার থেকে ১৫ হাজার ডলার করে কমতে কমতে আজ কোনো কোনো জেনেরিক মিশ্রন ৩শ ডলারে নেমে এসেছে।
তবে এই মূল্যও কোনো কোনো ক্ষতিগ্রস্ত ও এইডস-এ আক্রান্ত দেশগুলোর সংখ্যাগরিষ্ঠ রোগীদের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে। উদাহরণ হিসেবে মালাবির কথাই ধরা যাক। মালাবিতে শতকরা ১৪ দশমিক ২ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ এইচআইভি সংক্রমিত। অথচ সারা বছরে একজন প্রাপ্তবয়স্ক লোক গড়ে আয় করে ১শ ৭০ ডলার।
আশার কথা, বিশ্বের প্রথম এইডস টিকা আবিষ্কার করছে রাশিয়া। তাদের এই দাবি যদি সত্যি হয়, আর এই প্রকল্প সফল হয়, তাহলে বিশ্বে এইডসের প্রথম টিকা হবে এটি। রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ব বার্তাসংস্থা রিয়া নভোস্তির বরাত দিয়ে এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে রুশ সংবাদামাধ্যম রাশিয়া টুডে। দেশটির চিকিৎসা ও অনুজীববিজ্ঞান গবেষণাবিষয়ক সরকারি প্রতিষ্ঠান গামালিয়া ন্যাশনাল সেন্টার ইতোমধ্যে টিকা তৈরির কাজ শুরু করে দিয়েছে। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী দুই বছর বা তারও কম সময়ে বাজারে আসার জোর সম্ভাবনা আছে এই টিকার।
গামালিয়া ন্যাশনাল সেন্টারের মহামারিবিদ্যা (এপিডেমিওলজি) বিভাগের প্রধান ভ্লাদিমির গুশচিন এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, সর্বাধুনিক এমআরএনএ প্রযুক্তি অনুসরণ করে প্রস্তুত করা হবে এই টিকা। এমআরএনএ-এর পূর্ণরূপ ম্যাসেঞ্জার রাইবো-নিউক্লিয়িক এসিড। প্রচলিত পদ্ধতিতে টিকা প্রস্তুত করার ক্ষেত্রে মৃত বা বিশেষভাবে প্রক্রিয়াজাত জীবাণু ব্যবহার করা হয়, তবে এমআরএনএ প্রযুক্তিতে এ পদ্ধতি অনুসরণ করা হয় না, বরং ব্যবহার করা হয় এক ধরণের প্রোটিন, যা দেহের অভ্যন্তরে প্রবেশের পর কোনো নির্দিষ্ট জীবাণুর বিরুদ্ধে মানবদেহের সহজাত প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে বহুগুণ শক্তিশালী করে।
গুশচিন বলেছেন, এ টিকার মূল উপাদান হবে এমন একপ্রকার প্রতিষেধক তরল বা অ্যান্টিজেন, যা মানবদেহে বিস্তৃতভাবে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করবে। আমরা এই প্রতিষেধক তরল তৈরির কাজ শুরু করেছি। আশা করছি দুবছর বা তারও কম সময়ের মধ্যে এইডসের টিকা আমরা বাজারে আনতে পারব।
এইডস আসলে একই সঙ্গে রোগ এবং রোগের উপসর্গের সমষ্টি। হিউম্যান ইমিউনো ভাইরাস বা এইচআইভি এইডসের জন্য দায়ী। এই ভাইরাস মানবদেহে প্রবেশ করলে মানুষের স্বাভাবিক রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা ধ্বংস হয়ে যায়। ফলে, একজন এইডস রোগী সহজেই যে কোনো সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হতে পারেন, যা শেষ পর্যন্ত তার মৃত্যু ঘটাতে পারে। এইচআইভি সংক্রমণের পরবর্তী অবস্থাকেই এইডস বলা হয়। গত শতকের ১৯৮১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম এইডসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। ওই বছরই দেশটির রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল (সিডিসি) এই রোগের জন্য দায়ী ভাইরাস এইচআইভিও শনাক্ত করে।
অনিরাপদ যৌনতা, সিরিঞ্জের সূঁচের মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশ করে এইচআইভি ভাইরাস। এছাড়া, প্রসূতী মায়ের মাধ্যমেও এইডসে আক্রান্ত হতে পারে শিশু। কোনো গর্ভবতী নারীর দেহে এইডসের জীবাণু থাকলে তা অনাগত সন্তানকেও সংক্রমিত করে। সাহারা ও নিম্ন আফ্রিকার অঞ্চলগুলোতে এইডসের প্রকোপ সবচেয়ে বেশি। প্রতি বছর বিশ্বজুড়ে লাখ লাখ মানুষ মারা যান এইডসে। বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার হিসেব অনুযায়ী, ২০১৮ সালে বিশ্বে এইডসে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছিলেন ১০ লাখ মানুষ। ২০১০ সালের পর থেকে অবশ্য বিশ্বজুড়ে এইডসে আক্রান্ত রোগীদের সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। জাতিসংঘের হিসেব অনুযায়ী, ২০২৪ সালে বিশ্বজুড়ে এইডস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ১৩ লাখ, যা ২০১০ সালের তুলনায় ৪০ শতাংশ কম।
আগেও বিভিন্ন দেশ এইডসের টিকা তৈরির প্রকল্প হাতে নিয়েছিল, কিন্তু সেসব প্রচেষ্টা সফল হয়নি। রাশিয়ার গামালিয়া ন্যাশনাল সেন্টার বিশ্বের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় জীবাণু গবেষণা প্রতিষ্ঠান। করোনার প্রথম টিকা আবিষ্কার করেছিল গামালিয়া সেন্টার। স্পুটনিক ৫ নামের সেই টিকার করোনা প্রতিরোধী সক্ষমতা ছিল ৯৭ শতাংশেরও বেশি। বিশ্বের ৭০টিরও বেশি দেশে করোনা মহামারি মোকাবিলায় এ টিকা ব্যবহার করা হয়েছে। একদিকে এই মহামারীর কারণে সৃষ্ট হতাশা অন্যদিকে এন্টিরেট্রো ভাইরাল চিকিৎসার প্রতিশ্রুতির প্রতি সাড়া দিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা, ইউএনএআইডিএস, ইউনিসেফ ও অন্যান্য সহযোগী সংস্থা ২০০৩ সালে একটি নতুন পরিকল্পনা ৫ এর মধ্যে ৩ চালু করে। এ উদ্যোগের লক্ষ্য ছিল ২০০৫ সালের মধ্যে উন্নয়নশীল ও উত্তরাশীল দেশসমূহের ৩০ লাখ লোককে এন্টিরেট্রো ভাইরাল চিকিৎসা দেওয়া। এন্টিরেট্রো ভাইরালে চিকিৎসা শারীরিক দুর্বলতাজনিত সংক্রামণের মাত্রা কমিয়ে আনে। যা জনস্বাস্থ্য সুযোগ সুবিধার ওপর চাপ লাঘব করে এবং অন্যান্য রোগীর সেবায় অর্থ অবমুক্ত করে। এটি একটি শক্তিশালী স্বাস্থ্যসেবা অবকাঠামো।
এন্টিরেট্রো ভাইরালের সুযোগ সার্বজনীন করার জন্য বাস্তবভিত্তিক চেষ্টা চলছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে বলছে, সম্প্রতি ক্যামেরুনে এক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, প্রতিমাসে মাত্র ২০ ডলার ব্যয়ে জেনেরিক এন্টিরেট্রো ভাইরাল অত্যন্ত সহজতর ও কার্যকর হয়েছে। সমীক্ষায় আরো বলা হয়, উন্নত দেশগুলোর চেয়ে দরিদ্র দেশগুলোতে অব্যাহতভাবে চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়ার হার অনেক বেশি। উদাহরণ হিসেবে ক্যামেরুনের জরীপের কথা বলা হয়। সেখানে আক্রান্তরা শতকরা ৯৯ ভাগ চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলায় কার্যকর ফল হয়েছে। এন্টিরেট্রো ভাইরাল সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় ব্রাজিলে। সেখানে আক্রান্তদের বয়সের মতো আগের চেয়ে পাঁচ বছর বেড়েছে। যা আগে বেঁচে থাকার গড় সময় ছিল ছয় মাসের কম। এন্টিরেট্রো ভাইরাল চিকিৎসা রোগীদের বাঁচিয়ে রাখার চেয়েও অনেক বেশি কিছু করে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও মহামারী মোকাবেলায় ২ হাজার কোটি ডলারের বেশি অর্থ সংস্থান করে এইচআইভি আক্রান্তদের প্রতি নজিরবিহীন প্রতিশ্রুতি দেখিয়েছে। গ্লোবাল ফান্ড টু ফাইট এইডস টিউবারকিউলোসিস অ্যান্ড ম্যালেরিয়া বিশ্বব্যাংক, ইউনিসেফ ও ক্লিনটন ফাউন্ডেশনের মধ্যে অগ্রণী কিছু চুক্তির মাধ্যমে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য আক্রান্ত হ্রাসকৃত মূল্যে উচ্চমানের ওষুধ সরবরাহ করা ও পরীক্ষা নিরীক্ষা করা সম্ভব করে তুলেছে। তবুও অর্থায়নের অনেক চাহিদা এখনো মেটেনি এবং অগ্রগতিও যথেষ্ট নয়।
সময়ের ঘড়ি টিকটিক করে ২০০৫ সাল শেষ করে ২০২৫ সাল পার হতে চলেছে। এ সময়ের মধ্যে যে ৬০ লাখ লোকের চিকিৎসার প্রয়োজন। তাদের মাত্র ৪ লাখ লোকের চিকিৎসা চলছে। সূত্র বলছে, এন্টিরেট্রো ভাইরাল ওষুধ এইচআইভির চূড়ান্ত চিকিৎসা নয়। ওষুধ প্রতিরোধ ক্ষমতা, পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া এবং উপযুক্ত বিতরণ পদ্ধতি খুঁজে বের করা এখনো উদ্বেগের বিষয় রয়ে গেছে। যেমন এগুলো রয়ে গেছে শিল্পোন্নত বিশ্বে। তবে বিনা চিকিৎসায় ৫০ লাখের বেশি মানুষ শিগগিরই মারা যাবে, অকালে বেদনাদায়কভাবে এবং তাদের পরিবার, সমাজ ও বিশ্বব্যাপী মানব উন্নয়নের জন্য চড়া মূল্য দিয়ে।
লেখক: ড. ফোরকান আলী, গবেষক ও সাবেক অধ্যক্ষ
আরএমডি/জেআইএম
What's Your Reaction?