ঘুষে সবই সম্ভব রায়পুর সাব রেজিস্ট্রারের কার্যালয়ে

2 months ago 37

চাহিদা মতো ঘুষ দিলে লক্ষ্মীপুরের রায়পুর সাব রেজিস্ট্রার কার্যালয়ে অসম্ভব বলে কিছুই নেই। অভিযোগ রয়েছে, সাব রেজিস্ট্রার মো. ইউনুস ঘুষ ছাড়া কোনো কাজ করেন না। এতে পদে পদে হয়রানির শিকার হতে হয় গ্রাহক ও দলিল লেখকদের।

এদিকে ‘খাস লোক’ হিসেবে পরিচিত কার্যালয়ের ঝাড়ুদার কাম নৈশপ্রহরী মো. সোহেল ও অফিস সহকারী আছমা বেগমের ‘সংকেত পেলে’ সাব রেজিস্ট্রার চোখ বুঝে সই করেন। সোহেল এবং আছমাকে ম্যানেজ করতে পারলেই ‘সাহেব ম্যানেজ’ হয়ে যান। তাদের মাধ্যমেই এ কার্যালয়ে ঘুষ লেনদেন হয়। এরইমধ্যে অফিস সহায়কের চেয়ারে বসে সোহেলের গুণে গুণে ঘুষের টাকা নেওয়ার ভিডিও ফেসবুকে ভাইরাল হয়। এরপর অভিযানে নামে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

সাব রেজিস্ট্রার ইউনুস রায়পুরের কর্মস্থলে যোগদানের পর থেকেই দাতার অনুপস্থিতিতে ওয়ারিশ বাদ দিয়ে বণ্টননামা, এজলাসে না এসে ব্যক্তিগত কক্ষে বসে দলিল, কর ফাঁকি দিয়ে রেজিস্ট্রি করা হচ্ছে। দলিল টেম্পারিং, আম মোক্তার দলিল, বায়না রেজিস্ট্রির ঘটনাও ঘটছে। ভুক্তভোগীরা একাধিকবার সংশ্লিষ্ট কার্যালয়ে লিখিত অভিযোগ ছাড়াও প্রতিবাদ জানিয়ে মানববন্ধন, সংবাদ সম্মেলন করেও ফল পাননি। এক পর্যায়ে হয়রানির শিকার গ্রাহকরা দুদকের হটলাইনে অভিযোগ করেন। এর প্রেক্ষিতে দুদক চাঁদপুর সমন্বিত কার্যালয় থেকে দুইবার অভিযান চালানো হয়। সবশেষ চলতি বছরের ১৬ এপ্রিল দুদকের ওই কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক আজগর হোসেনের নেতৃত্বে অভিযান চালানো হয়। এসময় বিভিন্ন অনিয়ম পেয়ে সাব রেজিস্ট্রারকে সতর্ক করা হয়।

এর আগে ২০২৩ সালের ২৩ মার্চ দুদকের সহকারী পরিচালক আতাউর রহমানের নেতৃত্বে অভিযান চালানো হয়। এসময় টাকাসহ ঝাড়ুদার সোহেলকে আটক করা হয়।

রায়পুর দলিল লেখক ও ভেন্ডার কল্যাণ সমিতির সভাপতি গোলাম কিবরিয়া বলেন, এখনো হয়রানি বন্ধ হয়নি। আমরা চাই এই অফিসের সব হয়রানি বন্ধ হোক।

দলিল লেখকসহ কমপক্ষে ২২ ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০২৪ সালের ২৪ জুলাই মো. ইউনুস রায়পুর কার্যালয়ে যোগদান করেন। তার যোগদানের পর থেকে ‘সাহেবের ইশারা’ বুঝে কাজ করা শুরু করেন সোহেল ও আছমা। সাব রেজিস্ট্রার সপ্তাহের সোম, মঙ্গল ও বুধবার ৩-৪ ঘণ্টা অফিস করেন। অফিসে আসতে বিলম্ব হলে ঝাড়ুদার সোহেলকে দিয়ে দলিল সংক্রান্ত কাজ করান। ইউনুস বেশিরভাগ সময় এজলাসে না এসে ব্যক্তিগত কক্ষে বসেই দলিল রেজিস্ট্রি করেন। খাজনা দালিলা ছাড়া দলিল ও পৌর শহরের উপকণ্ঠের (বাজার) দাগভুক্ত দলিলে স্থাপনা থাকলে চুক্তির মাধ্যমে কর ফাঁকির মাধ্যমেও দলিল রেজিস্ট্রি করেন। রায়পুরে বছরে প্রায় ৬ হাজার দলিল রেজিস্ট্রি হয়।

ঘুষে সবই সম্ভব রায়পুর সাব রেজিস্ট্রারের কার্যালয়ে

অফিস সহকারী আছমা বেগম ও ঝাড়ুদার কাম নৈশপ্রহরী মো. সোহেল

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন জনপ্রতিনিধি বলেন, আমমোক্তার দলিল থেকে সাফ কবলা হলে দলিল মূল্যের ৩ শতাংশ টাকা সাব রেজিস্ট্রারকে দিতে হয়। এছাড়া কেরোয়া মৌজা সরকারি ভিপি তালিকাভুক্ত থাকায় জমির খাজনা ছাড়া ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকার বিনিময়ে দলিল রেজিস্ট্রি করাতে হয়।

ঝাড়ুদার সোহেল কয়েক বছর ধরে অফিস সহায়কের চেয়ারে বসে কারণে-অকারণে সেবাগ্রহীতার কাছে দর কষাকষি করে ঘুষ আদায় করেন। এ সংক্রান্ত ভিডিওতে দেখা গেছে, সোহেল বেশ আয়েশে গুণে গুণে টাকা নিচ্ছেন।

অভিযোগে দুদক রায়পুর সাব রেজিস্ট্রার কার্যালয়ে অভিযান চালায়। এসময় টাকাসহ সোহেলকে আটক করা হয়। পরে জেলা রেজিস্ট্রার সোহেলকে জেলার কমলনগরে বদলি করেন। তিনি সেখানে যোগদান না করে রায়পুরে বহাল থাকায় সাময়িক অব্যাহতি দেওয়া হয়।

সোহেল বলেন, আমি বদলি হওয়ার পর ৫ মাস কমলনগরে ছিলাম। তদন্তের পর আবার রায়পুরে এসেছি। আমার বিরুদ্ধে দুদক, থানা পুলিশসহ বিভিন্ন স্থানে মিথ্যা অভিযোগ দিয়েছে। দুদকের বিষয়টি তদন্তাধীন রয়েছে।

অফিস সহকারী আছমা বেগম বলেন, এক দলিল লেখকের জালিয়াতির কারণে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এজন্য লোকজন ভাড়া করে সে আমাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার করছে। অভিযোগগুলো মিথ্যা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ১৩ জানুয়ারি দাতার অনুপস্থিতে একটি দলিল রেজিস্ট্রি করা হয়। ওইদিন উপজেলার চর মোহনা ইউনিয়নের দক্ষিণ রায়পুর গ্রামের দাতা বিল্লাল হোসেন সুমন রায়পুর সাব রেজিস্ট্রার কার্যালয়ে আসেননি। হায়দরগঞ্জ থেকে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে রাস্তার ওপর জোর করে বিল্লালের কাছ থেকে প্রথমে বায়না চুক্তির স্ট্যাম্পে সই নেওয়া হয়। পরে কয়েকঘণ্টা তাকে জিম্মি রেখে দলিল প্রস্তুত করে নিলে সাব রেজিস্ট্রার ওই ২০ শতাংশ জমি রেজিস্ট্রি করেন। পরবর্তীতে এ ঘটনায় মামলা হলে গ্রহীতা আফরোজা ও নকলনবিশ আদিল হোসেন সবুজসহ ৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়। পরে আদালত মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাকে ওই দলিল জব্দের আদেশ দেন।

ভুক্তভোগী বিল্লাল হোসেনের ভাষ্যমতে, গ্রহীতার কাছ থেকে ৫ লাখ টাকার বিনিময়ে এ কাজ করা হয়। সাব রেজিস্ট্রার আমার শেষ সম্বল জমিটি প্রতারণার মাধ্যমে রেজিস্ট্রি করে দিয়েছেন। আমি রেজিস্ট্রির সময় সেখানে ছিলাম কি না, সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করলেই প্রমাণ পাওয়া যাবে।

গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর একটি ওয়ারিশি জমির বণ্টন দলিল রেজিস্ট্রি হয়। সেখানে আবদুর রহিম মাস্টারের মেয়ে পশ্চিম দেনায়েতপুর এলাকার উম্মে সালমাসহ ৪ জন ওয়ারিশকে বাদ রাখা হয়। ৩ লাখ টাকার বিনিময়ে সাব রেজিস্ট্রার জেনে শুনে এ রেজিস্ট্রি সম্পাদন করেন বলে উম্মে সালমার ছেলে জুবায়ের আল ইয়াসিন অভিযোগ করেন।

রায়পুর উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক জেড এম নাজমুল ইসলাম মিঠু বলেন, টাকা ছাড়া সাব রেজিস্ট্রার কোনো কাজ করেন না। ঘুষের বিনিময়ে জাল-জালিয়াতির বিষয়গুলো আমি উপজেলা আইন-শৃঙ্খলা কমিটির মাসিক সভায় তুলে ধরেছি।

সাব রেজিস্ট্রার মো. ইউনুস বলেন, অফিসের বাহিরে কেউ লেনদেন বা খরচাপাতি নিলে সেটার জন্য আমি দায়ী না। কোনো কাজে আমি এক কাপ চাও খাই না। আছমাকে সরকারি ফি নেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তিনি তা পরদিন কোষাগারে জমা দেন। ঝাড়ুদার সোহেল আগের মতো অফিসে আসেন না। আমিও তাকে সতর্ক করেছি। এছাড়া তথ্য গোপন ও জালিয়াতির কারণে দলিল লেখক তুহিন ও দুইজন নকলনবিশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

রায়পুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইএনও) ইমরান খান বলেন, ওই কার্যালয়ের একজন স্টাফের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেয়েছি। বিষয়টি তদন্তে ৩ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে।

কাজল কায়েস/এফএ/এমএস

Read Entire Article