চট্টগ্রাম বন্দর বিদেশিদের দেওয়া হলে বৃহত্তর কর্মসূচির হুঁশিয়ারি

2 months ago 45

চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল বিদেশিদের হাতে দেওয়া হলে বৃহত্তর কর্মসূচি ঘোষণার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন দেশ বাঁচাও, বন্দর বাঁচাও আন্দোলনের বক্তারা। রোববার (২৫ মে) দুপুরে জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক সভায় তারা বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর একটি লাভজনক এবং প্রাকৃতিক বন্দর। সেটি কোনোভাবেই বিদেশিদের দেওয়া যাবে না।

প্রতিবাদ সভায় অন্তর্বর্তী সরকারের সমালোচনা করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেছেন, দেশে তো দুর্নীতি কমেনি বরং বেড়েছে। কারণ হাসিনার আমলের ওই দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা এখনো রয়ে গেছে। এই সরকার তো দুর্নীতি রোধে হাত দেননি। কয়জনকে ধরা হয়েছে? ধরার উদ্যোগ নেয়নি। এমনকি বিচারও করেনি। এই মুহূর্তে দেশ ও বন্দর বাঁচানো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

তিনি বলেন, আজ মানুষ বলাবলি করছেন যে- ড. ইউনূসের যত সুবিধা নেওয়া দরকার তাই নেবেন এবং সেজন্য তিনি দেহত্যাগ করলেও পদত্যাগ করবেন না। বন্দর চালানোর জন্য যদি দেশে লোক না থাকে তাহলে বিদেশ থেকে আমরা এক্সপার্ট আনতে পারি। যেমনটি গার্মেন্টস শিল্প উন্নয়নে বিদেশের সহযোগিতা নেওয়া হয়েছিল।

হাসিনা পতনের আন্দোলন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমরা ৩১ দফা নিয়ে আন্দোলনে আছি। মাঝখানে যুগপৎ আন্দোলন শুরু হয়। এরপর ছাত্ররাও আসেন। অর্থাৎ সংস্কার নিয়ে আমরা তো একমত আছি। বৃহত্তর রাজনৈতিক দলগুলো তো একমত। তাদেরকে ডেকে পরামর্শ নিয়ে সংস্কারের পথ ত্বরাণ্বিত করেন।

বিএনপির শীর্ষ এই নেতা বলেন, আজকে দেশ বাঁচাতে গিয়ে সবাই গণতন্ত্রের প্রশ্নে একমত। আমরা চাই ড. ইউনূস সফল হোক। তিনি সফল মানে তো জুলাই অভ্যুত্থানের সফলতা। আজ ছাত্ররা ডেইলি সচিবালয়ে যায় কেন? ওসির টেবিলের সামনে বসে থাকে কেন? আমাদেরকে অন্য কিছু মনে করবেন না। তবে আমরা লড়াই করা জাতি। গণতন্ত্র, জনগণের মৌলিক ভোটাধিকার নিশ্চিত হওয়ার আগে যেন ঈশ্বর আমার মৃ্ত্যু না দেয়।

চট্টগ্রাম বন্দরের নিউ মুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়ার ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে এই প্রতিবাদ সভার আয়োজন করে দেশ বাঁচাও বন্দর বাঁচাও আন্দোলন। বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান ও ১২ দলীয় জোটের সমন্বয়ক সৈয়দ এহসানুল হুদার সভাপতিত্বে সভায় স্বাগত বক্তব্য দেন বাংলাদেশ এলডিপির চেয়ারম্যান চেয়ারম্যান ও দেশ বাঁচাও বন্দর বাঁচাও আন্দোলনের মূল সমন্বয়ক শাহাদাত হোসেন সেলিম।

বাংলাদেশ এলিডিপির মহাসচিব তমিজ উদ্দিন টিটুর সঞ্চালনায় আরও বক্তব্য দেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার, আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু, সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স, বাংলাদেশ বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, বাসদের সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশিদ ফিরোজ, বাংলাদেশ জাসদের সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হক প্রধান, গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নূরুল হক নূর, আমজনতা পার্টির সাধারণ সম্পাদক তারেক রহমান প্রমুখ।

মোস্তফা জামাল হায়দার সরকারের সমালোচনা করে বলেন, নয় মাসে একজনেরও বিচার হয়নি। তারা চট্টগ্রাম বন্দর লিজ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমরা স্পষ্টভাবে বলছি- সেটি বিদেশি কোম্পানিকে দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। দরকার হলে দেশের মেধাবী কর্মকর্তা দিয়ে বন্দর পরিচালনা করুন। আমরা আমাদের অর্থনীতির মূল ক্ষেত্রকে কারও কাছে দেব না। 

সরকারের উদ্দেশে তিনি বলেন, আপনাদের ব্যর্থতার কোনো সুযোগ নেই। আপনারা দ্রুত নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা করুন। উপদেষ্টারা একের পর এক বক্তব্য দিয়ে বিতর্ক করছেন।

স্বাগত বক্তব্যে বাংলাদেশ এলডিপির চেয়ারম্যান শাহাদাৎ হোসেন সেলিম বলেন, ১৩৮ বছর আগে চট্টগ্রাম বন্দর চালু হয়েছে। পিতার চাকুরি সূত্রে আমার জন্ম চট্টগ্রাম বন্দরে। চট্টগ্রাম বন্দর একটি প্রাকৃতিক বন্দর। সেটি জোয়ার-ভাটার ওপর নির্ভর করে। অর্থাৎ জাহাজ ভেড়াতে জোয়ার-ভাটার দরকার হয়। সেখানে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও কলম্বো থেকে ফিডার জাহাজে ১ হাজার থেকে আড়াইহাজার কন্টেইনার সম্বলিত জাহাজ ভিড়ে। সেখানে একটি বাঁক থাকার কারণে ১৯০ মিটারের বেশি বড় জাহাজ ভেড়ানো যায় না। বিশ্বের কোনো শক্তি এসে সেখানে এর চেয়ে বড় জাহাজ ভেড়াতে পারবে না। বরং আমরা নতুনভাবে বে-টার্মিনাল নির্মাণের কথা বলছি। যাতে বন্দর সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি হয়ে না যায়। বিদেশি কোম্পানি ডিপি ওয়ার্ল্ডকে দিলে তারা নিজের মতো করে ট্যারিফ নির্ধারণ করবে। 

তিনি আরও বলেন, বন্দর নিয়ে আমাদের নিরাপত্তা ও জাতির স্বার্থ দেখতে হবে। আজকে জিটুজি পদ্ধতিতে বন্দর দেওয়ার চিন্তা করছে। আবার পিপিপি পদ্ধতিতে দেওয়ার কথা বলছেন। একটা কথা মনে রাখা দরকার, ২০২১ বা ২০২২ সালের দিকে শেখ হাসিনার মেয়ে পুতুলের জামাই যখন দুবাই কারাগারে আটক তখন সালমান এফ রহমান একটা টার্মিনাল বের করে ডিপি ওয়ার্ল্ডকে দেওয়ার জন্য। তখনও আমরা বিরোধিতা করেছি। আবারও সেই একটি কোম্পানিকে সাবের হোসেন চৌধুরীর মাধ্যমে দেওয়ার কথা শুনছি। আমরা বলছি- নতুনভাবে একটা টাকা বিনিয়োগের সুযোগ নেই। চট্টগ্রাম বন্দর এমনিতেই আয়বর্ধক প্রতিষ্ঠান। সেখানে ২ হাজারের মতো শ্রমিক কর্মচারী নিয়োজিত। মাত্র দুই ঈদে ৮ ঘণ্টা করে ১৬ ঘণ্টা বন্ধ থাকে। বন্দরের ট্যারিফের বিভিন্ন ভাগ আছে। ডিপি ওয়ার্ল্ডকে দিলে তারা নিজের মতো ট্যারিফ নির্ধারণ করবে।

সেলিম বলেন, বন্দরের ব্যবস্থাপনা নিয়ে তো ব্যবসায়ীরা কোনো কথা বলেনি। তাহলে সেটি কেন বিদেশি কোম্পানিকে দিতে হবে। আমাদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে আওয়াজ তুলতে হবে যাতে চট্টগ্রাম বন্দর কাউকে দেওয়া না হয়।
 
এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, যে কোনো বিষয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া উত্তম। বাংলাদেশের যে সম্পদ তা খুব সীমিত। বঙ্গোপসাগর এবং চট্টগ্রাম বন্দর অন্যতম। ফলে দেশের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় বিবেচনায় নিয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে। বন্দর দেওয়ার বিষয়ে গণশুনানি করুন, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করুন। কারণ আপনারা তো অন্তর্বর্তী সরকার। সব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। সরকারের উচিত অতিদ্রুত নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করা।

রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, আমরা কিন্তু চট্টগ্রাম বন্দর লিজ দেওয়ার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে আন্দোলন শুরু করেছি। আজকে এ বিষয়ে সবাই সোচ্চার হয়েছেন। বর্তমান সরকারের চিন্তা ভাবনা করা দরকার ছিল। সবকিছু করার ম্যান্ডেট তো অন্তর্বর্তী সরকারের নেই। তাদের কাজ হলো গণহত্যার বিচার করা আহতদের সুচিকিৎসা করা, নিহতদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া, সংস্কার দ্রুত শেষ করে নির্বাচন দিন। বন্দর লিজ দেওয়া, এনবিআর ভাঙা আপনাদের কাজ না। সংস্কারের নামে কালক্ষেপণ করবেন না। দ্রুত নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণা দিয়ে জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করুন। করিডোর, বন্দর নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকে বিরত থাকুন। নির্বাচিত সরকার সেটি দেখবে।

বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) এর বজলুর রশিদ ফিরোজ বলেন, সেলিম যে বক্তব্য দিয়েছেন তার সঙ্গে একমত। দেশ ও জাতি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। ৯ মাস আগে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছে। তাদের অনেক চ্যালেঞ্জ ও সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তবুও সরকার দেশের যেসব বিষয়ে স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন জড়িত সে বিষয়ে তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সেটা সরকার করতে পারে না।

সাইফুল হক বলেন, অনুগ্রহ করে সিরাতুল মুস্তাকিমের পথে থাকেন। রোডম্যাপ ঘোষণা করে জনগণকে আশ্বস্ত করেন। উপদেষ্টাদের একের পর এক বক্তব্য রাজনৈতিক দলগুলোকে প্রতিপক্ষ ভাবছেন। যাদের কারণে বিতর্ক তৈরি হয়েছে তাদেরকে অব্যাহতি দেন, না হলে অপসারণ করুন। সরকার সঠিকভাবে মনোযোগ সহকারে কাজ করলে ডিসেম্বর তো বটেই, তার আগে নির্বাচন করা সম্ভব। কোনো হঠকারিতা করবেন না। আপনাদের সুমতি হোক। না হলে এই দলগুলো মিলে আন্দোলন গড়ে তুলব দেশ ও বন্দর রক্ষা করব।

সভাপতির বক্তব্যে সৈয়দ এহসানুল হুদা বলেন, আগামীতে আমাদেরকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। সরকার চট্টগ্রাম বন্দর লিজ দেওয়ার সিদ্ধান্ত থেকে ফেরত না আসলে আমরা বৃহত্তর কর্মসূচিতে যেতে বাধ্য হব।

Read Entire Article