চট্টগ্রামে বিক্রি করতে না পেরে ডাস্টবিনে চামড়া

2 months ago 11

সরকারি দামে চামড়া কেনেননি কোনো আড়তদার
লোকসানে মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ীরা
সরকারি ব্যবস্থাপনার সুফল নেই বাস্তবে

চট্টগ্রামে বিক্রি করতে না পেরে ডাস্টবিনে ফেলা হচ্ছে কাঁচা চামড়া। এ বছর সরকার চামড়ার দাম বাড়ালেও বিগত বছরগুলোর মতোই অনেক কম দামেই চামড়া কিনেছেন আড়তদাররা। ন্যায্য দাম না পেয়ে লোকসানের মুখে পড়েছেন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা।

অনেকে সময়মতো চামড়া বিক্রি করতে না পেরে বাধ্য হয়ে রাস্তার পাশে চামড়া ফেলে দিয়েছেন। অভিযোগ উঠেছে, দাম বাড়ানোর ঘোষণা দিলেও সরকারি ব্যবস্থাপনার কোনো সুফল নেই। কাঁচা চামড়া সংগ্রহে আগের মতোই রয়েছে সিন্ডিকেট কারসাজি। ফলে সরকার নির্ধারিত দামে চামড়া কেনেননি চট্টগ্রামের আড়তদাররা।

এবার ঈদুল আজহার আগে পশুর চামড়ার দর বাড়ানোর ঘোষণা দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এতে ঢাকায় গরুর প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত চামড়া ৬০-৬৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়, যা গত বছর ছিল ৫৫-৬০ টাকা। ঢাকার বাইরের গরুর প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৫৫-৬০ টাকা, যা গত বছর ছিল ৫০-৫৫ টাকা। পাশাপাশি ঢাকায় সর্বনিম্ন কাঁচা চামড়ার দাম ১ হাজার ৩৫০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। আর ঢাকার বাইরে কাঁচা চামড়ার সর্বনিম্ন দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১ হাজার ১৫০ টাকা।

আরও পড়ুন

এছাড়া সারাদেশে লবণযুক্ত খাসির চামড়া প্রতি বর্গফুট ২২ থেকে ২৭ টাকা দরে বিক্রি হবে ট্যানারিতে, যা গত বছর ছিল ২০ টাকা থেকে ২৫ টাকা। আর বকরির চামড়ার প্রতি বর্গফুটের দাম ২০ থেকে ২২ টাকা, যা গতবার ছিল ১৮ থেকে ২০ টাকা।

চট্টগ্রামে বিক্রি করতে না পেরে ডাস্টবিনে চামড়া

চট্টগ্রাম শহরের আতুরার ডিপো এলাকার আড়তগুলো সরেজমিনে পরিদর্শন করে দেখা গেছে, মৌসুমি ব্যবসায়ীরা বাদেও আশেপাশের বিভিন্ন উপজেলার মাদরাসার লোকজন শত শত চামড়া নিয়ে আড়তে আসেন। কিন্তু আড়তদারদের কাছ থেকে সাড়া পাননি তারা। আড়তদাররা নিজেদের ইচ্ছেমাফিক দামে চামড়া সংগ্রহ করেছেন। মৌসুমি ব্যবসায়ীরা চামড়া নিয়ে গভীর রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করেও অনেকে চামড়া বিক্রি করতে পারেননি। আবার ছাগলের চামড়া কেনেনটি কোনো আড়তদার। ফলে সংরক্ষণ উপযোগী ছাগলের চামড়ারও জায়গা হয়েছে ডাস্টবিনে।

অন্যদিকে রোববার সকালে (৮ জুন) শত শত চামড়া বিক্রি করতে না পেরে রাস্তার পাশে ফেলে গেছেন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা।

শনিবার সন্ধ্যা ৭টার দিকে আতুরার ডিপো এলাকায় এক ডাস্টবিনে ছাগলের কয়েকশ চামড়া দেখা গেছে। ডাস্টবিন থেকে এসব চামড়া সংগ্রহের পর সংরক্ষণ উপযোগী করে চামড়ার সঙ্গে লেগে থাকা অতিরিক্ত মাংসগুলো ছাড়িয়ে নিচ্ছিলেন কয়েকজন ব্যক্তি।

আরও পড়ুন

চামড়া সংগ্রহকারীদের মধ্যে একজন বাবুল দাশ। তিনি বলেন, ‘কোরবানির সময়ে আড়তগুলোতে বড় পশুর চামড়া সংগ্রহের আগ্রহ থাকে। বছরের অন্য সময়ে ছাগলের চামড়া কিনলেও এখন তারা কোরবানির ছাগলের চামড়া কিনতে আগ্রহ দেখান না। এবার যারা ছাগলের চামড়া এনেছেন, তারা বিক্রি করতে না পেরে ফেলে দিয়েছেন। আমরা এগুলো সংগ্রহ করছি।’

‘আমরা গরুর চামড়া পরিষ্কারের কাজ করি না। একজন আড়তদারের সঙ্গে আমাদের কথা রয়েছে। আমরা কয়েকজন মিলে ছাগলের চামড়া সংগ্রহ করে সংরক্ষণ উপযোগী করে দেবো।’

চট্টগ্রামে বিক্রি করতে না পেরে ডাস্টবিনে চামড়া

বাবুল দাশ বলেন, ‘বছরের অন্য সময়গুলোতে আমরা ঢোল বানানোর জন্য ছাগলের শুকনো চামড়া সংগ্রহ করি। প্রতি পিস শুকনো চামড়া ১০০ টাকা করে কিনতাম। কিন্তু কোরবানিতে যে পরিমাণ চামড়া আসে ঢোল তৈরির জন্য এত চামড়া লাগে না।’

হাটহাজারী থেকে চাঁদের গাড়ি ভর্তি করে ২৫০ চামড়া এনেছেন মৌসুমি ব্যবসায়ী আশরাফ উদ্দিন।

আশরাফ বলেন, ‘সরকার এবার চামড়ার দাম বাড়িয়েছে। বিগত কয়েক বছর কোরবানিতে চামড়ার ব্যবসা করতে গিয়ে অনেক টাকা লস দিয়েছি। এবারও ২৫০ চামড়া এনেছি। প্রতিটি চামড়া গড়ে ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকায় কিনেছি। এখানে আড়তদাররা ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকার বেশি দিতে চাইছেন না।’

আনোয়ারা সদর থেকে চামড়া নিয়ে আতুরার ডিপোতে আসা আরেক মৌসুমি ব্যবসায়ী মো. কামাল বলেন, ‘১০০ বড় চামড়া এনেছি। প্রত্যেকটি ৫০০ টাকার ওপরে কেনা, ৬০০ টাকাতেও কয়েকটি কিনেছি। পিকআপ ভাড়া করে এখানে (আড়ত) আনার পর আড়তদাররা ৪০০ টাকার বেশি দিতে চাইছেন না। এতে কমপক্ষে ২৫ হাজার টাকা লোকসান হবে আমার।’

আরও পড়ুন

নগরীর চান্দগাঁও হাজিরপুল দারুল মারিফ মাদরাসা থেকে ৬০০ চামড়া নিয়ে আতুরার ডিপোতে বিক্রির জন্য আনা হয়। কোরবানিদাতাদের কাছ থেকে বিনামূল্যে চামড়া সংগ্রহ করলেও সংরক্ষণ করার সুযোগ না থাকায় তারা চামড়াগুলো বিক্রি করতে আড়তে এনেছেন। কিন্তু ন্যায্য দাম না পেয়ে হতাশ মাদরাসা কর্তৃপক্ষ।

মাদরাসার শিক্ষক মাওলানা নুরুল আমিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘চামড়ার দাম বাড়ানোর বিষয়টি সরকারি ঘোষণার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। বাস্তব চিত্র উল্টো। এখানে চামড়া এনে আড়তদার পাওয়া যাচ্ছে না। সরকার চামড়ার সিন্ডিকেট ভাঙতে পারেনি। এখানে চামড়াগুলো কেউ প্রতি পিস ৩০০, কেউ ৩৫০ টাকা বলছেন। এখন পরিচিত একজনকে ফোনে চামড়াগুলো দিয়ে দিয়েছি। টাকাও পাইনি। কত করে দেবেন জানি না।’

তবে সরকার লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করেছে। কিন্তু মৌসুমি ব্যবসায়ীরা লবণযুক্ত করার বিষয়টি আমলে না নিয়েই গ্রাম থেকে চামড়া কিনেছেন। এতে আড়তে এসে কাঙ্ক্ষিত দাম পাচ্ছেন না।

চট্টগ্রামে বিক্রি করতে না পেরে ডাস্টবিনে চামড়া

বৃহত্তর চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া আড়তদার ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির আহ্বায়ক মাহবুবুল আলম বলেন, ‘আমরা সবসময় মৌসুমি বিক্রেতাদের সতর্ক করে থাকি। সরকার লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করেছে, কাঁচা চামড়ার নয়। অনেকে বিষয়টি বুঝেন না।’

আরও পড়ুন

তবে চামড়া সংগ্রহে কোনো সিন্ডিকেট নেই বলে দাবি আড়তদারদের। বৃহত্তর চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া আড়তদার সমবায় সমিতির সাবেক সহ-সভাপতি আবদুল কাদের জাগো নিউজকে বলেন, ‘আড়তে চামড়া লবণ দিয়ে একমাস সংরক্ষণ করা যায়। এরপর ট্যানারিতে বিক্রি করে দিতে হবে। কোরবানিতে চারদিক দিকে চামড়া আসে। যে যার মতো চামড়া কেনেন। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের মধ্যে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা চামড়া নিয়ে আড়তে আসেন না। আবার অনেকে বেশি দামের আসায় বিক্রি করতে সময়ক্ষেপণ করে। এতে চামড়াগুলো সংরক্ষণ অনুপযোগী হয়ে পড়ে।’

আবদুল কাদের বলেন, ‘ঢাকায় চামড়া সংরক্ষণের খরচ কম হলেও সরকার দাম বেশি নির্ধারণ করে দেয়। অথচ চট্টগ্রাম থেকে একটি চামড়া কিনে সংরক্ষণ করে ঢাকায় ট্যানারির কাছে বিক্রি পর্যন্ত ৪৯৮ টাকা খরচ হয়। চট্টগ্রামে আগে ২০টির বেশি ট্যানারি ছিল। এখন মাত্র একটি ট্যানারি আছে, যে কারণে আমাদের ঢাকার ট্যানারিগুলোর ওপর নির্ভর করতে হয়। তারা যে দামে কিনতে চাইবেন, আমাদের বাধ্য হয়ে সে দামে বিক্রি করতে হবে।’

কোরবানির পশুর কাঁচা চামড়া সংগ্রহ, সংরক্ষণ, ক্রয়-বিক্রয় সংক্রান্ত চট্টগ্রাম বিভাগীয় টিম লিডার ও বাংলাদেশ চা বোর্ডের সচিব মো. মিজানুর রহমান রোববার সকালে জাগো নিউজকে বলেন, ‘যেসব চামড়া অনেক রাতে এবং রোববার ভোরে আতুরার ডিপো আড়তে আনা হয়েছে, সেসব চামড়া সংরক্ষণ উপযোগী ছিলো না। এগুলো সংরক্ষণ উপযোগী ছিলো না, যে কারণে আড়তদাররা এসব চামড়া নেননি। ফলে কিছু চামড়া নষ্ট হয়েছে।’

‘এবার উপজেলা পর্যায় থেকে চামড়া শহরে না আনার ব্যাপারে সরকারিভাবে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেটা মানা হয়নি। আগের মতোই শহরে চামড়া নিয়ে আসা হয়েছে। এতে বিলম্ব হওয়ার কারণে চামড়ার গুণগত মান নষ্ট হয়ে গেছে।’

আরও পড়ুন

কোরবানির দিনের প্রথম দিকেও সরকার নির্ধারিত দামে চামড়া সংগ্রহ না করার বিষয়ে মিজানুর রহমান বলেন, ‘এখানে আড়তদাররা যেটা বলেছেন, তা হলো প্রত্যেকটি চামড়া লবণ দিয়ে সংরক্ষণ করতে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকার মতো খরচ হয়। কিন্তু সরকার যে চামড়ার দর নির্ধারণ করে দিয়েছে, তা হলো লবণযুক্ত চামড়া। তাই আড়তদাররা কম দামে চামড়া সংগ্রহ করেছেন।’

আতুরার ডিপো এলাকার আড়তে চামড়ার ন্যায্য দাম না পাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, এখানে তো আড়তদারদের একটি বিষয় (সিন্ডিকেট) রয়েছে। যে কারণে যারা আগ্রহ করে ন্যায্য দামে চামড়া বিক্রির জন্যে আড়তে নিয়ে এসেছেন, সে মূল্য তারা পাননি। তবে সার্বিক বিষয়ে সোমবারের মধ্যে চট্টগ্রামের চামড়া নিয়ে প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে জমা দেবো। প্রতিবেদনে সার্বিক বিষয়গুলো উল্লেখ করা হবে বলে জানান তিনি।

এমডিআইএইচ/এমএমএআর/এমএস

Read Entire Article