সুমন ইসলাম
‘মৃত্যুর সময় পাশে কেউ নেই, এর চেয়ে ভয়াবহ বোধহয় আর কিছুই নয়।’ (পৃ-১৫)
বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেশ এটা যেমন সত্য; তেমনই এটাও প্রতিষ্ঠিত সত্য, প্রতি বছর বন্যা এসে কোনো না কোনো জেলা ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। কিন্তু বন্যার ইতিহাসে এটা বোধহয় একেবারে বিরল ঘটনা, বৃহত্তর ফেনীকে তলিয়ে দেওয়া। জনবহুল, শান্ত, পরিপাটি একটি জেলাকে এভাবে ডুবিয়ে দেবে সম্ভবত কারো কল্পনাতেও আসেনি। এ বন্যায় সবচেয়ে বেদনাবিধুর দৃশ্য হচ্ছে, আপনজনের মৃত্যুতে পাশে কেউ নেই। কবর দেওয়ার মতো কোথাও মাটি নেই। পুরো জেলা পানিতে ভাসছে। তাই বাধ্য হয়ে স্বজনরা লাশকে ভেলায় ভাসিয়ে অজানা গন্তব্যে পাঠিয়ে দিয়েছেন। সাথে ছোট্ট একটি চিরকুট। তাতে হৃদয়ভাঙা অনুরোধ সংযুক্ত মোবাইল ফোন নম্বর, লাশ দাফনের ঠিকানা যেন দেওয়া হয়। আহা, সময়। আহা স্মৃতি। ‘...কোনমতে আশ্রয় নিলেও হঠাৎ প্রিয় মানুষের মৃত্যুতে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার মতো অবস্থা তৈরি হয়। গলা সমান পানিতে কোথাও শুকনো জমি দেখা যাচ্ছে না। এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি করেও শেষ পর্যন্ত প্রিয় মানুষটিকে আর কবর দেওয়া গেল না। প্রিয় মানুষের বিদায়ে ক্ষত-বিক্ষত মনটা আরো বিধ্বস্ত হয়ে যায় যখন লাশকে কলা গাছের ভেলা করে পানিতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। এর চেয়ে বেদনাদায়ক বোধহয় আর কিছুই নেই।’ (পৃ-১৫)
চব্বিশের ফেনীর বন্যায় ক্ষতির পরিমাণ অপরিমেয়। বিভিন্ন দপ্তর-পরিদপ্তর, সংবাদপত্রের পাতায় একটা সংখ্যাত্মক চিত্র উঠে এসেছে। লিখতে গিয়ে চিন্তার যে ভাঁজ পড়ে, বাস্তবতা কতটা ভয়াবহ; কল্পনা করা যায়! কৃষি খাত, পোল্ট্রি খাত, গ্রামীণ রাস্তা, আঞ্চলিক ও জাতীয় মহাসড়ক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মোটর যান, ঘর-বাড়ি, আসবাবপত্র, বৈদ্যুতিক সামগ্রী, ক্ষুদ্র-মাঝারি-বৃহৎ শিল্পকারখানা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ‘...ফেনীর ভয়াবহ প্লাবনে ক্ষতি ছাড়িয়েছে প্রায় ২ হাজার ৬৮৬ কোটি ২০ লাখ ৫০০ টাকা।’ (পৃ-১৬) অর্থ-সম্পদের ক্ষতি তো পুষিয়ে ফেলা যায়। কিন্তু মানুষটা নাই হয়ে গেলে ফিরে পাওয়ার উপায় কী? এই বন্যায় কতগুলো তরতাজা প্রাণ ঝরে গেলো। বয়সগত কোনো ফ্রেম ছিল না। শিশু, কিশোর, তাগড়া যুবক, বয়োবৃদ্ধ সবাইকে লাশ বানিয়েছে বন্যা। সংখ্যাটাও এলার্মিং। ‘...ফেনীর ভয়াবহ প্লাবনে সম্পদহানির পাশাপাশি ঘটেছে ব্যাপক প্রাণহানিও। সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, ২৯ জনের মৃত্যুর তথ্য পাওয়া গেছে। এছাড়াও আহত হয়েছে অনেকেই।’ (পৃ-১৬)
চব্বিশের বন্যায় যে বিষয়টা সবচেয়ে বেশি নাড়া দিয়েছে; সেটা হলো গ্র্যান্ড ইউনিটি। পুরো বাংলাদেশ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ফেনীকে উদ্ধার করার জন্য। স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো দিন-রাত এক করে কাজ করেছিল। উদ্ধার তৎপরতা, ত্রাণ সহযোগিতা, পুনর্বাসনসহ হাস্যোজ্জ্বল ফেনীকে ফিরিয়ে দিতে।
‘...ফেনীর স্থানীয় ৬৮টি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিজিবি, ফায়ার সার্ভিস একসাথে কাজ করেছে। কাজ করেছে আন্তর্জাতিক সেবা সংগঠন জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি, ইউনিসেফ বাংলাদেশ, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি, জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার, অক্সফ্যাম, রেড ক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, সেভ দ্য চিলড্রেন, কেয়ার ইন্টারন্যাশনাল, ওয়ার্ল্ড সেন্ট্রাল কিচেন, ইসলামিক রিলিফ বাংলাদেশ।’ (পৃ- ৮৬-৯১)
এ বন্যায় ফেনীবাসী যেটা প্রত্যক্ষ করেছে, তা হলো—সারাদেশের স্বেচ্ছাসেবী, মানবিক মানুষ, ব্যবসায়ীদের সর্বত্র সহযোগিতা। সারাদেশ থেকে ট্রাকে ট্রাকে ত্রাণ সহযোগিতা এসেছে। তবে এত এত সহযোগিতার ভেতর সবচেয়ে ভয়াবহ দুঃখজনক ব্যাপার হলো, সহযোগিতা করতে এসে একজন স্বেচ্ছাসেবীর আত্মদান। ‘...উদ্ধার তৎপরতায় যোগ দিয়ে বৃহস্পতিবার (২৩ আগস্ট) দুপুরে পানিতে ডুবে সাইফুল ইসলাম সাগর নামে এক স্বেচ্ছাসেবী মৃত্যুবরণ করেন। তিনি লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ উপজেলার করপাড়া ইউনিয়নের ২ নম্বর শ্যামপুর এলাকায় আলীম উদ্দিন বেপারী বাড়ির শহীদ উল্লাহর ছেলে।’ (পৃ-৯০)
বন্যা কেন হয়? অতিবৃষ্টি? নিচু এলাকাগুলোতে হয়তো এই তথ্য সঠিক। একনাগাড়ে ৬-৭ দিন বৃষ্টি হলে নিচু এলাকায় বন্যা হয়। ফেনীতে কেন হলো? অতিবৃষ্টি তো ছিল। আর কিছু? ফেনীর বন্যার কারণ অতিবৃষ্টি নয়। অতিবৃষ্টি তো ফেনীতে সব বছরই হয়। মূল কারণ, ভারতের ছেড়ে দেওয়া পানি, পানির তীব্র স্রোত, ফেনী সীমান্তে গাঙের বাঁধ কেটে দেওয়া। ‘...মঙ্গলবার (২০ আগস্ট), এদিন দুপুরে জানা গেল, ভারত সরকার কোনো সতর্কবার্তা না দিয়েই ফেনীর পাশের রাজ্য ত্রিপুরার ধলাই জেলার গোমতী নদীর ওপর থাকা জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের ডুম্বুর বাঁধের গেট খুলে দিয়েছে। ৩১ বছর পর ত্রিপুরা কর্তৃপক্ষ ডুম্বুর গেটের বাঁধ খুলে দেয়। সর্বশেষ ১৯৯৩ সালে এ বাঁধের গেট খোলা হয়েছিল। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী উজানের কোনো দেশ নদীর ওপর দেওয়া বাঁধের গেট খুলে দেওয়ার ৭২ ঘণ্টা আগে ভাটির দেশকে জানানোর কথা। কিন্তু এবার পূর্ব সতর্কতা ছাড়াই ডুম্বুর বাঁধ খুলে দেয় ভারত। এতে করে মুহুরী-কহুয়া-সিলোনীয়া নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ২৭টি ভাঙা অংশ দিয়ে হু-হু করে পানি ঢুকে পড়ে লোকালয়ে।’ (পৃ-১৩) ‘...প্রতিবছর দেশের এক তৃতীয়াংশ বিশেষ করে নিচু এলাকা প্লাবিত হয়। অপরিকল্পিত নগরায়ন, বেড়িবাঁধ ভেঙে প্লাবন ভূমিতে পানি প্রবেশ, নদীর নাব্যতা হারানো, স্লুইচগেট বাঁধের কারণে বৃষ্টির পানি বের না হতে পারায় বন্যা হয়ে থাকে।’ (পৃ-৯২)
বন্যা হলে করণীয় কী? অনেক কিছুই করার আছে। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে করার নাইও। আকস্মিক বন্যায় পূর্ব-প্রস্তুতি, বন্যাকালীন করণীয় কিংবা বন্যা পরবর্তী করণীয় সব এলোমেলো হয়ে যায়। চব্বিশের বন্যা এরকমই আকস্মিক ছিল।
‘...এদিকে কান ফাটানো মেঘের গর্জনে অঝোর ধারায় ঝরছে বৃষ্টি। বন্ধ হওয়ার কোনো নাম নেই। এর মধ্যে অজানা আতঙ্ক মনের মধ্যে ভর করেছে। ...আমাদের ফেনী ফায়ার সার্ভিস স্টেশন ক্রমশ পানির নিচে তলিয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে আমাদের অনেক মালামাল উপরে তুলেছি। অনেক প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র এখনও তোলা সম্ভব হয়নি। আমাদের উদ্ধার কাজে ব্যবহৃত গাড়িগুলো পানিতে ভাসছে। এমতাবস্থায়, আমাদের হাতে কোনো বোট না থাকায় উদ্ধার কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। ...লাইফ জ্যাকেট সংগ্রহের জন্য কল দিলাম ফেনীর জেলা প্রশাসক জনাব মুছাম্মৎ শাহীনা আক্তারকে। এসময় তিনি বললেন, আমাদের কাছে কোনো লাইফ জ্যাকেট নেই। আপনি অন্য কোথাও চেষ্টা করে দেখুন। ...অনেক কষ্ট করে একটা নৌকার ব্যবস্থা করলাম কিন্তু সেটিও পরিবহন জটিলতার জন্য মিস করতে হলো।’ (পৃ- ১৭-১৮) এরকম আকস্মিক বন্যা থেকে বাঁচা দরকার। করণীয় কী? ‘...নামমাত্র উদ্যোগ আর লোক দেখানো কাজ করে বন্যা ঠেকানো যাবে না। ভয়াবহ বন্যায় মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনীয়া নদীর অন্তত ২৭টি স্থানে ভাঙনের সৃষ্টি হয়েছে। এসব স্থানে টেকসই বাঁধ নির্মাণ নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি ভারত কর্তৃক কেটে দেয়া বাঁধ দ্রুত মেরামত, ফেনী নদী থেকে অবৈধভাবে পানি উত্তোলন বন্ধ করা, আন্তর্জাতিক পানি প্রবাহ আইনে সই নিশ্চিত করা ও বিজ্ঞান ভিত্তিক গবেষণার মাধ্যমে বন্যা থেকে সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।’ (পৃ- ৯২-৯৩)
চব্বিশের বন্যা। একটি স্মারকগ্রন্থ। একটি স্মৃতিগ্রন্থ। ফেনীর ভয়াবহ বন্যার ওপর লেখা। নজরুল বিন মাহমুদুল কর্তৃক রচিত। ১৬০ পৃষ্ঠার বইটি মোটামুটি তিন ভাগে বিভক্ত। প্রথম ভাগে ফেনীর বন্যার সূচনা, বন্যার সময়, পরবর্তী অবস্থা সম্পর্কিত লেখকের সরাসরি সম্পৃক্ততা ও অভিজ্ঞতা বর্ণনা করা হয়। দ্বিতীয় ভাগে স্থিরচিত্রে ফেনীর বন্যাকে উপস্থাপন করা হয়। তৃতীয় ভাগে ফেনী অঞ্চলের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সরাসরি অভিজ্ঞতালব্ধ অনুভূতি মলাটবদ্ধ করা হয়। ঢাকার অভিজাত প্রকাশনী ‘বইনামা’ থেকে রাশেদুল হাসানের তত্ত্বাবধানে বইটি বাজারে আসে গত ফেব্রুয়ারিতে। বইটির প্রকাশক হিসেবে ছিলেন ফেনীর স্টার লাইন গ্রুপের পরিচালক মো. মাঈন উদ্দিন। অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক এবং দৃষ্টিনন্দন প্রচ্ছদ তৈরি করেন চারু পিন্টু। বইটির বিনিময় মূল্য ধরা হয় ৩৫০ টাকা। বইটি উৎসর্গ করা হয় লেখকের মা-বাবার নামে। উৎসর্গপত্রে একটি চমৎকার ছড়াও সংযুক্ত করা হয়। ‘এক পায়ে ভর দিয়ে,/ মাথায় নিয়ে বোঝা;/ সন্তানকে মানুষ করা,/ নয়তো খুব সোজা।’ বইটির ভূমিকাপত্র লেখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক শাহ মো. আজিমুল এহসান।
বইটি মূলত লেখকের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সংমিশ্রণ। লেখক বন্যার শুরু থেকে সরাসরি উদ্ধার কার্যক্রম, পুনর্বাসনসহ সামগ্রিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিলেন। খুব কাছ থেকে দেখেছেন, মানুষের হাহাকার, ক্ষয়ক্ষতির ভয়াবহতা। এসবই উঠে এসেছে। পাশাপাশি বইটিতে দেখিয়েছেন বন্যার কারণ, প্রতিকার-প্রতিরোধ বিষয়ে করণীয়।
লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, ত্রৈমাসিক ত্রিমাত্রা।
এসইউ/এএসএম