চাঁদাবাজি ছেড়ে সফলতার স্বপ্ন দেখছেন তারা

2 days ago 8

আনোয়ারা ইসলাম রানী। সর্বশেষ রংপুর-৩ আসনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে দেশ-বিদেশে আলোচনায় আসেন তিনি। এর বাইরেও দীর্ঘদিন ধরে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের জন্য কাজ করেছেন। চেষ্টা করছেন সফল উদ্যোক্তা হওয়ার। রূপান্তরের ব্যানারে এসব মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছেন রানী।

‘ন্যায় অধিকার তৃতীয় লিঙ্গ উন্নয়ন সংস্থা’র সভাপতি রানী বলেন, এখনও নিজেকে সফল উদ্যোক্তা মনে করি না। চেষ্টা করছি মাত্র। রংপুরে ৩৯২ জন তৃতীয় লিঙ্গের সদস্য রয়েছেন। এর মধ্যে ১৫০ জনকে সমাজসেবার মাধ্যমে চারটি প্রশিক্ষণ নেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলাম। সেখান থেকে ৩০ জন কর্মসংস্থানের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছেন। প্রথমে তালিকা করেছি কোন সদস্য কোন কাজে পারদর্শী। তালিকা অনুযায়ী তাদের সেই প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর হস্তজাত শিল্পের রূপান্তর নামে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান চালু করি। সেখানেও ২৪ জন তৃতীয় লিঙ্গের সদস্য কর্মসংস্থানের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছেন। এখানে তারা স্থায়ী ও অস্থায়ী ভিত্তিতে কাজ করছেন।

চাঁদাবাজি ছেড়ে সফলতার স্বপ্ন দেখছেন তারা

যেভাবে উদ্যোক্তা হলেন রানী

চাকরি পাওয়া যে লেখাপড়ার মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত নয় সেটির প্রতিফলন এখন নানান ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে। শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ উদ্যোক্তা হতেই বেশি উৎসাহিত। সেই পথে হেঁটেছেন আনোয়ারা ইসলাম রানী।

‘আমি সেদিনই নিজেকে সফল মনে করব যেদিন আমার পরিবারের ৩৯২ জনই ভিক্ষাবৃত্তি ছেড়ে মাথা উঁচু করে বাঁচতে শিখবে।’- আনোয়ারা ইসলাম রানী।

রানী জাগো নিউজকে বলেন, পথেঘাটে এখন ফুডকার্টের ব্যবসা শুরু হয়েছে। ছাত্র-ছাত্রীরাও করছে। অনেক ভালো পরিবারের মানুষও করছে। ভাবলাম, এখানে যেহেতু খুব বেশি বিনিয়োগ লাগবে না, সুতরাং কিছু সুযোগ তৈরি হতে পারে। তখন ফুডকার্টের ব্যবসা চালু করি। সেখানেও আমার তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর চারজন কাজ করছে। এরা সবাই আগে পথেঘাটে মানুষের কাছে টাকা-পয়সা কালেকশন করত। এখন কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে সবাই সুন্দরভাবে জীবনযাপন করছে। সেদিনই আমি নিজেকে সফল মনে করব যেদিন ৩৯২ জনই ভিক্ষাবৃত্তি থেকে বেরিয়ে কর্মসংস্থানের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে মাথা উঁচু করে বাঁচতে শিখবে।

চাঁদাবাজি ছেড়ে সফলতার স্বপ্ন দেখছেন তারা

আনোয়ারা ইসলাম রানী বলেন, ভালো কাজ করলে বিভিন্ন বাধা আসবেই। বাধাগুলো হচ্ছে; কোথাও কেনাকাটা করতে গেলে কেউ হয়তো ভয় পাচ্ছে আমাদের দিতে চাচ্ছে না, পরে অনেক বুঝিয়ে নিতে হয়। ক্রেতারাও অনেক সময় ভয় পায়, ওখানে গেলে কি না কি হবে। সমাজের মানুষের মধ্যে এ ধরনের ভয় এখনও কাজ করে। ধীরে ধীরে সবার দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হবে। আমরা সবাই চেষ্টা করছি, পরিবর্তন হওয়ার। আমি সমাজের মানুষকেও অনুরোধ করব, যেন দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করে আমাদের গ্রহণ করে। আমরা যেন দ্রুত মূল ধারায় অংশ নিতে পারি।

রানীর প্রতিষ্ঠানে কর্মরত রেখা জানান, একটা সময় মানুষের কাছ থেকে টাকা তুলেই আমরা জীবিকা নির্বাহ করতাম। কিন্তু রানী আপার কারণে আমরা এখন কর্মসংস্থান পেয়েছি। চাঁদা তুলে খেতে হয় না, কাজ করেই খাই। এটাই আমার জন্য সম্মানের।

‘দেওয়ালটা ভেঙে দিতে চেয়েছিলাম। আমরাও সর্বোচ্চ পদের জন্য নির্বাচন করব। নির্বাচিত হইনি কিন্তু আমার পরবর্তী প্রজন্মের কেউ না কেউ যেন নির্বাচিত হয় সেই পথটা দেখিয়ে দিয়েছি।’- আনোয়ারা ইসলাম রানী

নির্বাচনের মাধ্যমে আলোচনায় রানী

রংপুর সিটি করপোরেশনের আংশিক ও সদর উপজেলা নিয়ে গঠিত রংপুর-৩ আসনে সংসদ নির্বাচনে অংশ নেন তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর আনোয়ারা ইসলাম রানী। ভোটের মাঠসহ জেলার বিভিন্ন এলাকায় এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছেন রানী।

চাঁদাবাজি ছেড়ে সফলতার স্বপ্ন দেখছেন তারা

নির্বাচনের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার মাথায় আসলো সারাজীবন কেন এই জনগোষ্ঠী পিছিয়ে থাকবে। আমি দেওয়ালটা ভেঙে দিতে চেয়েছিলাম। আমরাও এ দেশের সর্বোচ্চ পদের জন্য নির্বাচন করব। আমি নির্বাচিত হইনি কিন্তু আমার পরবর্তী প্রজন্মের কেউ না কেউ যেন নির্বাচিত হয় সেই পথটা খুলে দিলাম। আমি মনে করি একটা সময় আমার মতো কেউ না কেউ সেই পদে গিয়ে ঠিকই বসবে, জনপ্রতিনিধি হিসেবে মানুষের কল্যাণে কাজ করবে।

চাঁদাবাজি ছেড়ে সফলতার স্বপ্ন দেখছেন তারা

রানী বলেন, মানুষের ধারণা ছিল এরা হয়তো পারবে না, জয়ী হয়নি নির্বাচনে, আমার রাজনীতি করার কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। কোনো দলের সঙ্গেও কখনো সম্পৃক্ত ছিলাম না। রাজনীতিও ভালো মতো বুঝিও না। আমি হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিয়ে দেড়-দুই মাসের মধ্যে নির্বাচনে নেমে যাই।

‘আমাদের প্রতি এখনও সমাজে নেতিবাচক ধারণা রয়েছে। তৃতীয় লিঙ্গ মানেই সমাজবহির্ভূত কিছু। কেউ গ্রহণ করতেই পারে না। তবে সব বাধা ডিঙিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে রানীর পরিবার।’ -আনোয়ারা ইসলাম রানী

সমাজ ও পরিবারের বাধায় হার মানেননি রানী

তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের প্রতি এখনও সমাজে নেতিবাচক ধারণা রয়েছে। মানুষের মাঝে এ বিষয়ে সচেতনতা বাড়লেও সর্বত্র সেটি জোরালো হয়নি। ফলে সমাজ ও পরিবারের বাধায় সবসময় পিছিয়ে থাকেন অনেক তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ। তবে সব বাধা ডিঙিয়ে এগিয়েছেন রানী।

‘ছোটবেলায় বাবার দিক থেকে বাধা আসত, আত্মীয়-স্বজন অনেকেই মেনে নিতে চাইত না। সেগুলো একটা সময় ছিল। সেসব পার করেই এসেছি। এখন ধীরে ধীরে সব মানিয়ে নিয়েছি। পরিবারের সঙ্গেই থাকছি। আমি আমার নিজের পরিবারকে নিয়েও থাকি। আমার যে কমিউনিটির মানুষ আমি সেই পরিবারকে নিয়েও থাকি। দুই পরিবারকে একসঙ্গে নিয়েই থাকি’, বলছিলেন রানী।

চাঁদাবাজি ছেড়ে সফলতার স্বপ্ন দেখছেন তারা

রানী বলেন, ‘ভালো কাজ করতে গেলে একটু সমস্যা তো হবেই। তবে আমার মনে হয় না সামনে এ সমস্যাগুলো থাকবে। কারণ আমরা যেভাবে এগোচ্ছি, আমাদের মানুষ গ্রহণ করা শুরু করেছে বলে ২৪ হাজার মানুষ আমাকে ভোট দিয়েছে। এই ২৪ হাজার তো আমার কমিউনিটির ভোট নয়, সাধারণ মানুষের ভোট। আমি মনে করি যে সব সমস্যা শেষ হয়ে একদিন আমরা মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারব।’

নিজের কমিউনিটির মানুষের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘তাদের সবার ভেতরেই কোনো না কোনো প্রতিভা আছে। সবাইকে নিজের প্রতিভা বিকাশের সুযোগ দিতে হবে। অবশ্যই বাধা আসবে, তবে বাধা অতিক্রম করতে হবে। সবাইকে অনুরোধ করব যেন কোনো বাধায় আমরা থেমে না যাই।’

আইএইচআর/এমআরএম/এমএমএআর/এএসএম

Read Entire Article