বরগুনার প্রায় ১২ লাখ মানুষের চিকিৎসাসেবার একমাত্র ভরসাস্থল ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতাল। সম্প্রতি ১০০ শয্যা থেকে উন্নীত করে ২৫০ শয্যা করা হলেও বাড়েনি জনবল। এই সংকটেও ঠিকমতো হাসপাতালে আসেন না চিকিৎসকরা। ফলে চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন রোগীরা।
রোগীদের অভিযোগ, হাসপাতালে উপস্থিত থাকেন না বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। মাসে ১৫-১৬ দিন এসেও তুলছেন পুরো মাসের বেতন। তবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, অভিযুক্ত চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সোমবার (১২ মে) ঘড়ির কাঁটায় তখন বেলা ১১টা। দেখা গেলো ২০৯ নম্বর কক্ষ ও পুরোনো ভবনের ২৬ নম্বর কক্ষের সামনে টিকেট হাতে রোগীদের ভিড়। কিন্তু দেখা নেই ডা. ফারহানা মাহফুজ ও ডা. সাইফুল ইসলামের। সময় গড়িয়ে তখন দুপুর ১২টা। নিজ কক্ষে এলেন হাসপাতালের আবাসিক সার্জন ডা. ফারহানা মাহফুজ। ঠিক একই সময়ে ২৬ নম্বর রুমে প্রবেশ করেন জুনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি) ডা. সাইফুল ইসলাম। তড়িঘড়ি করে অপেক্ষমাণ রোগীরা ছুটলেন তাদের দরজায়। কারণ তারা থাকবেন দুপুর ২টা পর্যন্ত।
পরেরদিন তখন বেলা সাড়ে ১১টা। হাসপাতালে দেখা মিললো না ডা. ফারহানা মাহফুজের। ডা. সাইফুল ইসলামের কক্ষের সহকারী জানালেন, তিনি আজ আসবেন না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেলো, অন্যান্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মধ্যে ডা. আশিকুর রহমান, ডা. মেহেদী পারভেজ, ডা. মাহবুবুর রহমান ও ডা. আবু সালেহ সপ্তাহে তিন-চার দিনের বেশি আসেন না।
অভিযোগ আছে, সদর হাসপাতালের চিকিৎসকরা হাসপাতালের সময়সূচির সঙ্গে মিলিয়ে প্রাইভেট ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের চেম্বারে বসেন। সেখানে দিন ও সময় উল্লেখ করে তাদের পোস্টার লাগানো থাকে। চিকিৎসকদের বেশিরভাগই থাকেন বরগুনার বাইরে। শুধু সপ্তাহে তিন-চার দিন এসে সরকারি হাসপাতালে কিছু রোগী দেখে দুপুরের পরেই চলে যান প্রাইভেট চেম্বারে। বাকি দিনে তারা ঢাকা আর বরিশালের নিজস্ব চেম্বারে নিয়মিত রোগী দেখেন।
আরও পড়ুন:
- ৫০০ শয্যার হচ্ছে জাতীয় চক্ষু হাসপাতাল, ব্যয় ৪২০ কোটি টাকা
হাটহাজারী-কর্ণফুলীতে দুটি হাসপাতাল নির্মাণের পরিকল্পনা হচ্ছে
ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার ক্ষমতা চান সিভিল সার্জনরা
চিকিৎসাখাতে শৃঙ্খলা ও জবাবদিহিতা প্রয়োজন: প্রধান উপদেষ্টা
হাসপাতালের তথ্যমতে, ২৫০ শয্যার হাসপাতালে চিকিৎসকের ৫৫টি পদের বিপরীতে আছেন মাত্র ১৬ জন। এর ১০টি সিনিয়র কনসালটেন্ট পদের মধ্যে অ্যানেস্থেসিয়ার সিনিয়র কনসালটেন্টই আছেন শুধু। কার্ডিওলজি, অর্থোপেডিক, গাইনি, মেডিসিন, পেডিয়াট্রিক, প্যাথলজি, সার্জারি, ইএনটি ও চক্ষু বিভাগের সিনিয়র কনসালটেন্ট পদের সবই শূন্য। জুনিয়র কনসালটেন্টের ১২টি পদের বিপরীতে শূন্য আছে সার্জারি, চক্ষু, কার্ডিওলজি, অর্থোপেডিক, প্যাথলজি, রেডিওলজিসহ সাতটি পদ। আবাসিক সার্জন তিনজনের জায়গায় আছেন দুজন। এসব কারণে চিকিৎসাসেবা বঞ্চিত হচ্ছেন রোগীরা।
আবাসিক সার্জন ও গাইনি রোগের চিকিৎসক ফারহানা মাহফুজের জন্য অপেক্ষা করছিলেন নাসিমা বেগম। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘সকাল ৮টায় মেয়েকে হাসপাতালে এসেছি । এখন ১১টা বাজে। এখনো ডাক্তার আসেনি। শুনেছি তিনি ১২টার সময় আসবেন।’
গাইনি চিকিৎসকের অপেক্ষায় থাকা তানজিলা নামের এক রোগী জাগো নিউজকে বলেন, ‘এসেছি সকাল ৯টায়। তখন থেকে অপেক্ষা করছি। ডাক্তার কখন আসবে কেউ বলতে পারছেন না।’
নাক কান গলা বিশেষজ্ঞকে দেখাতে এসেছিলেন সীমা আক্তার। জায়গা না পেয়ে মেঝেতে বসেছিলেন। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘বাচ্চাকে নিয়ে এসেছি সকাল ৯টায়। এসময় রুম খোলা থাকলেও ডাক্তার (ডা. সাইফুল ইসলাম) নেই। এখান থেকে বলছে তিনি চেম্বারে রয়েছেন। এগুলোর দেখার যেন কেউ নেই।’
অসুস্থ শিশু সন্তান নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি থাকা মুক্তা নামের এক শিশুর মা জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি আমার বাচ্চা নিয়ে গত এক সপ্তাহ ধরে ভর্তি আছি। ডা. মেহেদী পারভেজ সপ্তাহে তিন দিন আসেন। ১১টায় এসে ৩টা পর্যন্ত থেকে চলে যান। তার পরিবর্তে এখানে একজন মেডিকেল অফিসার ম্যাডাম থাকেন। এরপরও যদি বাচ্চাদের বড় কোনো সমস্যা হয়, ডা. মেহেদীর প্রাইভেট চেম্বারে দেখাতে হয়। হাসপাতালে সময়মতো ডাক্তার পাই না।’
এ বিষয়ে ডা. ফারহানা মাহফুজ বলেন, আমার সম্পর্কে কিছু জানতে হলে আমার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এ বিষয়ে আপনার সঙ্গে আমার কোনো কথা নেই বলে ফোন কেটে দেন।
সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) বরগুনা জেলা শাখার সভাপতি ও বরগুনা জেনারেল হাসপাতালের রোগী কল্যাণ সমিতির আজীবন সদস্য মনির হোসেন কামাল জাগো নিউজকে বলেন, ‘বরগুনা সদর হাসপাতালে আগে থেকেই চিকিৎসক ও জনবলসহ নানা সংকটে আছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা ঠিকমতো হাসপাতালে থাকেন না। দু-একজন ছাড়া বাকিরা শুধু হাজিরার জন্যেই আসেন। এর বাইরে বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে তারা প্রাইভেটভাবে বসেন।’
হাসপাতালে ঠিকমতো চিকিৎসক আসেন না স্বীকার করে বরগুনা ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. একেএম নজমুল আহসান জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের এখানে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সংকট রয়েছে। যে কয়জন আছেন চিকিৎসকের ঘাটতি পূরণ করার জন্য তারা অনেক চেষ্টা করছেন। তারপরও কারও কারও বিষয়ে অভিযোগ এসেছে। অভিযুক্ত চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ বিষয়ে বরগুনা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শফিউল আলম জাগো নিউজকে বলেন, সংকট সমাধানে আমরা কাজ করছি। চিকিৎসক পদায়িত হলে প্রাথমিক যে সংকট তা কেটে যাবে।
এসআর/জেআইএম