জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী বেবী নাজনীন। রাজনীতির মাঠেও সরব তিনি। দীর্ঘদিন পর যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরেছেন তিনি। নতুন করে সংগীত ও রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়া, দেশ ছেড়ে যাওয়া ও প্রাসঙ্গিক নানান বিষয়ে তিনি কথা বলেন জাগো নিউজের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মিজানুর রহমান মিথুন।
জাগো নিউজ: কেমন আছেন?
বেবী নাজনীন: আমি বেশ ভালো আছি।
জাগো নিউজ: আপনি দেশে আসবেন, এমন খবর জেনে আপনার অনুরাগীরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন। দীর্ঘদিন পর দেশে এসে কেমন লাগছে?
বেবী নাজনীন: এবার দেশে এসে ভীষণ ভালো লাগছে। এতদিন আমার শ্রোতা-ভক্তরা আমাকে যেমন মিস করেছেন, আমিও তাদের ভীষণ মিস করেছি। দীর্ঘ ১৬ বছর পর দেশে এসেছি। ১৬ বছর মোটেই কম সময় নয়।
জাগো নিউজ: যদি জানতে চা, এতদিন দেশের বাইরে থাকার কারণ কী?
বেবী নাজনীন: আমার মনে হচ্ছে এ প্রশ্নের জবাব অনেকেই জানেন। তারপরও বলছি, এতদিন বাংলাদেশে আমার গান গাওয়া নিয়ে সমস্যা ছিল। তাছাড়া বাংলাদেশে মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি বলতে কিছু ছিল না। গানের কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। সংগীত নিয়ে ওয়ার্কশপ নেই। মিউজিক্যাল এক্সারসাইজ নেই। মিউজিক্যাল কনসার্ট নেই। এগুলো যদি না থাকে, তাহলে একজন শিল্পী আসলে করবে কী? তাছাড়া আমি অনেকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছি। সেসব বাধার পরও আমি যদি এখানে থাকতাম, তাহলে এতদিন হয়তো বেঁচে থাকতে পারতাম না।
জাগো নিউজ: বিশাল এই সময়ের ব্যবধানে দেশে অনেক কিছু ঘটে গেছে। দেশে এখন অন্তর্বর্তী সরকার। এ সরকারের কাছে আপনার প্রত্যাশা কী?
বেবী নাজনীন: অন্তর্বর্তী সরকারকে শুভেচ্ছা জানাই। সরকার বিভিন্ন ধরনের কাজ করছে। এই সরকারের কাছে দেশের সব মানুষ যেমন প্রত্যাশা করছেন, আমি ঠিক তাই প্রত্যাশা করছি। ইতিবাচক আশা নিয়ে আছি, নিশ্চয়ই এ সরকারের কাছ থেকে আমরা ভালো কিছু পাব।
জাগো নিউজ: অনেকে মনে করছেন দেশে এসে আপনি রাজনীতিতে সক্রিয় হবেন?
বেবী নাজনীন: রাজনীতিতে আমি আছিই। বহুদিন ধরেই আছি। রাজনীতিতে থাকব। রাজনীতি তো বসে বসে ভাবার কোনো বিষয় নয়, এটা ফিল্ড ওয়ার্ক, তৃণমূল মানুষের সঙ্গে কাজ। সব শ্রেণির মানুষের সঙ্গে দেখা করা, যোগাযোগ রাখা। মানুষের সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা। তাদের উন্নয়ন নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা। একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আমি যেহেতু সম্পৃক্ত আছি, এ দলের ঘরে আছি। আমার দল বাংলাদেশ জাতীয়বাদী দল বিএনপি, এটি দেশের অনেক বড় একটি দল। দদলটি যেভাবে দীর্ঘদিন ধরে সংগঠিত হয়ে আছে, যেভাবে কাজ করে যাচ্ছে, তাদের সাথে আমিও আছি। আমি শুধু বাংলাদেশে অবস্থানকালেই নয়, দেশের বাইরে থাকাকালেও দলের সঙ্গে ছিলাম। দলের হয়ে কাজ করেছি। সামনেও করব।
জাগো নিউজ: সম্প্রতি দেশে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান সংগঠিত হয়েছে। সে সম্পর্কে যদি কিছু বলতেন?
জাগো নিউজ: এ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে যে প্রাণহানি ঘটেছে তা বড় ধরনের বিপর্যয়। এ প্রাণহানিতে আমি ভীষণ কষ্ট পেয়েছি। অনেক কচি প্রাণ আন্দোলনে শহীদ হয়েছে। পৃথিবীকে ভালো করে দেখার আগেই তারা পৃথিবী থেকে চলে গেছে। এত তাজা প্রাণ হারানোর কষ্ট সত্যিই অসহনীয়। একজন মা হাজারো কষ্ট উপেক্ষা করে একটি সন্তান লালন-পালন করেন। বাবা-মা একটি সন্তানকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখেন। সেই সন্তান যদি তারা হারিয়ে ফেলেন, তবে সেই কষ্ট তো বলে বোঝোনো যাবে না। এবারের আন্দোলনে এমন শত মায়ের সন্তান প্রাণ দিয়েছে। তারাই তো এবারের স্বাধীনতা এনে দিয়েছে। বাংলাদেশ নতুন করে স্বাধীন হয়েছে তাদের রক্তের বিনিময়ে। এটি আমাদের জাতীয় জীবনে নতুন এক ইতিহাস, নতুন স্বাধীনতা। আমি তাদের স্মৃতির প্রতি অসীম শ্রদ্ধা জানাই।
জাগো নিউজ: বিগত সরকারের শাসনামলে আপনাদের রাষ্ট্রীয় কোনো গণমাধ্যমে দেখা যায়নি। কারণ কী?
বেবী নাজনীন: আমাকে গান গাওয়ার কোনো সুযোগই দেওয়া হয়নি। আমি সম্পূর্ণরূপে কালো তালিকাভুক্ত ছিলাম। দেশে কোথাও আমাকে গান গাইতে দেওয়া হয়নি। কোথাও আমাকে ডাকতো না। আমাকে গাইতে দিত না। আমি কোনো অনুষ্ঠানে গাইব শুনলে সেই অনুষ্ঠানও বন্ধ হয়ে যেতো। এমনও ঘটনা ঘটেছে, কোনো অনুষ্ঠানের জন্য কেউ অগ্রীম পারিশ্রমিক দিয়েছে, কিন্তু আমি সেখানে গাইবো জানার পর অনুষ্ঠান কর্তৃপক্ষকে বলা হয়েছে, আমাকে যেন সেখানে নেওয়া না হয়। ফলে আমাকে দেওয়া অগ্রীম পারিশ্রমিকও ফেরত দিতে হয়েছে। প্রতিনিয়ত এমন ঘটনা ঘটার পর আমি দেশ ছেড়েছি। আমি কোথাও অনুষ্ঠান করতে পারব না। আমি কোথাও যেতে পারবে না। এরপর আমি মনে করলাম আমার দেশে আমার স্বাধীনতা নেই। তাহলে আমার এখন কী করার আছে? আমি কি করে আমার সন্তান মানুষ করব? আমি কীভাবে আমার পরিবারকে রক্ষা করব। আমি বেঁচে থাকব কী করে? এগুলোই আমার দেশে না থাকার কারণ। আমি ১৬ বছর দেশে ছিলাম না। আমি আমার সন্তানকে মানুষ করার জন্য বিদেশে চলে গেছি। আমার সন্তানকে মানুষ করা জরুরি ছিল। আমার ছেলের নাম মহারাজ অমিতাভ সাইদ। সে এখন সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ার। ছেলের জন্য আমার বিদেশে যাওয়া জরুরি ছিল। চিন্তা করেছি আমি যদি এখানে থাকি, তাহলে আমার ছেলে হয়তো মানুষ হবে না। আমি হয়তো তার জন্য কিছুই করতে পারব না। এসব দুঃখ বুকে নিয়েই দেশ থেকে চলে যাই।
- আরও পড়ুন
- ‘রাজনীতির সঙ্গেই আছি’, বিমান থেকে নেমে আর যা বললেন বেবী নাজনীন
- দীর্ঘদিন পর দেশে ফিরছেন বেবী নাজনীন
জাগো নিউজ: একজন শিল্পী তো সবার। কিন্তু ভিন্ন মতের রাজনীতি করলেই সেই শিল্পীকে বঞ্চনার শিকার হতে হয়। বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখেন?
বেবী নাজনীন: আমরা শিক্ষিত মানুষ, মুর্খ না। এ কথা আমরা সহজেই বুঝি, সব কাজের উপলক্ষ হচ্ছে দেশকে ভালোবাসা। আমিও তাই বিশ্বাস করি। দেশের মানুষকে আমাদের ভালোবাসতে হবে। সেই মানুষের জীবনযাপনের মানের যদি উন্নয়ন না হয়, সামাজিক জীবনের যদি উন্নয়ন না হয়, সামাজিক জীবনে যদি মানুষ ভালো না থাকতে পারে, তাহলে সেটা কোন ধরনের উন্নয়ন?
জাগো নিউজ: আপনি যদি দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পান, তাহলে আপনি কী করতেন?
বেবী নাজনীন: যার যে প্রতিভা রয়েছে সেটাকে পরিচর্যা করতে হবে। সে যে পরিচয়েরই হোক না কেন। তাকে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। কাজ করার প্ল্যাটফর্ম দিতে হবে। সেই শিল্পী যদি সেসব পেয়ে ভালো কিছু করতে পারে, ভালোভাবে বেঁচে থাকতে পারে, নিজের পরিচিতি তৈরি করতে পারে। সে যেন একজন ভালো শিল্পী হয়ে উঠতে পারে, অন্য কিছু নিয়ে তাকে ভাবতে না হয়। তিনি দেশের সম্পদ হবেন। আর রাজনীতি তো বড় বিষয়। এটি একটি দর্শন। এটি সংস্কৃতিরও একটি অংশ। রাজনৈতিক সংস্কৃতি তো আরও বিশাল একটি বিষয়। এ নিয়ে শিক্ষার ব্যাপার রয়েছে, চর্চার ব্যাপার রয়েছে, মাঠপর্যায়ে কাজের ব্যাপার রয়েছে। এটি একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। আমি একে বলি, ‘ইটস আ লং রান গেইম’। রাজনীতিতে কোনো সংক্ষিপ্ত পথ নেই। একটা সময় রাজনীতি করতে করতে সে পরিণত হয়ে যাবে। তখন সে একটা দায়িত্ব নিলে সে সেটি পালন করতে পারবে।
জাগো নিউজ: অন্তর্বর্তী সরকার বলছে, সংস্কার হয়ে গেলে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করবে। আপনি কি নির্বাচনের জন্য মনোনয়ন চাইবেন?
বেবী নাজনীন: নির্বাচনের জন্য তো অবশ্যই মনোনয়ন চাইবো। নির্বাচন গণতন্ত্রের অন্যতম বিষয়। রাজনীতি করা মানে তো একটি প্ল্যাটফর্মের দিয়ে এগিয়ে যাওয়া। আমি তো জনসেবা করতে এসেছি। তাই জনসেবা করতে হলে রাজনীতি করতে হবে, নির্বাচনে অংশ নিতে হবে। ঘরে বসে বসে তো আর রাজনীতি করার কিছু নেই। মাঠে ময়দানে সক্রিয় হতে হবে। মানুষের জীবনের সাথে সম্পৃক্ত থাকতে হবে। জনগণের সঙ্গে মিশতে হবে। তাদের অবস্থান বুঝতে হবে। তাদের চাহিদার কথা বুঝতে হবে। তাদের কী প্রয়োজন সেগুলো সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে।
সংক্ষেপিত। বিস্তারিত দেখতে চোখ রাখুন জাগো নিউজের ডিজিটাল প্লাটফর্মে।
এমএমএফ/আরএমডি/জিকেএস