দুর্নীতির অভিযোগ থাকার পরও বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) প্রকৌশল বিভাগের সাবেক প্রধান হাবিবুর রহমানকে এক বছরের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিতে চেষ্টা চালিয়েছিল সংস্থাটি। মন্ত্রণালয়ের আপত্তি থাকায় তা আর সম্ভব হয়ে উঠেনি। ফলে গত ২২ মার্চ অবসরে যেতে বাধ্য হন তিনি।
তবে অবসরে গিয়েও হাবিবুর আবারও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করে দিয়েছেন। ইতোমধ্যে তিনি বেবিচকের কয়েকজন ঊধ্বর্তন কর্মকর্তা তাকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিতে তোড়জোড় শুরু করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। যদিও ২৫ মার্চ বেবিচকে বোর্ড সভা সিদ্ধান্ত হয়েছে যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ থাকবে তাদের নিয়োগ না দিয়ে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।
ইতোমধ্যে প্রকৌশল বিভাগের প্রধান হিসেবে তিন কর্মকর্তার নাম চূড়ান্ত করে একজনকে নিয়োগ দিতে সিদ্ধান্ত হয়। অথচ এই সিদ্ধান্ত অমান্য হাবিবুর রহমানকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টায় ক্ষোভ দেখা দিয়েছে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে। বিষয়টি নিয়ে বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে লিখিত অভিযোগ দেওয়া হয়েছে।
চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগ দেওয়ার বিষয়ে বেবিচকের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, বোর্ড সভায় হাবিবুর অবসরে যাওয়ার পর তিনজনের বিষয়ে অলোচনা হয়েছে। তারা হলেন- শহীদুল আফরোজ, মো. জাকারিয়া ও শুভাষীশ বড়ুয়া। তাদের মধ্য একজনকে নিয়োগ দিতে সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু বেবিচকের কয়েকজন কর্মকর্তা হাবিবুরকে আবারও এক বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। হাবিবুর বিভিন্ন মহলে দৌড়ঝাঁপ করছেন বলে আমরা তথ্য পেয়েছি। অভিযোগ আছে, আবারও নিয়োগ পেতে মোটা অংকের বাজেট করেছেন হাবিবুর। বোর্ড সভায় আলোচনার বিষয়টি আমাদের কাছে আইওয়াশ মনে হচ্ছে।
জানা গেছে, হাবিবুর রহমানের বিরুদ্ধে অনিয়মের বিস্তর অভিযোগ আছে। টেন্ডারের কাজ পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে ৫ লাখ টাকার ঘুষ নিয়েও কাজ না দেওয়ায় থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) হয়েছে। সম্প্রতি দুর্নীতির অভিযোগে পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সামরিক উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিকীসহ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) ১৯ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা হয়। ওই মামলায় বেবিচকের প্রধান প্রকৌশলী হাবিবুর রহমান ও সাবেক প্রধান প্রকৌশলী আবদুল মালেকের নাম রয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা কালবেলাকে জানান, আসামিরা যেন দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে না পারেন সেজন্য বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। হাবিবুর রহমানের চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ার কারণে আবারও দুই বছরে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেতে নানা মহলে দৌড়ঝাঁপ শুরু করে দিয়েছিলেন। গত ২৬ জানুয়ারি সংস্থাটির চেয়ারম্যানের কাছে আবেদনও করা হয়েছে। এ নিয়ে পুরো বেবিচকে তোলপাড় শুরু হয়। গত সরকারের আমলেও সংস্থাটির সাবেক প্রধান আবদুল মালেকের বিরুদ্ধেও দুর্নীতির অভিযোগ থাকায় দুদক তদন্ত করে। তার চাকরির মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে ম্যানেজ করে এক বছরের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ ভাগিয়ে নেন।
বিমান সচিবের কাছে লিখিত অভিযোগে বলা হয়েছে, দুদকের ৪ মামলার অন্যতম আসামি হাবিবুর রহমানকে সিএএবি'র প্রধান প্রকৌশলীর শূন্য পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের জন্য কালক্ষেপনের মাধ্যমে পদটি (শূন্য রেখে) অনৈতিক লিয়াজোঁ করা হচ্ছে। অথচ এ পদে পদোন্নতি পাওয়ার যোগ্যতা সম্পন্ন ছয় জন অভিজ্ঞ ও দক্ষ তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী এ সংস্থায় কর্মরত রয়েছে। যারা প্রত্যেকেই দুর্নীতিবাজ বিগত প্রধান প্রকৌশলী হাবিবুর রহমান থেকে অধীকতর কারিগরি ও পেশাগত জ্ঞান সম্পন্ন।
তথাপিও যোগ্যতা সম্পন্ন ছয় জন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর মধ্য হতে কাউকে প্রধান প্রকৌশলীর দ্বায়িত্ব প্রদান না করে কিছু কর্মকর্তা দুর্নীতিবাজ হাবিবুর রহমান সম্পর্কে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে মিথ্যা তথ্য প্রদানের মাধ্যমে কালক্ষেপণ করে তাকে এক বছরের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত যা পরিপূর্ণ ভাবে স্বার্থন্বেষী ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
প্রকৃতপক্ষে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের ৩য় টার্মিনাল প্রকল্প কাজের উদ্ধোধন আগামী অক্টোবর মাসে করার জন্য হাবিবুর রহমানকে সিভিল এভিয়েশনের প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে এক বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন মর্মে চেয়ারম্যান সিএএবি'র মাধ্যমে যে তথ্য উপস্থাপিত হয়েছে তা অসত্য, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, ভিত্তিহীন। কারণ দুদক কর্তৃক দায়েরকৃত ৩য় টার্মিনালের অর্থ আত্মসাৎ সংক্রান্ত দুর্নীতি মামলায় হাবিবুর একজন আসামি।
আসামিকে আবারও একই কাজে নিয়োগ প্রদান করা হলে আরও বেশি করে অর্থ আত্মসাতের সুযোগ পাবেন। প্রকল্পের অর্থ আত্মসাতে মনোনিবেশ করায় প্রকল্পের উদ্ধোধনের কাজ আরও বিলম্বিত হবে। প্রকল্পের ৯৯ দশমিক ৫ শতাংশ কাজ সমাপ্ত হয়েছে। অবশিষ্ট সামান্য কাজ সমাপ্ত করতে বিদ্যমান প্রকল্প পরিচালকই যথেষ্ট। হাবিবুর রহমানের প্রয়োজন হবে না। প্রকল্পের আওতায় যে ৫০০ এর অধিক ভ্যারিয়েশন হয়েছে তা চূড়ান্ত করার জন্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক সদস্য (অর্থ) এর সভাপতিত্বে একটি কমিটি করা হয়েছে। যাতে প্রকল্প পরিচালক ও প্রধান প্রকৌশলীও অন্তর্ভুক্ত আছেন। ফলে সদস্য অর্থ এর নেতৃত্বে গঠিত কমিটি কাজটি সমাধান করতে পারবেন।
গত ১১ জানুয়ারি উত্তরা পূর্ব থানায় করা একটি সাধারণ ডায়েরিতে উল্লেখ করা হয়, ২০২২ সালে ১৪ মে বেবিচকের প্রধান প্রকৌশলী হাবিবুর রহমানকে ঠিকাদারি কাজের জন্য অগ্রিম টাকা দেন। কাজ না দেওয়ার পাশাপাশি টাকা ফেরত না দিয়ে হাবিবুর রহমান তাকে ঘুরাতে থাকে। গত ৫ জানুয়ারি দক্ষিণখানের ‘একুশে ভোজ’ রেস্তোরাঁয় তাকে সামনে পেয়ে টাকা ফেরত চাইলে সে দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে ভয়ভীতি দেখিয়ে হুমকি দেয়।
গত ১২ জানুয়ারি প্রধান প্রকৌশলী হাবিবুর রহমানকে পাঠানো উকিল নোটিশে বলা হয়, হাবিবুর রহমান বেবিচকের পিঅ্যান্ডডি কিউএস সার্কেলে এসই পদে থাকাবস্থায় ৫ কোটি টাকার ঠিকাদারি কাজ দেওয়ার কথা বলে টাকা নিয়েছেন।
এ বিষয়ে হাবিবুর রহমানের বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।