ইতিহাসের পাতা উল্টালেই এক রহস্যময় নাম এসে ভেসে ওঠে চেঙ্গিস খান। কারো কাছে তিনি ধ্বংসযজ্ঞের আরেক নাম, ইতিহাসের ভয়ংকর খলনায়ক; আবার কারো কাছে তিনি অসাধারণ সংগঠক, দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়ক। তার সাম্রাজ্য বিস্তারের গল্প শুধু রক্তের নদী আর অগ্নিকুণ্ডের নয়, বরং আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার অনেক ভিতও তিনি গড়ে দিয়েছিলেন। তাই মৃত্যুর শত শত বছর পেরিয়ে গেলেও প্রশ্নটা আজও রয়ে গেছে...চেঙ্গিস খান আসলে কে ছিলেন? নায়ক, নাকি খলনায়ক?
চেঙ্গিস খানের নাম শুনলেই প্রথমে সামনে আসে ভয়, রক্তপাত আর ধ্বংসের দৃশ্য। ১৩শ শতকে তার নেতৃত্বে মঙ্গোল সেনারা এশিয়া থেকে ইউরোপ পর্যন্ত যে অভিযান চালায়, সেখানে লাখ লাখ মানুষ প্রাণ হারায়। শহর জ্বালিয়ে দেওয়া, কৃষিজমি ধ্বংস করা, নারী-শিশু পর্যন্ত রেহাই না পাওয়া এসবই তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের দীর্ঘ তালিকা।
চীনের উত্তরাঞ্চল থেকে শুরু করে মধ্য এশিয়া, এমনকি ইরান ও ইরাক পর্যন্ত বহু সভ্য নগরী মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেন তিনি। ইতিহাসবিদদের হিসাব অনুযায়ী, কেবল তার শাসনামলেই পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার আনুমানিক এক-দশমাংশ মানুষ নিহত হয়েছিল। এমন ভয়ের রাজনীতি ইতিহাসে বিরল। তাই স্বাভাবিকভাবেই পশ্চিমা দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি একজন রক্তপিপাসু খলনায়ক।
কিন্তু অন্যদিকে তাকালে দেখা যায়, তার মধ্যে লুকিয়ে ছিল আরেক রূপ। চেঙ্গিস খান ছিলেন অসাধারণ সংগঠক ও প্রশাসক। তিনি মেধাভিত্তিক পদোন্নতির সুযোগ তৈরি করেছিলেন। যেখানে জন্ম বা বংশ নয়, যোগ্যতাই ছিল আসল পরিচয়।
তার প্রচলিত আইন ‘ইয়াসা’ তখনকার সময়ে এক বিপ্লবী পদক্ষেপ। ডাকব্যবস্থা ও দ্রুত বার্তা পৌঁছে দেওয়ার জন্য তিনি ঘোড়সওয়ার কুরিয়ার সার্ভিস চালু করেছিলেন, যা অনেকটা আজকের ডাক বিভাগের মতো। সিল্ক রোডের বাণিজ্যপথ তিনি পুনরুজ্জীবিত করেন, যার ফলে পূর্ব-পশ্চিমের সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক দৃঢ় হয়।
ধর্মীয় ক্ষেত্রেও তিনি আশ্চর্য সহনশীল ছিলেন। বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, মুসলিম সবাই তার সাম্রাজ্যে নিজেদের ধর্ম পালন করতে পারতেন। আজকের ধর্মীয় স্বাধীনতার ধারণার সঙ্গে মেলাতে গেলে বিস্ময় জাগে।
এই দুই চেহারাই চেঙ্গিস খানকে ইতিহাসে এক রহস্যময় চরিত্রে পরিণত করেছে। একদিকে তিনি নির্মম সেনাপতি, যিনি শত্রুদের ধ্বংস করতে কোনো কুণ্ঠা বোধ করেননি। অন্যদিকে তিনি এমন এক রাষ্ট্রনায়ক, যিনি বিচ্ছিন্ন গোত্রগুলোকে এক ছাতার নিচে এনে বিশাল এক সাম্রাজ্য গড়েছিলেন। তাই প্রশ্নটা থেকেই যায় কোন রূপটাই আসল? নায়ক, নাকি খলনায়ক?
গবেষকরা বলছেন, তাকে কেবল খলনায়ক বা নায়ক একটি পরিচয়ে বাঁধা যায় না। তার কর্মকাণ্ডের ফলে যেমন ধ্বংস এসেছে, তেমনি এসেছে নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থার ধারণা। মৃত্যুর কয়েক শতক পরও তার প্রভাব বিশ্বরাজনীতিতে টের পাওয়া যায়। এমনকি আধুনিক জেনেটিক গবেষণায় দেখা গেছে, আজকের পৃথিবীতে কোটি মানুষের জিনে তার বংশধরত্বের ছাপ রয়ে গেছে। অর্থাৎ চেঙ্গিস খান শুধু ইতিহাস নয়, জীববিজ্ঞানেও রেখে গেছেন নিজের উপস্থিতি।
১২২৭ সালের আজকের ১৮ আগস্ট চেঙ্গিস খান মৃত্যুবরণ করেন। তবে কোন কোন তথ্যসূত্রে মৃত্যুর তারিখ ২৫ আগস্ট। চেঙ্গিস খান ৬৫ বছর বয়সে মারা যান। তখন চীনের জিয়া রাজ্যের বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছিলেন। তার মৃত্যু নিয়ে যুগে যুগে বিজ্ঞানীরা নানা ব্যাখ্যা দিয়েছেন। কেউ বলেছেন, ঘোড়া থেকে পড়ে মারা গেছেন। আবার কারো মতে, খোঁজাকরণের কারণে তিনি মারা যান। এছাড়া যুদ্ধরত অবস্থায় নিহত হন বলেও যুক্তি-প্রমাণ রয়েছে। তবে কোনোটিই সঠিক বলে প্রমাণ হয়নি।
সম্প্রতি লাইভ সায়েন্সের এক গবেষণায় জানা গেছে, বিখ্যাত এ নেতার মৃত্যুর কারণ ছিল সংক্রামক রোগ। তখন বুবেনিক প্লেগ রোগ মারাত্মক আকার ধারণ করেছিল। ৮ থেকে ৯ দিন জ্বরে আক্রান্ত থেকে চেঙ্গিস খান মারা যান। তিনি সংক্রামক ব্যাধিতেই মারা যান। তাকে হত্যা করা হয়নি বলে জানিয়েছেন গবেষকরা। তবে ইতিহাসে এ ঘটনা এখনো রহস্যময়।
চেঙ্গিস খানের মৃত্যুর পর থেকে ৮০০ বছর কেটে গেলেও হাজারো গবেষক তার হারানো সমাধির সন্ধান পাননি। মঙ্গোলদের ঐতিহ্য অনুযায়ী তাকে গোপনে সমাহিত করা হয়েছিল। এটি আজও অজানা এবং রহস্য হিসেবে থেকে গেছে।
তবে বিবিসি’র এক নিবন্ধে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, চেঙ্গিসের মৃত্যুর পরে তাকে ‘গোপনে দাফন করা হয়েছিল’। চেঙ্গিসের শোকাহত সেনাবাহিনী তার মরদেহ বাড়িতে নিয়ে যায়। যেখানে তাকে সমাধিস্থ করা হয়; সেখানে যাতে আর কেউ না যেতে পারে এজন্য সব সেনাদের হত্যা করা হয়।
সবশেষে চেঙ্গিস খানের সমাধির যেন কোনো প্রমাণ না থাকে; তাই সমাধির উপর ১ হাজার ঘোড়া নিয়ে ঘোড়সাওয়াররা দৌড়ায়। ওইসব ঘোড়সাওয়ারদেরও পরবর্তীতে হত্যা করা হয়েছিল। কোনো ধরনের প্রমাণই মেলেনি চেঙ্গিস খানের সমাধির।
তবে মৃত্যুর এত বছর পরেও বিতর্ক শেষ হয়নি। একদল ইতিহাসবিদ এখনো তাকে মনে করেন ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ংকর খলনায়ক হিসেবে; অন্যদিকে অনেকেই তাকে আধুনিক প্রশাসনিক ও রাষ্ট্রীয় ধারণার পথিকৃৎ হিসেবে দেখেন।
তার জীবনযাত্রা, যুদ্ধকৌশল, প্রশাসনিক দক্ষতা সবকিছু মিলিয়ে চেঙ্গিস খান এক জটিল ব্যক্তিত্ব। তাই তার মৃত্যু বার্ষিকীতে তাকে স্মরণ করার মানে কেবল তার মৃত্যু নয়, বরং সেই চিরন্তন প্রশ্নকে আবার সামনে আনা চেঙ্গিস খান আসলেই কে ছিলেন?
তথ্যসূত্র: এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা, দ্য সিক্রেট হিস্ট্রি অব দ্য মঙ্গলস, রিসার্চগেট, নেচার জেনেটিকস
কেএসকে/জিকেএস