মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীদের সর্বোচ্চ পদ মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা। সে পদে বহাল আমীর মো. জাহিদ ২০১৩ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত তিন বছর সরকারের মঞ্জুরি করা প্রেষণে (উচ্চশিক্ষার ছুটি) ছিলেন পিএইচডি (ডক্টর অব ফিলোসফি) ডিগ্রি নেওয়ার জন্য।
এরপর কেটে গেছে এক দশক। হুট করে গত আগস্ট মাসে তার পিএইচডি ডিগ্রির কপি চেয়েছে মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট প্রশাসন। এরপর বেড়িয়ে এসেছে থলের বিড়াল। ওই সময় একাডেমিক ক্ষেত্রে উচ্চশিক্ষার সর্বোচ্চ পর্যায়ের পিএইচডি স্বীকৃতি অর্জন করতে পারেননি এ মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা। মিথ্যা পিএইচডি উপাধি নিয়ে এখন ‘মহাবিপদে’ পড়েছেন তিনি।
- আরও পড়ুন
- পদ্মায় অবৈধভাবে বালু উত্তোলন বন্ধে শরীয়তপুরের ডিসিকে নোটিশ
- সরানো হলো জালাল উদ্দীনকে, মৃত্তিকার নতুন ডিজি সামিয়া সুলতানা
- নির্দেশিকা না ছাপিয়ে সরকারি টাকা তুলে নিয়েছে মৃত্তিকার সিন্ডিকেট
ঘটনা জানাজানির পর মৃত্তিকা সম্পদের মহাপরিচালক দুই দফা কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছেন আমীর মো. জাহিদকে। কিন্তু কোনো জবাব দিতে পারছেন না তিনি। অবশেষে বিষয়টি জানানো হয় কৃষি মন্ত্রণালয়কে। আমীরের অসদাচরণের বিরুদ্ধে এখন ব্যবস্থা নিতে চায় মৃত্তিকা সম্পদ প্রশাসন।
বিষয়টি নিয়ে এই মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জাগো নিউজ। তিনি পিএইচডি ডিগ্রি না নেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, তিনি ওই সময় পিএইচডি করেননি। ওই সময় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সঠিক সময়ে মন্ত্রণালয় থেকে প্রেষণে ছুটি না পাওয়ায় পিএইচডি করা সম্ভব হয়নি। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কোনো বৃত্তিও নেননি।
আমীর মো. জাহিদ জাগো নিউজকে আরও বলেন, ‘২০১২ সালে পিএইচডির জন্য ছুটি পাই। যার জন্য তার আগে তিন বছর আমাকে কৃষি মন্ত্রণালয়ে ঘুরতে হয়েছিল। আমার সেশন ছিল ২০০৮-০৯। তিন বছর পরে ছুটি পাওয়ার কারণে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আমাকে জানায়, আমি আর পিএইচডি করতে পারবো না।’
আমীর মো. জাহিদ বলেন, “ছুটি না পাওয়ার কারণে আমি ভিকটিম হয়েছি। তবে কখনো নামের আগে ‘ডক্টর’ উপাধি ব্যবহার করিনি। এবং এ সময়ের মধ্যে সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা থেকে যে মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হয়েছি-সেখানে কোথাও আমি সিভিতে পিএইচডি উল্লেখ করিনি। আমার অফিসের পার্সোনাল ডাটা শিটের কোথাও লেখা নেই সেটা।”
- আরও পড়ুন
- মৃত্তিকা অভিযানে উদ্ধার ৫০ কোটি টাকার খাস জমি
- পাহাড়ে চাষ শিখতে বিদেশে প্রশিক্ষণ, খরচ ৬০ লাখ
- ২৫ টাকায় করা যাবে ফসলি জমির মাটি পরীক্ষা
পিএইচডি না করেও মঞ্জুরিকৃত প্রেষণে বেতন-ভাতা নিয়ে সরকারি বিধান লঙ্ঘন প্রসঙ্গে মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা বলেন, ‘ছুটি নিলেই কি হয়? সবার কি পিএইচডি হয়? আমি কিছু গোপন রাখিনি। এ পর্যন্ত দশজন মহাপরিচালক এসেছেন। তারা জানতেন, তারা তো কোনো নির্দেশনা দেননি যে এটা করো। এজন্য সরকার এখন যা করার করবে, সমস্যা নেই।’
এই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘এখন ১০ বছর পরে এসে আমাকে হেয়প্রতিপন্ন করা হচ্ছে। আমি এর (কারণ দর্শানোর নোটিশ) উত্তর দেবো।’
সরকারি আইনে পিএইচডির ছুটি শেষে পিএইচডি ডিগ্রির কপি জমা দেওয়ার বিধান রয়েছে। ব্যর্থ হলে সেটাও জানাতে হয় সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮ অনুযায়ী। না হলে সেটি ‘অসদাচরণ’ হিসেবে গণ্য হবে, যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। যে কারণে ওই বিজ্ঞানীর বিরুদ্ধে বিভাগীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে চায় মৃত্তিকা সম্পদের প্রশাসন।
প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালক গত ২৭ আগস্ট এ কর্মকর্তাকে লিখিতভাবে নোটিশ দিয়ে সাতদিনের মধ্যে কারণ দর্শানোর নির্দেশ দেন। তবে তার কোনো জবাব আসেনি।
মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. বেগম সামিয়া সুলতানা জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিগত ১০ বছর এটা নিয়ে কথা বলা যায়নি। কারণ তিনি বিগত আওয়ামী লীগের তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের এলাকার মানুষ, সেই বলে তার প্রভাব খাটিয়েছেন। এখন আমরা ডিগ্রির সনদ চেয়েছি। কারণ তিনি ওই সময় ছুটি ভোগ করেছেন, বেতন নিয়েছেন। তবে তিনি আমাদের ডিগ্রির কপি দেননি। তারপরে কেন দিচ্ছেন না সেটা জানতে চেয়ে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিলেও তার কোনো জবাব দিচ্ছেন না। এটা আমরা লিখিতভাবে মন্ত্রণালয়ে জানিয়েছি।’
আগে-পরে সবসময় প্রভাবশালী জাহিদ
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আমীর মো. জাহিদ আওয়ামী লীগ পরিবারের সন্তান ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের ঘনিষ্ঠ হিসেবে ক্ষমতার দাপট দেখিয়েছেন সে সময়। চাকরির বিধিমালায় সর্বোচ্চ তিন বছর এক জায়গায় থাকার বিধান থাকলেও ১০ বছরেরও বেশি সময় তিনি ঢাকায় কর্মরত। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পরে তাকে রাজশাহী বদলি করা হলেও অদৃশ্য ক্ষমতায় ১০ মাস পরে ফিরে এসেছেন ঢাকায়। এখন তার বিরুদ্ধে প্রধান কার্যালয়ে অস্থিরতা, বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা সৃষ্টির অভিযোগ করছেন অনেকে।
এসব বিষয়ে আমীর মো. জাহিদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘এই ডিজি (মহাপরিচালক) আমার পেছনে লেগেছেন। আমি ঢাকায় বদলি হয়ে আসার পরে তিনি মনে করেন তার পদে আমি বসবো। সে জন্য নাকি তার বুকে ব্যথা হয়।’
অন্যদিকে, মহাপরিচালক ড. বেগম সামিয়া সুলতানা বলেন, ‘তার (আমীর মো. জাহিদ) পিএইচডি ডিগ্রির সনদ চাওয়ার পরে তিনি দুষ্টচক্র তৈরি করে মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের কর্মপরিবেশ নষ্ট করছেন। আমি সুষ্ঠুভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছি না। তিনি ও তার সঙ্গে কিছু লোক এখন প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে, আমাকে সরিয়ে দিতে চেষ্টা করছেন।’
এনএইচ/এসএনআর/এমএমএআর/এমএফএ/জিকেএস