শৈশবে আমরা মজার একটা খেলা খেলতাম। কেউ কেউ এই খেলাকে চোর পলান্তি নামে ডাকতো। ৮-১০জন শিশু বৃত্তাকারে দুই তিন ফুট দূর দূর দাঁড়াতো। একজন থাকতো বৃত্তের মধ্যবিন্দুতে। মাঝখানের খেলোয়াড়কে বৃত্ত ভেদ করে বেরিয়ে যেতে হতো। মাঝখানের খেলোয়াড় যখন ফাঁক খোঁজার জন্য এদিক ওদিক তাকাতো তখন বৃত্তাকারে দাঁড়ানো খেলোয়াড়রা সমস্বরে চিৎকার করতো-কোন দুয়ার দিয়া যাবিরে বেতের বারি খাবি রে। কৌশলে মাঝের খেলোয়াড় বৃত্ত ভেদ করে বেরিয়ে যেতে পারলে বিজয়ী হতো। আর যদি ধরা পড়ে যেতো তাহলে হালকা উত্তম-মাধ্যম জুটতো কপালে। গ্রামীণ এই খেলার সাথে আজকের প্রজন্মের অনেকেরই পরিচয় থাকার কথা নয়। যারা জানেন তাদের মনে করিয়ে দেওয়া এবং যারা জানেন না তাদেরও খেলার সঙ্গে এই মুহূর্তের বাংলাদেশের পরিস্থিতি মিলিয়ে দেখার অনুরোধ করছি।
বৃদ্ধ বয়সে এসে সেই খেলাটার কথা খুব মনে আসছে। আর মনে হচ্ছে, সেই খেলোয়াড়রা এখন কেউ আর শিশু নেই। শক্তপোক্ত কিশোর তরুণ কিংবা আমার মতো বৃদ্ধ সবাই। উল্লিখিত চোরপলান্তি খেলার মাঝখানে থাকতো একজন খেলোয়াড়। এখনকার এই খেলায় মাঝখানে ১৮ কোটি মানুষের অন্তত সাড়ে ১৭ কোটি জন। তাদের চারদিকে ঘিরে আছে মব সৃষ্টিকারী, সন্ত্রাসী, ছিনতাইকারী, ঘুসখোর, সুদখোরজাতীয় একেকটি উপদ্রব। সমস্বরে তারা আওয়াজ তুলছে-কোন দুয়ার দিয়া যাবি রে।
শৈশবের খেলায় চোর বেটাকে মেকি মারপিট করা হতো। পরাজিত খেলোয়াড় উহ্ আহ করতো খেলার ছলে। এখনকার খেলায় উহ্ আহ করার সুযোগও নেই। যদিও মুখে মুখে বাকস্বাধীনতার কথা বলা হয়। বৃত্তবন্দি মানুষের কথা বলার জন্য যে সাংবাদিকরা কথা বলতো তাদের জীবনই বিপন্ন এখন। তাদেরই প্রাণ হারাতে হয় অপঘাতে।
সাংবাদিক বিভুরঞ্জন সরকারের লাশ ভেসেছিল মেঘনায়। এবার খুলনায় রূপসা নদীতে ভাসতে দেখা গেলো আরেক সাংবাদিক ওয়াহিদ-উজ-জামান বুলুর লাশ। এমন নৃশংস ঘটনাও তলে পড়ে যায় মৃত্যুশঙ্কার কারণে। অনিশ্চয়তা, অনিরাপত্তা দানা বেঁধে উঠেছে সারা বাংলায়। শিক্ষাঙ্গনে অস্ত্রের ঝনঝনানি, সন্ত্রাস, ছিনতাই শব্দগুলো এখন হারিয়ে যাচ্ছে মব আর হামলার কাছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যেখানে নাগরিকের নিরাপত্তা দেওয়ার কথা, সেখানে তাদের বিরুদ্ধেই অভিযোগ আসে রাজনৈতিক নেতাদের ওপর সশস্ত্র আক্রমণের।
সাংবাদিক বিভুরঞ্জন সরকারের লাশ ভেসেছিল মেঘনায়। এবার খুলনায় রূপসা নদীতে ভাসতে দেখা গেলো আরেক সাংবাদিক ওয়াহিদ-উজ-জামান বুলুর লাশ। এমন নৃশংস ঘটনাও তলে পড়ে যায় মৃত্যু শঙ্কার কারণে। অনিশ্চয়তা, অনিরাপত্তা দানা বেঁধে উঠেছে সারা বাংলায়। শিক্ষাঙ্গনে অস্ত্রের ঝনঝনানি, সন্ত্রাস, ছিনতাই শব্দগুলো এখন হারিয়ে যাচ্ছে মব আর হামলার কাছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যেখানে নাগরিকের নিরাপত্তা দেওয়ার কথা, সেখানে তাদের বিরুদ্ধেই অভিযোগ আসে রাজনৈতিক নেতাদের ওপর সশস্ত্র আক্রমণের।
গণঅধিকার পরিষদের প্রধান ও ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুরকে আইসিইউতে পাঠানো হয় পিটিয়ে, এই অভিযোগটা ইউনিফরমধারীদের বিরুদ্ধেই। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও পাশের গ্রাম জোবরায় রীতিমতো যুদ্ধকাণ্ড দেখছে মানুষ। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলা-পাল্টা হামলায় তটস্থ ক্যাম্পাস। চুয়েটের শিক্ষার্থীরা রাজপথে হুংকার ছেড়েছে কদিন আগেও। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাও উত্তপ্ত হয়ে আছে অসন্তোষে। এর আগে বুয়েটসহ সব প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রাজপথ কাঁপিয়ে ঢাকা শহর অচল করে দিয়ে হুলুস্থুল কাণ্ড ঘটিয়েছে তাদের কিছু দাবি আদায়ের লক্ষ্যে। ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স শিক্ষার্থীরাও পাল্টা শক্তি প্রদর্শন করেছে রাজধানীসহ নানা স্থানে। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সামাজিক অস্থিরতা আত্মহত্যার মতো ঘটনা দেশকে নরকপুরীতে পরিণত করেছে। একাধিক আত্মহত্যার কারণ হিসেবে জানা গেছে ঋণের কিস্তি দিতে অপারগতা। কেউ কেউটা কারও নিকটজন আত্মহত্যা করলে হয়তো প্ররোরচনাকারীর তল্লাস হতো। ঋণগ্রস্ত গরিব মানুষ কিংবা সাংবাদিকের আত্মহত্যার প্ররোচনাকারীর খোঁজ করবে কে?
সরকার ব্যস্ত সংস্কার নিয়ে, রাজনৈতিক দলগুলো ব্যস্ত নির্বাচন নিয়ে, জনগণের ঘাম ঝরছে দুর্মূল্যের বাজারে সংসারের ঘানি টানতে। মা-বাবাকে দোয়া ইউনূস পড়তে হয় প্রতিদিন সন্তানকে স্কুল-কলেজে পাঠিয়ে। আতঙ্কে কাটাতে হয়, তাদের সন্তান ফিরবে তো নিরাপদে? সুতরাং কে কোথায় কীভাবে মরল কার খবর কে রাখে?
অন্যদিকে কথায় কথায় যমুনা অভিমুখে যাত্রা করে মানুষ। যমুনা যেন এখন বাঁশের সাঁকো দিয়ে পারাপারের সরু খাল। কথায় কথায় রাজপথ অবরোধ, এই অস্থিরতা কেন? দমন নয়, মানুষের ক্ষোভ নিরসনের পদক্ষেপগুলো কি? চোখে পড়ে কি সরকারি চেষ্টার? মাঝে মাঝে চোখে পড়ে সরকারই স্বীকার করে নিচ্ছে- ব্যর্থতার কথা। যেমন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা প্রকাশ্যেই বললেন, শুধু ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শাসনামলের ১৩ মাসে ১,৬০৪ বার অবরোধ হয়েছে সড়কে। হিসাব করলে দৈনিক চারটির বেশি অবরোধ। কল্পনা করা যায়! কী পরিমাণ উচ্ছৃঙ্খল পরিস্থিতি বাংলাদেশের? কারা করছে এই অবরোধ?
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাই তথ্য দিয়েছেন,১,৬০৪ বার অবরোধ করেছে ১২৩টি প্রতিষ্ঠান। কী ভয়াবহ অবস্থা। এরা কারা? এই মুহূর্তে দেশে বিরোধী দল নেই। প্রতিটি রাজনৈতিক দলই ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সহযোগিতার কথা বলে। এরা প্রত্যেকেই জুলাই অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী, সমর্থনকারী এমনকি অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী সংগঠন। লক্ষণীয় হচ্ছে- উল্লিখিত ১২৩টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে হয়তো ৫-১০টিও নেই রাজনৈতিক দলের।
কতটা ভয়াবহ জননিরাপত্তা পরিস্থিতি ভাবা যায়? আইন ও সালিশ কেন্দ্র বলেছে, জানুয়ারি থেকে জুলাই এই ছয় মাসেই মব সৃষ্টি মাধ্যমে গণপিটুনিতে হত্যা করা হয়েছে ১০৩জন মানুষ। অথচ মাত্র কয়েক বছর আগেও ২০২১ সালের একটি পরিসংখ্যান পাওয়া যায় পুরো এক বছরে গণপিটুনিতে মারা গিয়েছিল ২৯ জন মানুষ।
এর শেষ কোথায়? জনমানুষের দুর্ভোগে রাজনৈতিক দলগুলো সোচ্চার হয়। তারা রাজপথে নামে। এখন দেখা যাচ্ছে এই দাবিতে রাজপথে তারা নেই। তারা সবাই প্রাসাদমুখী। তাদের সামনে একমাত্র লক্ষ্য সিংহাসন। খেয়াল করলে দেখা যাবে-প্রতিটি রাজনৈতিক দল নির্বাচনের দাবিতে সোচ্চার। একটি পক্ষ বলছে,দ্রুত নির্বাচন দিতে হবে। আরেকটি পক্ষ বলছে, সংস্কারের আগে নির্বাচন নয় কিংবা বলছে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ছাড়া নির্বাচন হতে পারে না। কিন্তু উভয় পক্ষই বলছে নির্বাচনের কথা। যে নির্বাচন মাধ্যমে তাদের সিংহাসন লাভ হতে পারে।
প্রধান উপদেষ্টা বার বার বলছেন, আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধেই হবে নির্বাচন। রাজনৈতিক দলগুলো বিশ্বাস করতে পারছে না প্রধান উপদেষ্টার এই ঘোষণা। অন্যপক্ষ সরাসরি বলছে-ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে না। প্রধান উপদেষ্টা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কদিন পর পর বসছেন নির্বাচন প্রসঙ্গে কথা বলতে। সংস্কার প্রসঙ্গে কথা বলতে। জুলাই সনদে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা নিয়েও সিরিজ মিটিং করেছেন রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে। যাতে আবার অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও বর্তমান শাসনব্যবস্থা নির্দেশাবলি, জুলাই অভ্যুত্থানের আইনি নিশ্চয়তার বিষয় থাকে।
সর্বশেষ ৩১ আগস্ট বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপির সঙ্গে বৈঠক করে প্রধান উপদেষ্টা তাদের নিশ্চয়তা দিলেন ফেব্রুয়ারিতেই হবে নির্বাচন। বলার অপেক্ষা রাখে না এসব বিষয়ও সরকারের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু যাদের লক্ষ্য করে এই পদক্ষেপ সেই জনগণের মূল্য কতটুকু রাজনৈতিক দল ও সরকারের কাছে? চরম অবনতি ঘটার পরও আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে কোনো পরামর্শ সভার আয়োজন হতে দেখা যায় না সরকারের। রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নিরাপত্তায় যখন বিঘ্ন হয় তখন বলে, শেখ হাসিনার নিয়োগ করা পুলিশ নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। ১৩ মাস পরও এমন বাহানা কতটা গ্রহণযোগ্য।
পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে সরকারের দূরত্ব স্পষ্ট হয়ে যায়, দায়িত্বশীলদের কথা-বার্তায়ও। অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনকভাবে এখানে সেনাবাহিনীর প্রসঙ্গও চলে আসে। একটি রাজনৈতিক দলের অন্যতম এক নেতা সেনাবাহিনীকে লক্ষ্য করে আক্রমণাত্মক বক্তব্য দিয়ে মানুষকে আতঙ্কে ফেলে দিচ্ছেন, এমন অভিযোগও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার পায়। বিভিন্ন মাধ্যমে সেনাবাহিনীকে দেশরক্ষার পরিবর্তে পুলিশের ভূমিকা পালনে নিয়োজিত করার প্রসঙ্গও আলোচনায় আসে। দেশের সার্বভৌমত্বের প্রতীক সেনাবাহিনীকে বিতর্কিত করার বিষয়টিও মানুষের প্রশ্নের মুখে পড়েছে।
সব মিলে যখন চরম হতাশাজনক অবস্থা, এমন সময় একটি সংবাদ নজর কেড়েছে অনেকেরই। সেনাবাহিনী প্রধান দেখা করেছেন প্রধান উপদেষ্টা, প্রধান বিচারপতি ও রাষ্ট্রপতির সঙ্গে। লক্ষণীয় যে সেনাপ্রধান দীর্ঘদিন পর রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করেছেন। সশস্ত্রবাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসেবে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করাটা সেনাপ্রধানের জন্য রুটিন ওয়ার্ক হলেও দীর্ঘ বিরতি এবং চলমান পরিস্থিতির কারণে কৌতূহল জাগায় স্বাভাবিক কারণেই। তবে তাঁর সাক্ষাতের উদ্দেশ্য সম্পর্কে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পর্কে আলোচনা হয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। এর পেছনে আর কোনো রাজনৈতিক কারণ আছে কি না মানুষের জানার আগ্রহ অন্তত এই মুহূর্তে নেই। কারণ জীবনের নিরাপত্তাহীনতা থেকে তারা মুক্তি চায়। সেই যে চোরপলান্তি খেলার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা খেলোয়াড় বৃত্ত ভেঙে মুক্তি চায়। মানুষও এখন তেমনটাই চায়-ছিনতাই, ডাকাত, মব সন্ত্রাস ইত্যাদিতে ঘেরাও থেকে আত্মরক্ষার সুযোগটি তাদের যেন দেওয়া হয়।
লেখক : সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক।
এইচআর/এমএফএ/এএসএম