শান্তির জগৎ থেকে কঠিন পৃথিবীতে আসার সঙ্গে সঙ্গে কান্না জুড়ে দিল ‘জন্ম’, এই গল্পের প্রোটাগনিস্ট, মুখ্যচরিত্র। তার শ্বাসযন্ত্র খুলে গেলো। ফুসফুসের মাধ্যমে অক্সিজেন মিশে গেলো রক্তের সঙ্গে। রক্তের আরেক উপাদান হিমোগ্লোবিন অক্সিজেনকে পাকড়াও করে দ্রুত পৌঁছে দিল মস্তিষ্কে, স্নায়ুকোষের অরণ্যে। জ্বালানি পেয়ে ব্রেন সতেজ হয়ে উঠলো। খাদ্যের জন্য এবার বেপরোয়া ‘জন্ম’ আঁকড়ে ধরল মায়ের স্তন, শুষতে লাগল বোটা। গ্লুকোজ পেয়ে আরও সজীব হয়ে উঠল সে। পিটপিট করে তাকাল মায়ের মুখের দিকে। মা-ও তাকাল। পৃথিবীর শুদ্ধ আর মৌলিকতম মায়ার বাঁধনে আটকে গেল উভয়ে।
মা বলল, ‘সুস্থ থাকো, বেঁচে থাকো বাবা।’
‘জন্ম’ আরও জোরে আঁকড়ে ধরল মাকে। আবার তাকাল মায়ের মুখের দিকে। যেন মায়ের মুখ থেকে নয়, স্বর্গ থেকে ছুটে এলো মায়াময় অন্য আলো। চোখ ভরে তা টেনে নিলো, মন ভরে গেলো আনন্দে।
হঠাৎ মাথা ঘুরিয়ে পেছনে তাকানোর চেষ্টা করল ‘জন্ম’। কেউ, অবিকল সে-হয়ে পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। ছায়ার মতো কিন্তু ছায়া নয়, ধোঁয়ার মতো, ধোঁয়ার কুণ্ডলীও নয়, হুবহু নিজের মতো একজনকে আবিষ্কার করে প্রশ্ন করল,
‘কে তুমি?’
‘আমি তোমার তুমি। তুমি-হয়ে তুমি জন্মেছ এই কঠিন জগতে আর আমি-হয়ে আমি জন্মেছি তোমার সঙ্গে।’
‘এসব প্যাঁচানো কথা বাদ দাও। আসল কথা বলো, কে তুমি, কী নাম তোমার?’
খাদ্যের জন্য এবার বেপরোয়া ‘জন্ম’ আঁকড়ে ধরল মায়ের স্তন, শুষতে লাগল বোটা। গ্লুকোজ পেয়ে আরও সজীব হয়ে উঠল সে। পিটপিট করে তাকাল মায়ের মুখের দিকে। মা-ও তাকাল। পৃথিবীর শুদ্ধ আর মৌলিকতম মায়ার বাঁধনে আটকে গেলো উভয়ে।
“আমার নাম ‘মৃত্যু’। তোমার জন্মের সঙ্গে সঙ্গে আমারও জন্ম হয়েছে সঙ্গীরূপে। আমিও পথ চলব তোমার পিছু পিছু।''
'অসম্ভব। আমি মৃত্যুকে সঙ্গী হিসেবে চাই না, অনন্তকাল বেঁচে থাকতে চাই, কেবল এগিয়েই যেতে চাই।'
'আমাকেও তোমার সঙ্গে এগোতে হবে। এ বিধান লঙ্ঘনের যে কোনো উপায় নেই, বন্ধু।'
'না। আমাকে ছেড়ে যাও। আমার সঙ্গী হোয়ো না তুমি।'
চুপ হয়ে গেলো মৃত্যু।
'চুপ করে আছ কেন?' অধৈর্য হয়ে প্রশ্ন করল 'জন্ম'।
'বেঁচে থাকার আকুলতা দেখে আমারও মায়া হচ্ছে তোমার জন্য। তবে একটা উপায় আছে। সেটা মানলে তুমি অনন্তকাল বেঁচে থাকতে পারবে।'
'কী সে উপায়? দ্রুত বলো।'
'আমাকে সব সময় বন্ধু ভেবো। সহযাত্রী ভেবো। তাহলে ভালো ভালো কাজ করতে তুমি ভেতর থেকে বাধ্য হবে, উদ্বুদ্ধ হবে। তোমার সৃষ্টিশীল ভালো কাজই তোমাকে বাঁচিয়ে রাখবে অনন্তকাল, ইতিহাসে।'
'কিন্তু ভালো কাজ করেও তো অনেকেই পৃথিবীতে খলনায়ক হিসেবে পরিচিত হয়েছে। একদলের কাছে যা ভালো, তা তো অন্য দলের কাছে খারাপ। মানুষের মধ্যেই তো ঐকমত্য নেই। একদল ভালো বলছে তো অন্যদল খারাপ বলছে, একজন মহান বলছে তো অন্যদল বদ উপাধি দিচ্ছে।'
'এসব বিভাজনের দুর্বলতা ফুঁড়ে আসল সত্য বেরিয়ে আসেই। সময়-ই আসল নায়ক। সেই নায়কই ধরিয়ে দেয় কে ভালো কাজ করেছে, কে করেনি।'
'তাহলে কি তুমি বলবে মানুষ ভুল করে, করতে পারে?'
'অবশ্যই করে। তবে আসল বিচার করবেন যিনি তিনি আছেন সবার উপরে। সেই মহান বিচারকের কথাও মনে রাখতে হবে। তাহলে খারাপ কাজ থেকে সবাই দূরে থাকবে। আমি-হয়ে তুমি একসঙ্গে চলে গেলেও থেকে যাবে তোমার ভালো কাজ। সে-কাজ যুগে যুগে মানুষ স্মরণ করবে। কাজের মাধ্যমেই তুমি বেঁচে থাকবে, থাকতে পারবে অনন্তকাল।'
শান্ত হলো না জন্মের মন। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে মায়াময় জগৎটাকে পুরে নিলো দু‘চোখ ভরে। তারপর বলল, 'তোমারও সহচর আছে, মা? তোমাকেও কি তার সঙ্গী হতে হবে? আমাকে ছেড়ে চলে যাবে?'
'তোমার সহচর মৃত্যু তোমাকে যা বলেছে তা পুরোপুরি ঠিক নয়, আবার ঠিকও। তবে জেনে রাখো আমার দেহ চলে গেলেও তুমি আমার আত্মার ভেতরে, এখন যেমন আছ, তেমন হয়েই থাকবে। আমার আশীর্বাদ সবসময় থাকবে তোমার জন্য। ভালো কাজই করে যেয়ো তুমি। কে কী বলল, না-বলল, মর্যাদা পেলে কি পেলে না, এসব নিয়ে ভেবো না। মনে থাকবে?'
মায়ের সঙ্গে কথা বলে আবার পেছনে তাকালো জন্ম।
ছায়াটাকে দেখতে পেল না। কী আশ্চর্য! মন খুশি হওয়ার কথা। হলো না। বরং বেপরোয়া হয়ে প্রশ্ন করল, “তুমি তো আমাকে ‘বন্ধু বলে সম্বোধন করেছিলে, এখন কোথায় পালিয়ে গেলে? দেখতে পাচ্ছি না কেন তোমাকে, বন্ধু?”
উত্তর নেই। সংকেত নেই, সাড়াও নেই মৃত্যুছায়ার।
‘কথা বলো, চুপ করে আছ কেন?’ ধমক দিল জন্ম।
‘ওর কোনো তাড়া নেই এখন। বন্ধু ভেবে ওকে জয় করে ফেলেছ তুমি। ভবিষ্যতেও নিশ্চয়ই তুমি আরও অনেক ভালো কাজের জয় ছিনিয়ে আনবে, মনে হয়েছে আমার।’
নতুন কণ্ঠস্বর শুনে চমকে উঠে জন্ম প্রশ্ন করল,
‘তুমি আবার কে? এত ভরাট গলায় কে কথা বলছ? তুমি তো আমার বন্ধু, মৃত্যুছায়া নও!’
'ঠিক ধরেছো। আমি মৃত। আমার জীবনকাল ছিল ১৮৮৯ থেকে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত। আমি একজন ফরাসি কবি। আমার নাম জঁ ককতো। আমি একটি বই লিখেছিলাম ১৯৫০ সালে, Orphee। পরে এটি থেকে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছিল। জন্ম-মৃত্যুর বিষয়ে বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছিলাম, নিজেকে খোঁজার চেষ্টা করেছিলাম। এই মুহূর্তে তোমার আর মৃত্যুর সংলাপ আমার আত্মায় সংকেত পাঠিয়ে দিয়েছে।'
‘মৃত হয়েও কীভাবে এলে আমার কাছে? কীভাবে বুঝলে আমি জয়ী হব ভবিষ্যতে?’ ভালো কথা শুনে ককতোকে অসম্মান না করে, দৃঢ়তার সঙ্গে পাল্টা প্রশ্ন করল জন্ম।
‘যে মৃত্যুকে বন্ধু ভাবতে পারে, মৃত্যুর কথা ভুলে যায় না, সে জয়ী হয়। এটা ইতিহাসের শিক্ষা। কেবল আমার কথা নয়। কথাটা বলার লোভ সামলাতে পারিনি। তাই অলৌকিক ক্ষমতা বলে চলে এসেছি।’
আবার মায়ের মুখের দিকে তাকাল জন্ম। কিছুটা শান্তভাবে জিজ্ঞেস করল, 'ও কি ঠিক বলেছে, মা?'
'আমাদের ধর্মেও এমন কথা বলা আছে, নানাভাবে।'
মায়ের উত্তর পেয়ে আবার পেছনে তাকাল 'জন্ম'।
দেখল ঘন ছায়াটা আরও ঘন হয়ে আরও কাছে ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। ভয় না পেয়ে জন্ম হেসে দিল মৃত্যুর দিকে তাকিয়ে। প্রশ্ন করল, ‘পালিয়ে গিয়েছিলে কেন?’
‘বুঝে গেছি তুমি সত্যিকারভাবে আমাকে গ্রহণ করেছ, বন্ধু ভেবেছো। তাই আবার তোমার পাশে চলে এসেছি। এখন আবার আমরা একসঙ্গে পথ চলব। থাকব তোমার পেছনে।’
লেখক : মনোচিকিৎসক, কথাসাহিত্যিক।
এইচআর/এমএফএ/জেআইএম