দয়াগঞ্জের ভোর। বাজারের কোণায় ভেজা মাটির গন্ধে মিশে আছে তাজা মাছের ঘ্রাণ। ডালা ভরে শোল, টাকি, মাগুর, চিংড়ি-সবই যেন গ্রামবাংলার স্রোতভরা দিনের স্মৃতি বয়ে এনেছে। মানুষ ভিড় করছে, দরদাম চলছে, কেউ কেউ চোখ বুলিয়ে খুঁজছে ‘দেশি মাছ’-যার স্বাদে থাকে শৈশবের নদী, বিলের কাদা, গ্রামের রোদ। কিন্তু এই ভরা বাজারের আড়ালে লুকিয়ে আছে এক শূন্যতা। কারণ এই মাছ এসেছে এমন সব জলাশয় থেকে, যেগুলো এখন শুকিয়ে গেছে-যেখানে পানি নেই, স্রোত নেই, কেবল ফেটে যাওয়া কাদামাটি আর নিঃশব্দ মৃত্যু।

বর্ষার পরে এমন দৃশ্য নতুন কিছু নয়, কিন্তু এবার একটু ভিন্ন-কারণ এই মাছগুলো এসেছে শুকিয়ে যাওয়া খাল-বিল-নদী-নালা থেকে, শহরের বাজারে এনে দিয়েছে গ্রামীণ জীবনের রেশ।
পানি কমে যাওয়ায় গ্রামাঞ্চলের ছোট ছোট জলাশয়ে মাছ ধরা এখন অনেক সহজ। যেসব খাল একসময় স্রোতের গানে মুখর ছিল, আজ সেখানে কেবল পলির স্তর, শুকনো কাদা আর নিচু গর্তে আটকে পড়া মাছ। স্থানীয় জেলেরা সেই গর্তেই ফাঁদ পেতে, জাল টেনে, ডালা ভরে তুলছেন মাছ। একসময় এই মাছ ছিল তাদের সংসারের আহার, এখন তা শহুরে চাহিদা মেটানোর পণ্য।

রাজবাড়ী, গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর কিংবা মাদারীপুর-এসব অঞ্চলের গ্রামীণ বাজারে এখন ছোট-বড় নানা জাতের মাছ ধরা পড়ছে: শোল, টাকি, মাগুর, কৈ, শিং, চিংড়ি, এমনকি ছোট পুঁটিও। কৃষিকাজের ব্যস্ততা কমে যাওয়ায় গ্রামের মানুষ জাল নিয়ে নেমেছেন শুকিয়ে যাওয়া বিলের কাদা মাটিতে।

তাদের সেই মাছ এখন দয়াগঞ্জ, কারওয়ানবাজার, শ্যামবাজার কিংবা মিরপুরের হাটে জমজমাট বেচাকেনায় রূপ নিচ্ছে। ভোর থেকেই ট্রাক, ভ্যান, ঠেলাগাড়িতে ভরে আসছে মাছ। শহুরে ক্রেতারা ভিড় করছেন-কারণ এই মাছের স্বাদ অন্যরকম, প্রাকৃতিক, দেশি, নদীর ঘ্রাণ মিশে থাকে তাতে।

দয়াগঞ্জের বাজারে এখন টাটকা মাছের গন্ধ, হাঁকডাক আর দরদামের শব্দ। ক্রেতারা উৎসাহী-কেউ বলছে, ‘এই রুইটা নদীর না বিলের ‘ কেউ আবার চোখ মেলে খুঁজছে শোল বা চিংড়ি। শহরের মানুষ আনন্দে এই মাছ কিনছে, কিন্তু যারা তা ধরছে-তাদের চোখে অন্য বাস্তবতা। জল কমে যাওয়ায় তারা জানে, আগামী বছর হয়তো এই পেশা থাকবে না। জেলেদের মুখে হাসি আছে, কিন্তু সেই হাসির ভেতরে লুকিয়ে আছে অনিশ্চয়তা।

প্রতিটি শুকিয়ে যাওয়া খাল-বিল শুধু পানি নয়, হারায় জীবন। স্থানীয়ভাবে পানি সংরক্ষণ, খাল পুনঃখনন, এবং প্রাকৃতিক জলাধার রক্ষা এসব উদ্যোগ এখন সময়ের দাবি। সরকার ও নাগরিক সমাজ একত্রে না এলে ভবিষ্যতে ‘দেশি মাছ’ কেবল স্মৃতির স্বাদে সীমাবদ্ধ হয়ে যাবে।

দয়াগঞ্জের সকালবেলার বাজারের গন্ধে, কাদা মাটির রঙে, জেলের কণ্ঠে এখনো লেগে আছে বাংলাদেশের প্রকৃত চিত্র-জল, মাছ আর জীবনের মিলেমিশে থাকা সৌন্দর্য। কিন্তু সেই জল যদি হারিয়ে যায়, তখন কি শুধু মাছ, নাকি হারিয়ে যাবে এক টুকরো সংস্কৃতিও?
জেএস/

                        1 day ago
                        7
                    








                        English (US)  ·