খুলনার ডুমুরিয়ায় মাধবকাটি বিলপাটিয়ালা সরকারি প্রাইমারি স্কুলটি গত দুই মাস ধরে পানিতে ভাসছে। কোমর সমান পানিতে ভাসছে বিদ্যালয়টির বেঞ্চ-টেবিলসহ গুরুত্বপূর্ণ আসবাবপত্র। কমতে কমতে অবশিষ্ট ৫৫ শিক্ষার্থীকে নিয়ে একটি মুরগির ফার্মে পাঠদান করছেন শিক্ষকরা। কিন্তু সেখানে যাওয়ার জন্য নৌকা না থাকায় অনেক শিক্ষার্থীকেই স্কুলের সামনে জমে থাকা পানিতে সাঁতার কাটতে দেখা গেছে।
শুধু এই বিদ্যালয়টি নয় খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার ৩টি ইউনিয়নের প্রায় তিন লাখ মানুষ এখন জমে থাকা পানিতে ভাসছে প্রায় তিন মাস ধরে। সরকারি আবাসন প্রকল্পের ভূমিহীন মানুষগুলো এখন পানির নিচে ডুবে মরার অবস্থা হয়েছে।
তাদের অনেকের কাঁচা ঘরবাড়ি ধসে পড়ছে। মানুষের থাকার জায়গা নেই, রান্নার জায়গা নেই, স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগার নেই। চারদিকে পানি থইথই করছে। পুকুর ডুবে গেছে, ঘেরের মাছ ভেসে গেছে। ক্ষেতের সবজি মরে সাদা হয়ে গেছে। মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় খুঁজছে। শুধু মাধবকাটি ও বিলপাটিয়ালা গ্রাম নয়, এমন করুণ চিত্র খুলনার সবচেয়ে বড় উপজেলা ডুমুরিয়ার অর্ধশত গ্রামে।
মাধবকাঠি বিলপাটিয়ালা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বলেন, আমাদের এই স্কুলটি এখন কোমর পানির নিচে। গত দুই মাসের বেশি সময় এই অবস্থা। শিক্ষার্থীরা স্কুলে আসবে কী, তারা ঠিকমতো খেতেই পায় না। জীবন চালাতে পারছে না। যে ৫৫ শিক্ষার্থী এখন খাতা-কলমে আছে, তাদের জন্য একজনের ফাঁকা মুরগির ফার্মে ক্লাসের ব্যবস্থা করেছি। ভয়াবহ এই জলাবদ্ধতায় স্কুলের শিক্ষার্থীদের শিক্ষা এবং জীবন দুটিই হুমকির মুখে।
উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, খুলনার ৯টি উপজেলার মধ্যে আয়তনে (৪৫৫ বর্গকিলোমিটার) সবচেয়ে বড় ডুমুরিয়া। এর ১৪টি ইউনিয়ন হলো ধামালিয়া, রঘুনাথপুর, রুদাঘরা, খর্ণিয়া, আটলিয়া, মাগুরাঘোনা, শোভনা, শরাফপুর, সাহস, ভান্ডারপাড়া, ডুমুরিয়া, রংপুর, গুটুদিয়া ও মাগুরখালী। এর মধ্যে ডুমুরিয়া, খর্ণিয়া, আটলিয়া, রংপুর, গুটুদিয়া, রঘুনাথপুর, ধামালিয়া ও মাগুরাঘোনা ইউনিয়নে তীব্র জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। এসব ইউনিয়নের অর্ধশতাধিক গ্রামের লাখো মানুষ এখন পানিবন্দি।
রংপুর ইউনিয়নের মাধবকাটি গ্রামের বাসিন্দা প্রভাস মণ্ডল জানান, ঘরের মধ্যে হাঁটুপানি। ঘরে উঁচু বাঁশের মাচা তৈরি করে ঘুমাতে হচ্ছে। বাথরুমে যাওয়ার মতো অবস্থা নেই। কেরোসিন জ্বালিয়ে অথবা সাধ্য থাকলে গ্যাসের চুলায় সামান্য রান্না করে দিন পার করতে হচ্ছে।
বিলপাটিয়ালা গ্রামের বাসিন্দা রিকশাচালক আনসার বলেন, কাঁচাঘর ধসে পড়ছে। গত দুই বছর ধরে আমাদের এই মানবেতর অবস্থা। বছরের ৫ মাস পানির মধ্যে বসবাস করতে হয়। শৌচাগার বা খাবার পানি কোনো কিছুই আমাদের নেই। রিকশা চালিয়ে তিন মাইল দূর থেকে পানি এনে রান্না ও পান করতে হয়। এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেয়নি প্রশাসন।
সাজিয়াড়া আবাসনের বাসিন্দারা জানান, আবাসনের ৫৮টি ঘর সবই পানির নিচে। ঘরের মধ্যে কোমরপানি। বেশিরভাগ পরিবার অন্যত্র চলে গেছে। নিরুপায় হয়ে দুই থেকে তিনটি পরিবার উঁচু মাচা করে রয়েছে। তাদের প্রতিদিন রান্না হচ্ছে না। প্রায়ই শুকনো খাবার খেয়ে দিন পার করতে হচ্ছে। পচা পানির দুর্গন্ধ ও বিষাক্ত সাপ-পোকার উপদ্রব বেড়ে গেছে।
ডুমুরিয়া প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. হাবিবুর রহমান জানান, মাধবকাটি-বিলপাটিয়ালা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পানিতে নিমজ্জিত। বিদ্যালয়ের পাঠদান চলছে আধা কিলোমিটার দূরে হাবিব গাজী নামে এক ব্যক্তির মুরগির খামারে। এ ছাড়া ৫ থেকে ৬টি বিদ্যালয়ের আশপাশ ও সড়ক পানিতে ডুবে আছে। জলাবদ্ধতার কারণে বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি অনেক কমে গেছে।
ডুমুরিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. ইনসাদ ইবনে আমিন বলেন, দুই দফায় অতিবর্ষণে ১০০ হেক্টর জমি প্লাবিত হয়েছে। পানিতে তলিয়ে থাকায় কাঁচা ফসল মরিচ, আদা, হলুদ, পেঁপে, শিম, তরমুজ, লাউ, টমেটো, উচ্ছে, ঝিঙে প্রভৃতি গাছ শুকিয়ে মরে যাচ্ছে। এতে প্রায় ১০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।
ডুমুরিয়া উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা সোহেল মো. জিল্লুর রহমান রিগান বলেন, ভারী বর্ষায় ৪ হাজার মৎস্য ঘের ডুবে গেছে। এ ছাড়া স্থায়ী জলাবদ্ধতার কারণে সাড়ে ৩ হাজার মৎস্যচাষির প্রায় অর্ধকোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।
ডুমুরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ আল-আমিন জানান, ৯টি ইউনিয়নের অর্ধশত গ্রামে ভয়াবহ জলাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে। বেশি ক্ষতিগ্রস্ত মুজারঘুটা, সাড়াভিটা, কৃষ্ণনগর, বিলপাটিয়ালা, মাধবকাটি, মান্দ্রা, ময়নাপুর, বিলসিংগা, কোমলপুর, গুটুদিয়া, মির্জাপুর, হাজিডাঙ্গা, গোলনা, খলসী, সাজিয়াড়া ও আরাজি ডুমুরিয়া গ্রাম। তবে ক্ষতির পরিমাণ এখনো নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি। ক্ষতি নিরূপণে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে খুলনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী উজ্জ্বল কুমার সেন বলেন, বিলডাকাতিয়া, ডুমুরিয়া ও ফুলতলা উপজেলার পানি শোলমারী ও হামকুড়া নদী দিয়ে নিষ্কাশিত হতো। কিন্তু হামকুড়া নদী পুরোপুরি ভরাট হয়ে যাওয়ায় এখন পানি নিষ্কাশনের একমাত্র পথ শোলমারী নদী। তবে গত তিন বছর ধরে শোলমারী নদী ও স্লুইসগেটের মুখ পলি পড়ে ভরাট হয়ে গেছে। ভরাট হয়ে গেছে শোলমারী নদীর পানি যাওয়ার একমাত্র পথ আপার সালতা নদীও। মূলত, এ কারণেই জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে।
সমাধানের উপায় হিসেবে নির্বাহী প্রকৌশলী জানান, জরুরি ভিত্তিতে শোলমারী নদীর পলি অপসারণে আগে ১ কোটি ২৯ লাখ টাকার কাজ হয়েছে। এ ছাড়া ১ কোটি ৪৫ লাখ টাকার কাজ চলমান। পাশাপাশি ২ কোটি ৬০ লাখ টাকার উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন পাম্প স্থাপন করা হয়েছে। তবে স্থায়ী সমাধানে প্রায় ৫০ কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। প্রকল্পটি অনুমোদন পেলে শোলমারী নদীর সাড়ে ১৫ কিলোমিটার ও ৯টি খাল খনন করা হবে। এ ছাড়া উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন আরও ৫টি পাম্প স্থাপন করা হবে। আশা করা যায়, তখন জলাবদ্ধতার স্থায়ী সমাধান হবে।