বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভোট বা নির্বাচন শব্দটি যেমন উৎসবের আমেজ সৃষ্টি করে, তেমনি জাগিয়ে তোলে শঙ্কা ও সংশয়। প্রতিবার ভোটের মৌসুম ঘনিয়ে এলে রাজনৈতিক উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র—দলীয় কর্মীদের উচ্ছ্বাস, শহর-গ্রামজুড়ে পোস্টার-ব্যানারে সাজানো দেয়াল, এবং টেলিভিশনের পর্দায় তর্ক-বিতর্কে মুখর পরিবেশ। কিন্তু এই উচ্ছ্বাসের আড়ালেই থাকে এক প্রশ্ন— আমরা কি সত্যিই একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পথে আছি, নাকি আবারও অনিশ্চয়তা ও সংঘাতের ঘূর্ণিতে প্রবেশ করছি?
সম্প্রতি বিএনপি ২৩৭টি আসনে প্রার্থী ঘোষণা করে আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনী ময়দানে পা রাখার ঘোষণা দিয়েছে। দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক দোদুল্যমানতার পর এই পদক্ষেপ দলটির কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে উচ্ছ্বাস তৈরি করেছে। অনেকের কাছে এটি পুনরুত্থানের বার্তা, আবার কারও দৃষ্টিতে এটি এক ঝুঁকিপূর্ণ রাজনৈতিক বাজি। প্রার্থীদের নাম ঘোষণার পরপরই শুরু হয়েছে প্রচার-প্রচারণা, কিন্তু একই সঙ্গে দেখা দিয়েছে অভ্যন্তরীণ ক্ষোভ, মনোনয়নবঞ্চিত নেতাদের প্রতিবাদ, এমনকি কিছু এলাকায় বিদ্রোহী প্রার্থীর আবির্ভাবও।
মোট ৩০০ আসনের মধ্যে ২৩৭টি আসনের প্রার্থী তালিকা দলটির বর্তমান কাঠামো ও নেতৃত্বের প্রকৃতি স্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তুলেছে। আপাত দৃষ্টিতে তালিকাটি বৈচিত্র্যময় মনে হলেও গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বিএনপি এখনো পুরনো নেতৃত্বের ছায়া থেকে পুরোপুরি বেরোতে পারেনি। কিছু তরুণ ও নতুন মুখ অন্তর্ভুক্ত হলেও সংখ্যায় তা অল্প; মূল কাঠামো গঠিত হয়েছে বয়স্ক, অভিজ্ঞ এবং আগের বেশ কয়েকটি নির্বাচনে পরাজিত রাজনীতিকদের নিয়ে। একাধিক আসনে একই পরিবারের সদস্য বা ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের মনোনয়ন দলটির দীর্ঘদিনের পরিবারকেন্দ্রিক ধারা আবারও দৃশ্যমান করেছে। খালেদা জিয়া নিজে তিনটি আসনে এবং তারেক রহমান ও তার ঘনিষ্ঠ কয়েকজন উপদেষ্টা বা আত্মীয় বিভিন্ন আসনে প্রার্থী হয়েছেন—যা দলীয় ক্ষমতার কেন্দ্রীভবনের ইঙ্গিত দেয়।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, অতীতে যাঁরা ক্ষমতায় থেকে বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন, তাঁদের অনেককেই পুনরায় মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। এতে দলীয় সংস্কারের অভাব স্পষ্ট হয়েছে। ভোটারদের একাংশ যে রাজনীতিতে ‘নতুন সূচনা’-র আশা করেছিল, তা এতে কিছুটা ম্লান হয়ে পড়েছে। ঘোষিত তালিকায় নারীর অংশগ্রহণ ও সংখ্যালঘু প্রতিনিধিত্বও সীমিত; ফলে প্রার্থী তালিকাটি অনেকের চোখে একমুখী ও প্রথাবদ্ধ বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।
তবে বাস্তবিক অর্থে এই তালিকা বিএনপির বর্তমান কৌশলকেও প্রতিফলিত করে— মাঠ পর্যায়ে সক্রিয়তা ধরে রাখতে তারা অভিজ্ঞ ও জনপ্রিয় মুখগুলোকে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু এর বিপরীতে দলীয় সংস্কার, প্রজন্ম পরিবর্তন ও বিকেন্দ্রীকৃত নেতৃত্বের প্রতিশ্রুতি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। এখন দলের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হলো, কীভাবে তারা এই পুরনো কাঠামোর ভেতর থেকেই নতুন আস্থার প্রতিচ্ছবি তৈরি করবে।
বিএনপি অতীতে একাধিকবার নির্বাচনী জোট গঠন করেছে— ২০০১ সালে চারদলীয় জোট এবং ২০১৮ সালে ঐক্যফ্রন্টের অভিজ্ঞতা রয়েছে। কিন্তু প্রতিবারই আসন বণ্টন ও প্রার্থী সমন্বয় নিয়ে দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে। এবারও অনিশ্চয়তা সেই জায়গাতেই। ঘোষিত প্রার্থী তালিকার বহু আসনে শরিক দলের দাবিদার প্রার্থী রয়েছে, বিশেষ করে জামায়াত ইসলামি, নাগরিক ঐক্য ও কিছু ইসলামি দল যাদের সঙ্গে আলোচনার সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে ভবিষ্যতে জোট চূড়ান্ত হলে বিএনপিকে কিছু প্রার্থী বদলাতে হতে পারে অথবা সমঝোতায় যেতে হতে পারে। এই প্রক্রিয়া সুষ্ঠুভাবে না হলে অভ্যন্তরীণ অসন্তোষ ও বিভাজন অনিবার্য। এজন্য দলটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হবে— আগে থেকেই বাস্তবসম্মত সমঝোতার মাধ্যমে জোটের ভারসাম্য রক্ষা করা।
নির্বাচনের প্রস্তুতির মধ্যেই ‘জুলাই সনদ’-কে কেন্দ্র করে দেশের রাজনীতিতে নতুন বিতর্কের জন্ম হয়েছে। এটি মূলত একটি ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ, যা ৫ আগস্টের পর সংঘটিত কিছু কর্মকাণ্ডকে আইনি সুরক্ষা দিতে পারে বলে সমালোচিত। জুলাই আন্দোলনের সমর্থক ও যোদ্ধারা এই সনদ বাস্তবায়নের দাবি জানালেও, এর বৈধতা ও প্রয়োগ নিয়ে এখনো মতভেদ রয়েছে। অনেকে আশঙ্কা করছেন, এই সনদ নির্বাচনপূর্ব বা নির্বাচনের পর দায়মুক্তির অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার হতে পারে। ফলে রাজনৈতিক দলগুলো বিভক্ত হয়ে পড়েছে; কেউ এটিকে রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতার জন্য প্রয়োজনীয় বলছে, আবার কেউ গণতন্ত্রের পরিপন্থী হিসেবে দেখছে। এই বিভাজন নির্বাচন প্রক্রিয়ার অনিশ্চয়তাকে আরও গভীর করছে।
বিএনপির প্রার্থী ঘোষণা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। এটি একদিকে দলীয় পুনর্জাগরণের ইঙ্গিত, অন্যদিকে নির্বাচনী ব্যবস্থার জন্য এক কঠিন পরীক্ষা। আগামী কয়েক সপ্তাহ নির্ধারণ করবে—এই নির্বাচন সত্যিকারের গণতন্ত্রের উৎসবে রূপ নেবে, নাকি আবারও অবিশ্বাস ও সহিংসতার অন্ধকারে হারিয়ে যাবে।
বিএনপির ভেতরের মতবিরোধ নতুন নয়, তবে এবারে তা আরও দৃশ্যমান। অনেক প্রবীণ নেতা বাদ পড়েছেন, কিছু নতুন মুখ উঠে এসেছে—যা একদিকে প্রজন্ম পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিলেও, অভিজ্ঞদের বঞ্চনা দলের ভেতরে মনোবল নষ্ট করতে পারে। দীর্ঘ বিরতির পর নির্বাচনী মাঠে ফেরার সময় এই ধরনের ভেতরের ক্ষোভ যদি সময়মতো নিয়ন্ত্রণ না করা যায়, তবে তা নির্বাচনী লড়াইয়ে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করেন, দলটি এখন এক সঙ্কীর্ণ ভারসাম্যের মধ্যে আছে— একদিকে ঐক্য ধরে রাখার চেষ্টা, অন্যদিকে পরিবর্তনের চাপ।
ওদিকে নির্বাচনী সময়সূচি ঘিরে নানা গুঞ্জন চলছে। নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা, প্রশাসনের নিরপেক্ষতা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আচরণ নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। অতীতের অভিজ্ঞতা দেখিয়েছে—প্রশাসনিক পক্ষপাতমূলক আচরণ নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট করে। নির্বাচনের আগে ও পরে সহিংসতা, গ্রেপ্তার ও দমন-পীড়নের আশঙ্কাও প্রবল। এতে ভোটারদের অংশগ্রহণ কমে এবং নির্বাচনী পরিবেশ নষ্ট হয়। পাশাপাশি ডিজিটাল যুগে তথ্যযুদ্ধ, ভুয়া সংবাদ ও অনলাইন প্রচারণা নির্বাচনের স্বচ্ছতাকে আরও কঠিন করে তুলছে।
অর্থনৈতিক দিক থেকেও নির্বাচন একটি বড় চ্যালেঞ্জ। অনিশ্চয়তা বিনিয়োগ ও বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি করে, সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় প্রভাব ফেলে। ফলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না থাকলে অর্থনীতিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
বাংলাদেশের নির্বাচন এখন আর কেবল অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নজর এবার বিশেষভাবে তীক্ষ্ণ। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জাতিসংঘের পর্যবেক্ষণ দলগুলো সুষ্ঠু নির্বাচনের আহ্বান জানিয়ে আসছে। কারণ, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হলে তা কেবল দেশের ভাবমূর্তি নয়, বাণিজ্য, বৈদেশিক সাহায্য ও কূটনৈতিক সম্পর্কেও প্রভাব ফেলে। তাই যে দলই ক্ষমতায় আসুক, তাদের প্রথম দায়িত্ব হবে আন্তর্জাতিক আস্থা পুনরুদ্ধার করা—যা কেবল একটি অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমেই সম্ভব।
বিএনপির প্রার্থী ঘোষণায় ইতিবাচক দিকও রয়েছে। দীর্ঘ রাজনৈতিক স্থবিরতার পর দলটি মাঠে নেমেছে, সংগঠন সক্রিয় হয়েছে, নতুন প্রজন্মের অংশগ্রহণ ঘটেছে। কিছু আসনে প্রার্থীদের নাম ঘোষণা না করাটাও ঔদার্যর পরিচায়ক। এই আসনগুলো শরীকদের জন্য ছেড়ে দেওয়ার মধ্য দিয়ে সমঝোতার ইঙ্গিতও মিলছে। দলটি যে ধীরে ধীরে বাস্তব রাজনীতিতে ফিরে আসছে- এটা তারই প্রমাণ।
আগাম প্রার্থী তালিকা প্রকাশের ক্ষেত্রে বিএনপি দুটি লক্ষ্য—প্রথমত, রাজনৈতিক ময়দানে পুনঃপ্রবেশ; দ্বিতীয়ত, জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টা। ফলাফল যাই হোক না কেন, এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা করেছে।
অন্যদিকে, অন্তর্বর্তী সরকারের জন্যও এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। সংস্কার ও সুশাসনের অঙ্গীকার নিয়ে ক্ষমতা গ্রহণের পর তাদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো— এমন একটি নির্বাচন আয়োজন করা, যা জনগণের কাছে বিশ্বাসযোগ্য বলে প্রতীয়মান হয়। কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠতার রাজনীতি দিয়ে এখন আর স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। জনগণের আস্থা অর্জনই দীর্ঘমেয়াদে রাজনীতির টেকসই ভিত্তি তৈরি করবে।
বাংলাদেশ আজ এক রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। জুলাই সনদ, অন্তর্বর্তী সরকারের সেফ এক্সিট, নির্বাচনী সংস্কার—সবকিছু মিলিয়ে রাষ্ট্র ও নাগরিকের সম্পর্কের নতুন সংজ্ঞা তৈরি হচ্ছে। যদি এই প্রক্রিয়া অন্তর্ভুক্তিমূলক ও স্বচ্ছ হয়, তবে এটি গণতন্ত্রকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারে; কিন্তু যদি এটি কেবল ক্ষমতার পুনর্বিন্যাসে সীমিত থাকে, তবে আমরা আবারও সংঘাতের চক্রে বন্দী হব।
জনগণ চায় এমন নির্বাচন, যেখানে তারা ভয়ের ঊর্ধ্বে থেকে ভোট দিতে পারবে, এবং নির্বাচিত সরকার হবে তাদের প্রকৃত প্রতিনিধি। নির্বাচন কেবল দলীয় প্রতিযোগিতা নয়, এটি রাষ্ট্রের প্রতি জনগণের আস্থার পরীক্ষা।
বিএনপির প্রার্থী ঘোষণা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। এটি একদিকে দলীয় পুনর্জাগরণের ইঙ্গিত, অন্যদিকে নির্বাচনী ব্যবস্থার জন্য এক কঠিন পরীক্ষা। আগামী কয়েক সপ্তাহ নির্ধারণ করবে—এই নির্বাচন সত্যিকারের গণতন্ত্রের উৎসবে রূপ নেবে, নাকি আবারও অবিশ্বাস ও সহিংসতার অন্ধকারে হারিয়ে যাবে।
শেষ পর্যন্ত প্রশ্নটি কে জিতবে তা নয়, বরং কেমন রাজনীতি এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠবে— সেটিই মূল বিষয়। যদি রাজনৈতিক নেতৃত্বরা দায়িত্বশীলতা ও সহনশীলতার পরিচয় দিতে পারে, তবে এই নির্বাচন হতে পারে বাংলাদেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের প্রথম পদক্ষেপ। আর যদি ব্যর্থ হয়, তবে সেটিই হবে আমাদের গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় পরাজয়।
বাংলাদেশের মানুষ আজও আশা করে— একদিন তারা এমন এক নির্বাচনে অংশ নেবে, যেখানে ভোট হবে উৎসব, ফলাফল হবে বিশ্বাসযোগ্য, আর নির্বাচিত সরকার সত্যিকারের জনতার প্রতিনিধি হয়ে দেশ পরিচালনা করবে। সেই আশাবাদই এখন জাতির জন্য একমাত্র সম্বল।
এইচআর/এমএস

5 hours ago
16









English (US) ·