জাপা-তৃণমূল বিএনপি ঘুরে এখন তিনি এনসিপির প্রধান সমন্বয়কারী

2 hours ago 3

• এম. শাব্বির আহমেদ ছিলেন জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা
• ২০২৪ সালের নির্বাচনে ১,৬৬৬ ও ২০১৮-তে পান ৭৪২ ভোট
• বাড়ি যশোর, থাকেন ঢাকায়, তবু নড়াইল এনসিপির প্রধান
• তদবির করে পেয়েছেন পদ, নির্বাচন এলেই করেন দলবদল

একসময় ছিলেন জাতীয় পার্টির (এরশাদ) কেন্দ্রীয় নেতা। সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন না পেয়ে যোগ দেন বাংলাদেশ জাতীয় পার্টিতে (মুকিত-জাফর)। সেখান থেকে কাঁঠাল প্রতীকে নির্বাচন করেন। এ দলটিতেও থিতু হতে পারেননি তিনি। সবশেষে ‘কিংস পার্টি’ হিসেবে পরিচিত তৃণমূল বিএনপি থেকে ২০২৪ সালের ‘ডামি’ নির্বাচনে অংশ নেন।

বারবার দলবদল করা এই নেতা হলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) এম. শাব্বির আহমেদ। সম্প্রতি তিনি জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নড়াইল জেলা প্রধান সমন্বয়কারী হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন, যা নিয়ে তীব্র অসন্তোষ ও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে স্থানীয় এনসিপি নেতাকর্মীদের মধ্যে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণের সম্ভাবনা না থাকায় দলটির বহিষ্কৃত ও দলছুট নেতাকর্মীদের নিয়ে গঠন করা হয় কিংস পার্টি খ্যাত তৃণমূল বিএনপি। সেসময় বিএনপির একটি অংশকে ভাগিয়ে এনে ‘ডামি নির্বাচন’ খ্যাত এই নির্বাচন গ্রহণযোগ্য করার চেষ্টা চালায় তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার।

এ লক্ষ্যে বিএনপি চেয়ারপারসনের বহিষ্কৃত উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকারকে চেয়ারম্যান ও বিএনপির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরীকে মহাসচিব করে গঠন করা হয় তৃণমূল বিএনপি। এই দলটি ডামি প্রার্থী দিয়ে নির্বাচন বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। সেই নির্বাচনে এম. শাব্বির আহমেদ যশোর-৪ আসন থেকে তৃণমূল বিএনপির হয়ে সোনালী আঁশ প্রতীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং মাত্র এক হাজার ৬৬৬ ভোট পান। এর আগে ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির প্রার্থী হিসেবে যশোর-৪ আসন থেকে কাঁঠাল প্রতীকে নির্বাচন করে মাত্র ৭৪২ ভোট পেয়েছিলেন।

এম. শাব্বির আহমেদ এক সময় জাতীয় পার্টির (এরশাদ) কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। তিনি ২০১৮ সালের নির্বাচনে জাতীয় পার্টির মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন। তবে ওই নির্বাচনে দলটি থেকে মনোনয়ন না পেয়ে বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি থেকে কাঁঠাল প্রতীকে নির্বাচনে অংশ নেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শাব্বির আহমেদ মূলত যশোরের অভয়নগর উপজেলার বাসিন্দা এবং যশোর-৪ আসন থেকে নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। যদিও তিনি বলেন, তার বাড়ি নড়াইল সীমান্তের খুব কাছে এবং সেখানে তাদের জমিজমা ও দোকানপাট আছে। তারপরও যশোরের লোককে নড়াইল জেলা এনসিপির দায়িত্ব দেওয়ায় রাজনৈতিক অঙ্গনে হাস্যরসের সৃষ্টি হয়েছে।

জাপা-তৃণমূল বিএনপি ঘুরে এখন তিনি এনসিপির প্রধান সমন্বয়কারী

বারবার দলবদল করা শাব্বির আহমেদের মতো লোককে নড়াইল জেলা এনসিপির প্রধান সমন্বয়কারী করায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন স্থানীয় নেতাকর্মীরা।

জুলাই আন্দোলনে আহত ও এনসিপি কর্মী মো. মাসুম বিল্লাহ প্রশ্ন তুলেছেন, নড়াইল জেলায় কি এনসিপির নেতৃত্ব দেওয়ার মতো যোগ্য কোনো ব্যক্তি নেই যে অন্য জেলা থেকে একজন বিতর্কিত ব্যক্তিকে ধার করে আনতে হবে?

এছাড়া নড়াইল জেলা এনসিপির কমিটি গঠনের পর থেকেই সাংগঠনিক কার্যক্রমে এক ধরনের স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। এর প্রধান কারণ হিসেবে জেলার প্রধান সমন্বয়কারী এম. শাব্বির আহমেদের অনুপস্থিতি ও নিষ্ক্রিয়তাকে দায়ী করছেন স্থানীয় নেতাকর্মীরা।

নড়াইল জেলা এনসিপি সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, গত ৩ জুন কমিটি গঠনের পর থেকে এম. শাব্বির আহমেদ মাত্র কয়েকবার নড়াইলে এসেছেন। অভিযোগ রয়েছে, ঈদের সময় তিনি পাঁচ-ছয় দিন বাড়িতে থাকলেও দলের কোনো নেতাকর্মীর খোঁজখবর নেননি। এছাড়া গত ১০ জুলাই এনসিপির কেন্দ্রীয় টিম যখন ‘জুলাই পদযাত্রা’ উপলক্ষে নড়াইলে আসে, তখন তিনি মাত্র একদিনের জন্য অনুষ্ঠানে অংশ নেন এবং এরপর আবার ঢাকায় ফিরে যান।

স্থানীয় নেতাকর্মীরা জানান, অল্প কয়েকজন ছাড়া অন্য কারও সঙ্গেই শাব্বির আহমেদের নিয়মিত যোগাযোগ নেই। তার অনুপস্থিতির কারণে নড়াইল জেলা শহরে এনসিপির কোনো দলীয় কার্যালয় নেই এবং চোখে পড়ার মতো কোনো সাংগঠনিক কার্যক্রমও দেখা যায় না।
স্থানীয় নেতাকর্মীদের মতে, প্রধান সমন্বয়কারীর এ নিষ্ক্রিয়তা দলের কার্যক্রমে চরম নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে এম. শাব্বির আহমেদ জানান, তিনি ঢাকায় একটি ভূমি-ফ্ল্যাট ব্যবসায়ী কোম্পানিতে চাকরি করেন৷ এজন্য ঢাকায়ই থাকেন।

জাপা-তৃণমূল বিএনপি ঘুরে এখন তিনি এনসিপির প্রধান সমন্বয়কারী

বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে কালিয়া উপজেলা শাখা এনসিপির সমন্বয় কমিটির সদস্য নাজমুল হাসান উজ্জ্বল বলেন, যে ব্যক্তি নিজেই একটি কোম্পানিতে চাকরি করেন, তিনি কীভাবে এলাকায় সময় দিয়ে দল গোছাবেন? যদি তিনি ব্যবসা করতেন, তাহলে একটা বিষয় ছিল৷ ব্যবসায়ী হলে যখন তখন নিজের স্বাধীনতা মতো এলাকায় আসতে পারতেন। একজন চাকরিজীবী একটা জেলার প্রধান হলেন কী করে?

এছাড়া এনসিপির নড়াইল জেলা কমিটিতে জুলাই আন্দোলনকারীদের অবমূল্যায়ন নিয়েও ক্ষোভ রয়েছে। অনেক ত্যাগী ও আহত আন্দোলনকারী কমিটিতে জায়গা পাননি, যারা পেয়েছেন তাদের পদ-পদবিও নিচের দিকে। তাদের মধ্যে জুলাই আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখা নারী নেত্রী সামিরা খানম কোনো পদ পাননি, আরেক জুলাই আন্দোলনকারী এস এম ইরফানুল বারী উজ্জ্বল ২১ সদস্যের কমিটির ১২ নম্বর সদস্যপদ পেয়েছেন। নড়াইল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক ও জুলাই আহত আব্দুর রহমান মেহেদীও কমিটিতে কোনো পদ পাননি।

এছাড়া নড়াইলের জুলাই আন্দোলনে ভূমিকা রাখা আহত জুলাইযোদ্ধা তুহিন বিন আব্দুর রাজ্জাক, মো. শুভ মোল্যা, নবাব মোল্যা, আমিরুল ইসলাম রানা, নুসরাত জাহানসহ এমন অনেক আন্দোলনকারীর স্থান হয়নি কমিটিতে।

তবে অভিযোগ রয়েছে, এম শাব্বির আহমেদের ছত্রছায়ায় জেলা এনসিপির সমন্বয় কমিটিতে সদস্যপদ বাগিয়েছেন জেলা জাতীয় পার্টির সাবেক নেতা অ্যাডভোকেট ইমদাদুল হক ও আবুল হাসান চঞ্চল।

এ বিষয়ে জুলাই আহত ও নড়াইল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক যুগ্ম সদস্য সচিব ও ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক আ. রহমান মেহেদী বলেন, ‘নড়াইলের এনসিপির প্রধান সমন্বয়কারী হয়েও এম শাব্বির কখনো আমাদের খোঁজ নেন না। এমনকি ফোনেও তাকে পাওয়া যায় না। কখনো তিনি নড়াইলে আসেন না। তাছাড়া তিনি স্বৈরাচারের সবচেয়ে বড় দোসর জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা ছিলেন। হাসিনার ডামি নির্বাচনে কিংস পার্টি তৃণমূল বিএনপির এমপি প্রার্থী ছিলেন। এমন একজন কলঙ্কিত ব্যক্তি বিপ্লবোত্তর সময়ে এসেও কীভাবে বিপ্লবী দল এনসিপির একটা জেলার প্রধান হলেন?’

এম শাব্বির আহমেদের বিরুদ্ধে আসা এসব অভিযোগ প্রসঙ্গে মন্তব্য জানতে মুঠোফোনে তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। এসময় তিনি ২০২৪ সালের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তৃণমূল বিএনপির হয়ে তার অংশগ্রহণের বিষয়ে জাগো নিউজকে বলেন, ‘২৪-এর নির্বাচনটি আসলে একটি গোয়েন্দা সংস্থার খেলা ছিল। সেই গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা আমাকে একটি বৈঠকে আমন্ত্রণ জানান, যেখানে বলা হয় যে জাতীয় পার্টি শেষ হয়ে গেছে। তারা আমাকে তৃণমূল বিএনপিতে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব দেন। তারা আমাকে আশ্বস্ত করেন, তৃণমূল বিএনপি নির্বাচনে ৩৩টি আসন পাবে এবং তারাই বিরোধী দল হবে।’

‘এই নির্বাচন ছিল আমার ওপর এক ধরনের জোরাজুরি। আমাকে আটকে দেওয়া হয়েছিল।’ দাবি করে শাব্বির আহমেদ বলেন, নির্বাচনের পরদিনই তিনি তৃণমূল বিএনপি থেকে পদত্যাগ করে দলটির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন।

এছাড়া ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তার অংশগ্রহণ এবং জাতীয় পার্টির সঙ্গে সম্পর্ক প্রসঙ্গে শাব্বির আহমেদ জানান, তার আসল উদ্দেশ্য ছিল স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করা। জাতীয় পার্টির তৎকালীন চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ছয় মাস আগেই তাকে মনোনয়ন দিয়েছিলেন। কিন্তু নির্বাচনের ঠিক আগে এরশাদ অসুস্থ হয়ে সিঙ্গাপুর চলে যান। এ সুযোগে দলের তৎকালীন মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদার ‘টাকা-পয়সা খেয়ে’ অন্য একজনকে মনোনয়ন দেন।

জাপা-তৃণমূল বিএনপি ঘুরে এখন তিনি এনসিপির প্রধান সমন্বয়কারী

তিনি জানান, এরপর তিনি এরশাদ ও জিএম কাদেরকে ফোন করলে তারা তাকে নির্বাচন করার পরামর্শ দেন, কারণ এতে তিনি নেতাকর্মীদের ধরে রাখতে পারবেন। কিন্তু স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রয়োজনীয় ১ শতাংশ ভোটারের স্বাক্ষর ও এনআইডি নম্বর সংগ্রহে জটিলতা দেখা দেওয়ায় তিনি বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি থেকে কাঁঠাল প্রতীকে নির্বাচন করেন।

আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে তার পরিকল্পনার বিষয়ে জানতে চাইলে শাব্বির আহমেদ বলেন, ‘আমার নিজস্ব চিন্তাভাবনা থাকলেও দলের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। দল আমাকে তো ঘোষণা দেয়নি। আমি তো বলতে পারি না যে আমি নির্বাচন করবো।’

তবে তিনি ইঙ্গিত দেন যে, তিনি যে এলাকায় বসবাস করেন, সেখান থেকেই নির্বাচনে অংশ নিতে চান। সেই হিসেবে নড়াইল-১ আসন থেকে নির্বাচন করার চিন্তাভাবনা আছে বলে তিনি জানান।

এম শাব্বির আহমেদকে এনসিপির নড়াইল জেলার প্রধান সমন্বয়কারীর দায়িত্ব দেওয়ার বিষয়ে দলটির কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) ও নড়াইল জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি মোল্যা রহমাতুল্লাহ বলেন, ‘এ বিষয়ে আমার খুব বেশি জানা নেই। কমিটি করার আগে এসব দেখার চেষ্টা করেছি। তিনি একটা সময় পর্যন্ত জাতীয় পার্টির রাজনীতি করেছেন, পরে জাতীয় পার্টি ছেড়েছেন বলে জেনেছি। এর বেশি কিছু জানা নেই।’

এমআইএন/কেএইচকে/এমএমএআর/এমএফএ/জিকেএস

Read Entire Article