জামদানি শাড়ি। যার কদর পুরো দেশে। প্রাচীনকাল থেকে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ জামদানি তৈরির জন্য বিখ্যাত। তবে, কালের পরিক্রমায় এ ব্যবসায় ধস নেমেছে। যার কারণ হিসেবে মনে করা হচ্ছে অনলাইন ব্যবসার প্রাধান্যকে। ফলে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন ব্যবসায়ীরা।
সোনারগাঁ জাদুঘরের ভেতর ৯টি মসলিন জামদানি শাড়ির দোকান রয়েছে। সেখানকার ব্যবসায়ীরা নিজ হাতে তৈরি করা শাড়ি দোকানে বিক্রি করেন। জাদুঘরের প্রায় সব দোকানির ব্যবসার বয়স দুই যুগেরও বেশি। ঐতিহ্য ধরে রেখে ব্যবসা চালিয়ে গেলেও বর্তমানে টিকে থাকা কষ্ট হচ্ছ- এমনটাই ভাষ্য তাদের।
দোকানিরা জানান, হাতের তৈরি মসলিন জামদানি শাড়ির সর্বনিম্ন মূল্য ৪ হাজার আর সর্বচ্চ এক লাখ ছাড়িয়ে যায়। প্রতিটি শাড়ি তৈরিতে অন্তত ছয় দিন থেকে দুই মাস পর্যন্ত সময় লাগে। তবে ক্যাটাগরি অনুযায়ী সময় ব্যয় হয়। অপরদিকে মেশিনে তৈরি শাড়ির মূল্য এক থেকে তিন হাজার টাকা।
ব্যবসার পরিস্থিতি সম্পর্কে দোকানিরা যা জানালেন
দীর্ঘ ৩২ বছর ধরে জাদুঘরে জামদানি শাড়ির ব্যবসা করছেন স্বর্ণলতা দোকানের মালিক মো. আবু তাহের (৬০)। উপজেলার গোয়ালদী এলাকার মৃত মোজাম্মেল হোসেনের ছেলে আবু তাহের জামদানি শাড়ি তৈরি করে বহুবার পুরস্কৃত হয়েছেন। ঐতিহ্যবাহী এই পোশাকের ব্যবসা করে নিজের দুই ছেলে আর এক মেয়েকে উচ্চ শিক্ষিত করেছেন। তবে বর্তমানে ব্যবসার বেশ মন্দ সময় যাচ্ছে বলে জানান।
তিনি বলেন, মাঝেমধ্যে বনিবাট্টাও হয় না। অথচ জামদানি শাড়ির চাহিদা এই জাদুঘরে বেশ ভালো ছিল। মূলত অনলাইনের যুগে দোকানিদের ব্যবসা বন্ধের পথে। মুসলিন জামদানির বাজার নষ্ট করেছে অনলাইন ব্যবসায়ীরা। পাশাপাশি দেশের পরিস্থিতিও এর অন্যতম কারণ।
হিজলতলী জামদানি হাউসের দোকানি মো. ইকবাল হোসেন ২২ বছর ধরে এখানে ব্যবসায় জড়িত। রূপগঞ্জ থানার বাসিন্দা ইকবালের পূর্ব পুরুষরা এ পেশায় নিয়োজিত ছিল। তার মতে, দেশের অর্থনৈতিক মন্দা, সার্বিক পরিস্থিতি ঘোলাটে আর ক্রেতাদের অনলাইনে ঝুঁকে পড়ায় সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। তাদের কারখানার শ্রমিক ও হেলপারের মজুরি বাড়লেও ক্রেতা দিনদিন কমছেই। বর্তমান সময়ে একজন রিকশাচালক প্রতিদিন ৫০০-৬০০ টাকা ইনকাম করলেও জামদানি কারিগরদের গড়ে আড়াই থেকে তিনশ টাকা বেতন পায়। সবশেষ করোনার পর থেকে তাঁত আসছে না। এক হাজার থেকে ১২০০ তাঁতের পরিবর্তে এখন পাঁচ থেকে ছয়শ তাঁত আসে। ফলে দুশ্চিন্তায় থাকতে হয়।
তুষার জামদানি হাউসের ১৯ বছর বয়সী দোকানি দ্বীপ্ত বলেন, বর্তমানে ব্যবসা খারাপ যাচ্ছে। তবে জানুয়ারিতে ভালো বেচাবিক্রি হয়। মূলত বছরে ৪-৫ মাস এ শাড়ির চাহিদা বা ক্রেতা থাকে। মহামারি করোনার পর থেকেই ব্যবসায় ধস নামতে শুরু করে। এরপর ধীরে ধীরে অবস্থার বেগতি হয়।
তিনি বলে, অনলাইনের কারণে ধস নেমেছে। যেসব শাড়ি এক হাজার থেকে ১২০০ টাকায় বিক্রি করি। অনলাইনে সেসব শাড়ি ৭০০-৮০০ টাকায় বিক্রি হয়। শাড়ির মান ভালো হওয়া সত্বেও কম দামে নকল পণ্য অনলাইন থেকে কেনে। অফলাইনের শাড়িতে সুতা বেশি ব্যবহার করা হয়। আর অনলাইনে কোনোমতে সুতার ব্যবহার করেই তা বিক্রি হয়।
বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক এ কে এম আজাদ সরকার বলেন, জামদানি লোক ও কারুশিল্পের একটি প্রধান উপযোগ্য, যা বিশ্বব্যাপী পরিচিত। যেটাকে ঢাকাই জামদানি হিসেবে মানুষ চেনেন। এই শাড়ি তৈরির কারিগররা অনকেটা ঝুঁকিতে রয়েছে। সেটা মূল্যের ক্ষেত্রে কিংবা অন্যান্য শাড়ির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে। তাদের হতাশ হওয়ার অন্যতম কারণ মজুরি বেড়েছে। মূলত কাচামালের দাম বাড়লেও বিপণনের ক্ষেত্র একই আছে। ক্রেতারা হাতে তৈরি শাড়ি কেনার উদ্দেশ্যে দোকানে আসার পর মূল্য নিয়ে ঝামেলা হয়। কারণ হাতে তৈরি যেকোনো জিনিসর দাম স্বাভাবিকভাবে বেশি। সেখানে ক্রেতারা কম টাকায় নকল পণ্য কিনে থাকেন। ক্রেতরা সঠিক পণ্য চিনতে ভুল করায় অনেক সময় জামদানি বিক্রেতাদের লসের সম্মুখীন হতে হয়।
মো. আকাশ/এএইচ/জিকেএস