বঙ্গ রাখাল
সাহিত্য সমাজের কথা বলে—মানুষের কথা বলে। যে জন্য সাহিত্য মানবজীবনেরই প্রতিচ্ছবি। শিশুসাহিত্য নিয়ে অনেকে কাজ করেছেন এবং করছেন। শিশুদের শিক্ষাই প্রধান শিক্ষা—এই ভিত্তির ওপরে টিকে থাকে সব শিক্ষা। সময়ের পরম্পরায় তাদের শিক্ষার জন্য অনেক সাহিত্যিক এই গুরু দায়িত্ব পালন করে গেছেন বা করছেন। শিশুদের মনস্তত্ত্ব, তাদের চাহিদা এবং তাদের প্রবণতা, আগ্রহ কবি জাহেদা খানম বুঝতেন এবং তাদের উপযোগী করে প্রচুর ছড়া-কবিতা রচনা করেছেন। শিশুদের পছন্দ ও অপছন্দের ওপরও শিশুসাহিত্যিকদের নজর দিতে হয়। তা না হলে সেটি আর সাহিত্য হয়ে ওঠে না। শিশুদের নান্দনিকতা ও সৌজন্যবোধের জায়গাও ছড়া রচনার সময় মাথায় রাখতে হয়। যা জানতেন সাহিত্যিক জাহেদা খানম। তার জন্ম ১৯২৩ সালের ৭ জুলাই ব্র্যাহ্মণবাড়িয়া শহর সংলগ্ন বিজেশ্বর গ্রামে। ১৯৩৯ সালে ষোলো বছর বয়সে তার বিয়ে হয়। বিয়ের দশ বছর পর ১৯৪৮ সালে নিজের চেষ্টায় মেট্রিক এবং তেরো বছর পর ১৯৬১ সালে আইএ পাস করেন। ১৯৬৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতক (সম্মান) এবং ১৯৬৫ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।
জাহেদা খানম কবিতা লেখা শুরু করেছিলেন শৈশবেই। লেখার প্রবল আগ্রহ এবং সহজাত ক্ষমতা থাকায় যে কোনো বিষয়ে লিখতে পারেন। সেজন্যই হয়তো পারিবারিক দায়দায়িত্ব এবং জীবনঘাতী রোগ-শোক তার লেখালেখির বিঘ্ন ঘটালেও একেবারে বন্ধ করে দিতে পারেনি। কবিতার পাশাপাশি তিনি ছড়া, গান, প্রবন্ধ ও স্মৃতিকথা লিখেছেন। এ ছাড়া তার তিনটি ছড়ার বই—‘করিন আমার লক্ষ্মী সোনা’ (১৯৯৫), ‘খোকার হাতে চাঁদ, পুব আকাশে রঙ ছড়ালো’ (২০০২) ও কাব্যগ্রন্থ—‘একা এই শূন্য প্রান্তরে’ (১৯৯৫), ‘ধরপহরের স্মৃতি’ (২০০৮), ‘জীবন তরী’ (২০০৮) প্রকাশিত হয়েছে। তা ছাড়া সংস্কৃত ভাষা শিখে জীবনের এ পর্যায়ে অনুবাদ করেছেন মহাকবি কালিদাসের ‘মেঘদূতম’(২০০৬)। প্রকাশের পথে আছে ‘অভিজ্ঞানশকুন্তলম’। উল্লেখ্য, মেঘদূতমের সার্থক অনুবাদের জন্য ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার তাকে ২০০৭ সালে বিশেষ সম্মাননা প্রদান করেছে।
বাংলাদেশের শিশুসাহিত্য যারা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন, তাদের মধ্যে জাহেদা খানম (১৯২৩) অন্যতম। তার শিশুসাহিত্য নিছক সাহিত্য রচনার জন্য রচিত হয়নি। তিনি এই ছড়া, কবিতার মাধ্যমে শিশুদের নীতি-নৈতিকতার শিক্ষা দিতে চেয়েছেন। কারণ তিনি জানেন শিশুরাই একদিন বড় হয়ে সমাজের দায়িত্বশীল পদগুলো পরিচালনা করবে। তাদের শিক্ষাই প্রধান শিক্ষা ভেবে ছড়াকার খানম কাজ করেছেন। তিনি নারীদের অগ্রগতির জন্য যেসব কাজ করে গেছেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। শিশু বয়স থেকে বাচ্চাদের সচেতনতার জন্য জাহেদা খানম ছড়ার মধ্যদিয়ে তাদের শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। তিনি পরিবারের ছোট ছোট বাচ্চাদের উৎসাহ এবং তাদের সাহিত্যের প্রতি আগ্রহী ও মুক্তচিন্তার মানুষ করে তোলার জন্য তাদের নামে কবিতাও লিখেছেন এবং তাদের উৎসর্গ করেছেন। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ও নারী নেত্রী শিরিন হকের আদরের পুত্র বারীশকে নিয়ে ছড়াকার লিখেছেন—‘বারীশ আমার নয়ন মনি’। এই ছড়াতে খানম তার ছোট্ট ও আদরের নাতছেলেকে কত যে ভালোবাসেন এবং স্নেহ করেন তারই যেন চিহ্নবহন করে। ‘বারীশ আমার নয়ন মনি/ বারীশ আমার সোনা/ বারীশ আমার ময়না পাখি/ বারীশ আমার টোনা’। জাহেদা খানম তার ‘খোকার হাতে চাঁদ’ ছড়ার বইয়ের উৎসর্গপত্রে ছড়াকার—‘বারীশ তুমি এসেছ হে, স্বাগতম’ এই বাণী দিয়ে হয়তো বারীশের জন্মের সময় এই কবি স্বাগতম জানিয়েছেন। বারীশকে নিয়ে আরও একটা ছড়া লিখেছেন ছড়ার নাম—‘বারীশ ময়না কই’। এই ছড়াতে বলছেন—‘কই গেল রে বারীশ ময়না/ বারীশ ময়না কই/ দেখতে গিয়ে ঘরের পিছে/ চড়বে কিনা মই—’।
নাগরিক জীবনে বাস করলেও জাহেদা খানমের প্রেম, ভালোবাসা, দরদ ছিল গ্রামের মানুষের প্রতি। গ্রামীণ, গাছপালা, প্রাণী, জলবায়ু, বিশেষ করে গ্রামীণ অনুষঙ্গ তাকে প্রভাবিত করেছে, ফিরতে চেয়েছেন গ্রামে। এই কলহময় শহর তিনি ছেড়ে গ্রামে যেতে চেয়েছেন এবং বসবাস করতে চান। যে কারণে তিনি বলেন—‘ভাল্লাগে না ভাল্লাগে না।/ শহরে আর মন বসে না/ ভাবছি এবার ছাড়বো শহর/ খুঁজবো কোথায় বইছে নহর।/ বন বাদাড়ে পালিয়ে যাবো/ বনের পশুর পোষ মানাবো/ বাঘ ভাল্লুকের ঘাস খাওয়াবো।’ আবার তিনি ‘শহরে আর মন রচেনা না’ ছড়াতে বলছেন—‘শহরে আর মন রোচে না/ পালাই পালাই করে প্রাণ/ ঘর-বাড়ী সব ফাটকখানা/ হায়রে খোদা! কোথায় ত্রাণ।/ ...রাস্তাঘাটে লোক ধরে না/ যে যার মত একা একা/ মন কেঁদে কয় হায়রে কপাল/ কোথায় পাব সাথীর দেখা/ এই শহরে ব্যস্ত সবাই/ ভাবনা শুধু নিজের একা।’ কবি এই শহরে থেকে আর নিজেকে শহরের চার দেওয়ালের মধ্যে আটকে রাখতে পারছেন না। এখানে তার দমবন্ধ হয়ে আসছে। এই শহরে সবাই যার যার মতো ব্যস্ত। কেউ কারও কথা শোনার সময় নাই।
আরও পড়ুন
হাসান হাফিজের কবিতা: আধখানা চাঁদের কুহক
সৃষ্টিতে বেঁচে থাকবেন সবার মাঝে
নিজের ভাবনা যেন নিজের হয়ে বুকের মধ্যে আটকে থাকে। মানুষের সামনে পড়ে থাকলেও মানুষ ফিরেও তাকায় না এটাই বুঝি শহর। এই শহর মানুষকে বড় স্বার্থপর করে তোলে। তারা সবাই গতিতে চলতে চাই—এই গতি রোধে তাদের পড়তে হবে পিছিয়ে যে কারণে এই রেসে তাদের জিততেই হবে। যে কারণে কবি ফিরতে চান গ্রামে। গ্রামীণজীবনই কবিকে মুগ্ধ করে। কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও কৃষিকে ভালোবেসে ফিরতে চেয়েছিলেন গ্রামে এবং গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের জন্য কৃষি সমবায় ব্যাংক, এগ্রো গরুর খামার, কৃষির উন্নয়নের জন্য ছেলে রথীন্দ্রনাথকে কৃষিবিদ্যা পড়িয়ে আনা। এসব একমাত্র সম্ভব হয়েছে রবীন্দ্রনাথের মহানচিন্তা থেকে। কবি জাহেদা খানমও মহানচিন্তা থেকে ফিরতে চান গ্রামে। গ্রামীণ মানুষের জীবন তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে। এই শালিক-দোয়েলের জীবন তাকে তাড়িত করে; মনের মধ্যে একধরনের তোলপাড় তোলে।
ছড়া সাহিত্যের মাধ্যমে জাহেদা খানম তার জীবনের ভালো-লাগা, মন্দ-লাগা, দুঃখ-কষ্টের কথা বর্ণনা করেছেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন একজন সংগ্রামী নারী। কোন বাধাই তার চলার পথকে রুদ্ধ করতে পারেনি। জীবনে পুড়ে পুড়ে খাঁটি মানুষ হয়ে উঠেছেন। যার পরিচয় আমরা তার সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে জানতে পারি। তিনি নির্মল বাতাসে নিঃশ্বাস নিতে চান, দেখতে চান খোলা আকাশ। তার সামনে বাচ্চারা খেলবে, হাসবে, গাইবে, শিখবে, কবিতা পড়বে তিনি তো এসবই চেয়েছিলেন। এসব তার ‘আমাদের বাড়িখানা ছোটখাটো জু’ ছড়াতে আমরা দেখতে পাই—তিনি এই ছড়াতে একটা বাড়ি কুকুর, বেড়াল, ছাগল, গরু, ছাগছানা, হাঁস-মুরগি, পাখ-পাখালি, কপোত-কপোতি, দোয়েল, শালিক-টিয়া, চড়ুই, টুনটুনি, কাঠঠোকড়া, বুলবুলি ও অনেক গাছেরও বর্ণনা দিয়েছেন। ছড়াতে বলছেন—‘আছে হলদে পাখির আনাগোনা/ চড়ুই পাখি টুনিটোনা।/ ভিন্নঋতুতে ভিন্ন জনা/ এ বাড়ির পথ সকলের চেনা। ...আর বলব কত?/ অনেক কথা বলার মতো,/ অনেক কথা বাকী/ হয়নি বলা/ মানুষ নামের/ চিড়িয়াগুলো/ আর সবার মতো/ আপন মনে/ আপন ভোলা/ এই বাড়িতে থাকি।’ এই ছড়া কিংবা সাহিত্যই জাহেদা খানমকে প্রাণিত করেছে। তিনি পরাস্ত হতে আসেননি—শত যাতনা নিয়েও তিনি চালিয়ে গেছেন সাহিত্য সাধনা। তিনি জানেন শুধু সাহিত্য রচনা করলেও চলে না—নিজের পরিবারকেও শিক্ষার মধ্যে আনতে হয়। যে জন্য এই শিক্ষা মায়ের কাছ থেকে পেয়ে এই সাহিত্যিকের মেয়েরা নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ভাঙাচোরা মন নিয়েও যে সাধনা করা যায় তার দৃষ্টান্ত কবি জাহেদা খানম।
ব্যক্তিজীবনে তিনি ছিলেন সাহসী নারী। জীবন সংগ্রামের উৎস ছিল মানুষের প্রেম-ভালোবাসা। তিনি মানুষকে ভালোবাসতেন। ভালোবাসাহীন জীবন তিনি পছন্দ করতেন না। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্য, বিশেষ করে গান জাহেদা খানমের প্রাণের সংগীত ছিল। যে কারণে তার মৃত্যুর সময়ও তাকে রবীন্দ্রসংগীতের মাধ্যমে বিদায় জানানো হয়। একজন মানুষ কতটা চিন্তা-চেতনার দিক থেকে উন্নত মানসিকতার পরিচয় দিলে এটা সম্ভব হয়, তা জাহেদা খানমের জীবন ইতিহাস জানলেই বোঝা যায়। কবি জাহেদা খানম সম্পর্কে মেয়ে নারীনেত্রী শিরিন হক বলেন—‘আমাদের বাড়িতে কোন ধর্মভেদ, লিঙ্গ ভেদ, শ্রেণির ভেদ দেখিনি। তিনি ওই পরিবেশ তৈরি করেছিলেন বলেই আমরা অনেক বেশি উদার চিন্তা করতে পারি। তা না হলে সংকীর্ণমনা মানুষ হতাম।’ এটা সত্য; এই উন্নত চিন্তার শিক্ষা মানুষ তার পরিবার থেকে পেয়ে থাকেন।
সর্বোপরি সব মিলিয়ে বলা যায় যে, সাহিত্য রচনায় তিনি যেমন পারঙ্গমতা দেখিয়েছেন, তেমনই ছিলেন মানবতার প্রতীক। এই আলোকিত মানুষ আমাদের মাঝে না থাকলেও সাহিত্যকর্মের মধ্যে টিকে থাকবেন অনন্তকাল।
এসইউ/জেআইএম

11 hours ago
5









English (US) ·