জিকা ভাইরাস: এক নতুন আতঙ্কের নাম

1 month ago 13

বিশ্বজুড়ে এখন নতুন আতঙ্কের নাম জিকা ভাইরাস। ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়ার মত জিকাও ছড়ায় এডিস মশার মাধ্যমে। দেশে প্রথমবারের মতো জিকা ভাইরাসের ক্লাস্টার শনাক্ত হয়েছে। ক্লাস্টার সংক্রমণের বিষয়ে আই.সি.ডি.ডি.আর.বি. এর গবেষকরা ২০২৩ সালে জ্বরে আক্রান্ত ১৫২ জন রোগীর জিকার লক্ষণ রয়েছে এমন সন্দেহে তাদের নমুনা পি.সি.আর. ভিত্তিক পরীক্ষা করা হয়। এতে পাঁচজনের নমুনায় জিকা ভাইরাসের সংক্রমণ পাওয়া যায়।

২০২৪ সালে আই.ই.ডি.সি.আর. এর তথ্য অনুযায়ী তিন মাসে আটজনের শরীরে এই ভাইরাসের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। আক্রান্ত ব্যক্তিদের বাড়িতে পাওয়া মশার নমুনাতেও জিকা ভাইরাস পাওয়া গেছে। তারা সবাই ঢাকার বাসিন্দা। সম্প্রতি চট্টগ্রামে দুই ব্যক্তির শরীরে জিকা ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জিকা শনাক্ত হওয়ার ঘটনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চিকিৎসা ও প্রতিরোধ বিষয়ে নতুন করে ভাবতে হবে, কাজ করতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সতর্ক বার্তা দিয়ে জানিয়েছে, এ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে ৩০ থেকে ৪০ লাখ মানুষ।

জিকা ভাইরাসের ধরন: ইয়েলো ফিভার, ওয়েস্ট নাইল, চিকুনগুনিয়া ও ডেঙ্গু যে গোত্রের সদস্য, জিকা ভাইরাসও একই গোত্রের অন্তর্ভুক্ত একটি ফ্লাভিভাইরাস।

জিকা কোনো জটিল রোগ নয়। এ রোগে মৃত্যুর ঝুঁকি একেবারেই নাই। ইতিপূর্বে আক্রান্তদের পরবর্তীতে কোনো ক্ষতিকর প্রভাবও পাওয়া যায় না, যা ডেঙ্গু বা চিকুনগুনিয়ার বেলায় হতে পারে। এমনকি একবার আক্রান্ত হলে দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হবার ঝুঁকিও নাই। তাই তেমন কোনো এন্টি ভাইরাল ওষুধ বা টিকাও আবিষ্কৃত হয়নি। শুধু ঝুঁকি একটাই, তা হলো গর্ভাবস্থায় কেউ আক্রান্ত হলে। যেহেতু এর কোনো নির্দিষ্ট চিকিৎসা বা প্রতিষেধক টিকাও নাই, তাই সচেতনতা ও সম্মিলিত প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাটাই সবচেয়ে জরুরি।

ইতিহাস: ‘জিকা’ নামটি নেয়া হয়েছে উগান্ডার "জিকা" বন থেকে। ১৯৪৭ সালে জ্বর নিয়ে গবেষণার জন্য বিজ্ঞানীরা জিকা বনে একটি বানরকে খাঁচায় আটকে রাখে। ১৯৪৮ সালেও গবেষণার জন্য আরেকটি বানরকে আটকে রাখে। পরে বানরগুলো জ্বরে আক্রান্ত হলে তাদের দেহে একটি সংক্রামক এজেন্টের উপস্থিতি শনাক্ত করা হয়। ১৯৫২ সালে এর নাম দেয়া হয় "জিকা ভাইরাস"। এরপর ১৯৫৪ সালে নাইজেরিয়ায় এক মানুষের দেহে এই ভাইরাস পাওয়া যায়। ১৯৫১ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে এই ভাইরাস সংক্রমণের তথ্য পাওয়া যায়।

২০০৭ সালে প্রথম বড় ধরনের প্রাদুর্ভাব পরিলক্ষিত হয় মাইক্রোনেশিয়ার ইয়াপ দ্বীপে। এখন পর্যন্ত জিকা ভাইরাসে সবচেয়ে মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হয়েছে ব্রাজিলের কিছু কিছু এলাকায়। ব্রাজিলের পর সবচেয়ে বেশি সংক্রমণের ঘটনা ঘটেছে কলম্বিয়াতে। এরপর ধীরে ধীরে সংক্রমণের খবর আসে ইকুয়েডর, এল সালভেদর, জামাইকা ও পুয়ের্তো রিকোতে। পরবর্তীকালে রোগটি আফ্রিকা ও এশিয়া মহাদেশেও ছড়িয়ে পড়ে। এছাড়া ইউরোপ আর উত্তর আমেরিকাতেও ছড়িয়ে পড়ে সংক্রমণের ঘটনা। সেখানে ভাইরাসে আক্রান্ত কয়েক ডজন রোগী শনাক্ত করা হয়।

২০০৯ সালে এক মার্কিন জীববিজ্ঞানী তার এক সহকর্মী সহ মশার উপর গবেষণার কাজে সেনেগালের এক গ্রাম থেকে মশা সংগ্রহ করছিলেন। ঐ সময় তিনি মশার কামড়ের শিকার হয়েছিলেন এবং ৫ দিন পর যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে অসুস্থবোধ করেন। কিছুদিন পর প্রোস্টেট গ্ল্যান্ডের প্রদাহ শুরু হলে, তার সিমেন বা শুক্র পরীক্ষা করে রক্ত পাওয়া যায়। এর কয়েক সপ্তাহ পর তার স্ত্রীও এই রোগে আক্রান্ত হন। ধারণা করা হয়, শারীরিক সম্পর্কের মাধ্যমে স্ত্রীর শরীরেও এই ভাইরাস ছড়িয়েছে। পরে তাঁদের দুজনই জিকা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন বলে শনাক্ত করা হয়। এরপর তাহিতিতে ৪৪ বছর বয়সী এক পুরুষের সিমেনেও জিকা ভাইরাসের অস্তিত্ব পাওয়া যায়।

কীভাবে ছড়ায়: এটি আসলে ভাইরাস বাহিত এডিস মশার কামড়ে হয়ে থাকে। সাধারণত দিনের বেলায় সুস্থ ব্যক্তিকে মশার কামড়ের মাধ্যমে ভাইরাসটি মানুষের শরীরে ছড়িয়ে পড়ে এবং তখন ঐ ব্যক্তি আক্রান্ত হয়। আবার ঐ ব্যক্তিকে অন্য এডিস মশা কামড়ালে, সেই মশার মধ্যে ভাইরাস প্রবেশ করে এবং ঐ মশাটিও অন্য সুস্থ ব্যক্তিকে কামড়ালে সেও আক্রান্ত হয়। এভাবেই ভাইরাসটি মশার কামড়ের মাধ্যমে মানুষ থেকে মানুষের মধ্যে বিস্তার ঘটে। তবে সরাসরি মানুষ থেকে মানুষের সংস্পর্শে এ ভাইরাস ছড়ায় না। এছাড়াও মানুষের শুক্রানুতে এই ভাইরাসের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় বিধায় অরক্ষিত যৌন সম্পর্কের মাধ্যমেও এই ভাইরাস ছড়াতে পারে। রক্ত সংক্রমণ এবং গর্ভাবস্থায় মা থেকে গর্ভস্থ শিশুর শরীরে এই ভাইরাস সংক্রমিত হতে পারে।

রোগের লক্ষণ: যে কোনো বয়সের লোকে এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে। জিকার লক্ষণ ডেঙ্গুর মতোই। তবে জিকা ভাইরাসের ৮০ শতাংশ সংক্রমণেই কোনো লক্ষণ প্রকাশ নাও পেতে পারে। ২০% রোগীর কিছু উপসর্গ দেখা যায়। আক্রান্ত হওয়ার সাথে সাথে কোনো লক্ষণ প্রকাশ পায় না। সংক্রমণের ৩ থেকে ১৪ দিন পরেই লক্ষণগুলো প্রকাশ পায়। ভাইরাসটি শরীরের মধ্যে ১০ থেকে ১২ দিন সুপ্ত অবস্থায়ও থাকতে পারে।

এ ভাইরাসে আক্রান্ত হলে জ্বর, লাল র্যাশ বা ফুসকুড়ি, শরীর ও হাড়ের জোড়ায় ব্যথা, চোখের প্রদাহ (কনজাংটিভাইটিস) এবং চোখের পিছনে ব্যথা, মাংসপেশী ও মাথা ব্যথা, ক্ষুধামন্দা ইত্যাদি। ডেঙ্গু জ্বরের মতো রক্তের ল্যাটিলেট কমে না, এমনকি রক্তাকরণের ঝুঁকিও নাই। এ রোগের সবচেয়ে ভয়াবহ দিক হলো গর্ভাবস্থায় মা আক্রান্ত হলে প্রসব করা শিশুর "মাইক্রোসেফালি" বা মাথার আকার ছোট হয়, ফলে মস্তিষ্ক অপুষ্ট ও অবিকশিত অবস্থায় থাকে।

রোগটিকি ঝুঁকিপূর্ণ? ডেঙ্গুর মতো এ রোগটি তীব্র ও প্রাণঘাতী নয়। এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর ঝুঁকি একেবারেই নাই।

সবচেয়ে ঝুঁকিতে গর্ভবতী নারীরা: জিকা অন্য ভাইরাসের মত তেমন মারাত্মক নয়। তবে গর্ভাবস্থায় আক্রান্ত হলে মায়ের কাছ থেকে গর্ভস্থ শিশুর শরীরে সংক্রমণের আশঙ্কা থাকে, গর্ভস্থ শিশুর ‘মাইক্রোসেফালি’ রোগ হওয়ার কারণে মাথা ছোট হয়ে থাকে এবং শিশুদের মস্তিষ্কের গঠন ঠিকমতো হয় না। ফলে শিশুর বুদ্ধি প্রতিবন্ধী হওয়া, শারীরিক বৃদ্ধি অস্বাভাবিক বা বিলম্বিত হওয়া থেকে শুরু করে অকালে মারা যাওয়ার আশঙ্কাও বেড়ে যায় ।

জিকা ভাইরাস কীভাবে নির্ণয় করা যায়: লক্ষণ, ভ্রমণের ইতিহাস এবং ল্যাব পরীক্ষার উপর ভিত্তি করে রোগ নির্ণয় করা হয়। রক্ত এবং প্রস্রাব পরীক্ষা করে সরাসরি ভাইরাস শনাক্ত করা যায়।

গর্ভবতী মহিলাদের ভ্রূণের অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য আল্ট্রাসাউন্ড এবং অ্যামনিওসেন্টেসিস করা হয়।

চিকিৎসা: নির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা নাই, লক্ষণ ভিত্তিক চিকিৎসা দেওয়া হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ৫ থেকে ১০ দিনের মধ্যে রোগী এমনিতেই ভালো হয়। পর্যাপ্ত পরিমাণে বিশ্রাম গ্রহণ, জ্বরের জন্য প্যারাসিটামলের পাশাপাশি প্রচুর পরিমাণে পানি ও তরল খাবার খেতে হবে। গর্ভবতী মায়ের প্রতি বাড়তি সতর্কতা প্রয়োজন। পরীক্ষা-নীরিক্ষার মাধ্যমে গর্ভস্থ সন্তানের মাথার অবস্থা জানা সম্ভব এবং বাচ্চা সংকটাপন্ন হলে মহিলা ও প্রসূতি বিশেষজ্ঞের মতামত নিতে হবে।

প্রতিকার ও প্রতিরোধ: এ ভাইরাসের কোনো প্রতিষেধক টিকা তৈরি হয়নি। প্রতিরোধের মূলমন্ত্রই হলো এডিস মশার বিস্তার রোধ এবং নিয়ন্ত্রণ। মশা নিধন করার ব্যবস্থা করতে হবে। মশার প্রজননস্থল ধ্বংস করতে হবে, কোথাও যাতে পানি জমে না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। যেহেতু একই মশার কামড় থেকে জিকা, চিকুনগুনিয়া, ডেঙ্গু ছড়ায়, তাই সব ক্ষেত্রেই মশার কামড় থেকে বাচার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে এবং এভাবেই এক ঢিলে তিন পাখি মারা সম্ভব।

(১) মশার কামড় থেকে রক্ষা পেতে স্প্রে করতে হবে, দিনে ও রাতে মশারি টানিয়ে ঘুমাতে হবে। ঘরবাড়ি পরিষ্কার রাখার ব্যাপারে আরো সচেতন হতে হবে। নিজ ঘরের বাইরে মশার প্রজননস্থল গুলো ধ্বংস করার ব্যাপারে সচেষ্ট হতে হবে।

(২) বাচ্চাদের ফুলপ্যান্ট ও ফুলহাতা জামা মোজা পরতে হবে।

(৩) জনগণের মাঝে জিকা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, স্কুলকলেজ ও কমিউনিটি সেন্টারে সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন চালানো উচিত। ডেঙ্গু বা চিকুনগুনিয়ার উপসর্গ থাকলে সন্দেহভাজন রোগীর জিকা পরীক্ষা করার ব্যবস্থা করতে হবে। গর্ভবতী নারীদের ক্ষেত্রে সচেতনতা খুবই জরুরি।

(৪) বিদেশে থেকে যারা বাংলাদেশে আসছেন, তাদের দিকে নজর রাখতে হবে। বিশেষ করে যে-সব দেশে এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে, তাদের কেউ আক্রান্ত হলে সেই অবস্থায় ভ্রমণ না করাই ভালো।

এ কথা সত্য যে, জিকা কোনো জটিল রোগ নয়। এ রোগে মৃত্যুর ঝুঁকি একেবারেই নাই। ইতিপূর্বে আক্রান্তদের পরবর্তীতে কোনো ক্ষতিকর প্রভাবও পাওয়া যায় না, যা ডেঙ্গু বা চিকুনগুনিয়ার বেলায় হতে পারে। এমনকি একবার আক্রান্ত হলে দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হবার ঝুঁকিও নাই। তাই তেমন কোনো এন্টি ভাইরাল ওষুধ বা টিকাও আবিষ্কৃত হয়নি। শুধু ঝুঁকি একটাই, তা হলো গর্ভাবস্থায় কেউ আক্রান্ত হলে। যেহেতু এর কোনো নির্দিষ্ট চিকিৎসা বা প্রতিষেধক টিকাও নাই, তাই সচেতনতা ও সম্মিলিত প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাটাই সবচেয়ে জরুরি।

লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক।

এইচআর/এএসএম

Read Entire Article