‘বহুমুখী রপ্তানির মাধ্যমে অর্থনীতি শক্তিশালী করা সম্ভব’

4 hours ago 7

বর্তমান বিশ্ব অর্থনীতিতে বহুমুখী রপ্তানি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠছে। বিশ্ব বাণিজ্য ব্যবস্থা ক্রমাগত পরিবর্তিত হচ্ছে এবং কোনো একটি নির্দিষ্ট পণ্য বা বাজারের ওপর নির্ভরতা মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। তাই, অর্থনীতিকে স্থিতিশীল ও শক্তিশালী করতে বহুমুখী রপ্তানির কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

তাদের মতে, প্রতিনিয়ত গ্রাহকের চাহিদা এবং প্রযুক্তি দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। নতুন নতুন পণ্য ও সেবার চাহিদা সৃষ্টি হচ্ছে। যদি কোনো দেশের রপ্তানি শুধু একটি পুরনো পণ্যের ওপর নির্ভরশীল থাকে, তাহলে তারা এই পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মেলাতে পারে না। বহুমুখী রপ্তানি একটি দেশকে নতুন ও উদীয়মান খাতে বিনিয়োগ এবং নিজেদের সময়ের সঙ্গে মানিয়ে নিতে উৎসাহিত করে।

শুধু তাই নয়, পুরোনো ও প্রচলিত বাজারগুলো প্রায়শই প্রতিযোগিতায় পূর্ণ থাকে। বহুমুখী রপ্তানি একটি দেশকে নতুন নতুন দেশ এবং অঞ্চলে তাদের পণ্য ও সেবা রপ্তানি করার সুযোগ দেয়। এতে করে তারা কম প্রতিযোগিতামূলক বাজারে প্রবেশ করতে পারে এবং নিজেদের জন্য নতুন প্রবৃদ্ধির পথ তৈরি করতে পারে।

তারা বলছেন, যখন একটি দেশ বিভিন্ন ধরনের পণ্য এবং সেবা উৎপাদন ও রপ্তানি করে, তখন অর্থনীতিতে নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়, প্রযুক্তির প্রসার ঘটে এবং সামগ্রিক অর্থনৈতিক কাঠামো আরও মজবুত হয়। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য বহুমুখী রপ্তানি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাসঙ্গিক।

বর্তমানে বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮০ শতাংশ আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে, যা আমাদের অর্থনীতির বড় একটি শক্তি। কিন্তু আমাদের এই পোশাক খাতের পাশাপাশি তথ্যপ্রযুক্তি, ফার্মাসিউটিক্যালস, চামড়াজাত পণ্য এবং কৃষিপণ্যের মতো উদীয়মান খাতগুলোকে রপ্তানির জন্য উৎসাহিত করা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

বহুমুখী রপ্তানি নিশ্চিত করতে পারলে দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি আরও শক্তিশালী হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে রপ্তানি বহুমুখীকরণ একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া বলে মত তাদের। এর জন্য প্রয়োজন সরকারি নীতি সহায়তা, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, নতুন নতুন পণ্যের গবেষণা ও উন্নয়ন এবং দক্ষ জনশক্তি তৈরি করা।

দেশের অভ্যন্তরে যদি সরকারের অর্থনৈতিক নীতি ঘন ঘন পরিবর্তিত হয়, তাহলে বিনিয়োগকারীরা নতুন শিল্পে বিনিয়োগ করতে উৎসাহিত হন না। যা রপ্তানি বহুমুখীকরণের পথে বাধা সৃষ্টি করে থাকে। রপ্তানি বহুমুখীকরণ একটি দেশের অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা ও প্রবৃদ্ধির জন্য অপরিহার্য বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।

তাদের মতে, এর সফল বাস্তবায়নের জন্য সরকারকে কৌশলগত পরিকল্পনা, বিনিয়োগ এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা নিশ্চিত করতে হবে।

বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন এ প্রসঙ্গে বলেন, প্রাথমিকভাবে এরইমধ্যে ৩ হাজার ১০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রস্তাব এসেছে। বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নয়নে আরও ৩১টি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বিনিয়োগকারীদের যৌক্তিক চাহিদার ভিত্তিতে আংশিক রপ্তানিকারকদের জন্য বন্ড সুবিধাসহ বিভিন্ন নীতিসহায়তার প্রস্তাব নিয়ে কাজ করছি। সরকারের সমন্বিত প্রচেষ্টায় এই সুবিধা কার্যকর হলে তৈরি পোশাক বহির্ভূত খাতের রপ্তানি বৃদ্ধি, বৈচিত্র্যকরণ ও দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে।

চৌধুরী আশিক মাহমুদ আরও বলেন, বিশ্বজুড়ে অধিকাংশ হালাল পণ্যই অমুসলিম দেশগুলো উৎপাদন করে থাকে। এটি আমাদের মতো মুসলিম প্রধান দেশের জন্য দুঃখজনক। তবে এ পরিস্থিতি আমাদের জন্য বড় একটি সুযোগও। সঠিক নীতিমালা ও কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশ এ খাতে সাফল্যের সঙ্গে নিজের অবস্থান সুদৃঢ় করতে পারে। এক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে নীতিগত সহায়তা দেওয়া হবে।

শওকত আজিজ রাসেল বলেন, রপ্তানি বহুমুখীকরণ বাংলাদেশের জন্য সব সময় একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। কয়েক দশক ধরে আমরা এ বিষয়গুলো বলে আসছি। আসলে রপ্তানিতে পোশাক শিল্পের মতো অন্যান্য খাত সমৃদ্ধ করতে হলে নীতিগত সহায়তা বেশি প্রয়োজন। এ বছর প্রায় ৬ হাজার ৫০০ কোটি ডলারের রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। একদিকে বিশাল লক্ষ্যমাত্রা, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক ও এলডিসি উত্তরণের মতো চ্যালেঞ্জও রয়েছে।

তিনি বলেন, এসব বিষয় মাথায় রেখেই আমাদের কৌশল ও করণীয় নির্ধারণ করতে হবে। এজন্য সবার আগে প্রয়োজন অবকাঠামো খাত উন্নয়ন করা। বিশেষ করে, গ্যাস-বিদ্যুতের সরবরাহ নিশ্চিত করা, ব্যাংক সুদের হার কমানো এবং বন্দরের অবকাঠামো দ্রুত উন্নয়ন করতে হবে।

ল্যাবএইড ক্যান্সার হাসপাতাল অ্যান্ড সুপার স্পেশালিটি সেন্টারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাকিফ শামীম বলেন, বিশ্ব বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমাদেরও নতুন নতুন পণ্য উৎপাদন ও বাজারজাতকরণে উদ্যোগ নিতে হবে। এখন চতুর্থ শিল্প বিপ্লব চলছে এবং তথ্য ও জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতির যুগ শুরু হয়েছে। আমাদেরও বৈশ্বিক চাহিদা মাথায় রেখে পণ্য উৎপাদন, রপ্তানি ও নতুন বাজারের অনুসন্ধান করতে হবে। শুধু পোশাকশিল্পের ওপর নির্ভরশীল হওয়ার এখন আর কোনো সুযোগ নেই। এর বাইরে তথ্য প্রযুক্তি, সফটওয়্যার, ফার্মাসিউটিক্যালস পণ্য, হালকা প্রকৌশল, চামড়া, পাট, কৃষিজাত পণ্য এবং মৎস্য উপাদন ও রপ্তানিতে জোর দেওয়া প্রয়োজন।

তিনি বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এআই আউটসোর্সিং, ফ্রিল্যান্সার, বিপিও একটি নতুন সুযোগের নাম। এআই টুলস দেশের তরুণ কর্মীদের টেকনিক্যাল দক্ষতা ও ইংরেজি পারদর্শিতা বাড়াচ্ছে। এরইমধ্যে রপ্তানিতে এআই এর সুফল দেখা যাচ্ছে। এ বছরই প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ বিপিও ও আইটিইএস খাত থেকে ১০০ কোটি ডলারের বেশি রপ্তানি আয় করতে যাচ্ছে। তবে এশিয়ার জায়ান্ট ভারত ও ফিলিপাইনের সঙ্গে তুলনা করলে এটি এখনও নগণ্য।

তিনি আরও বলেন, বিশ্বব্যাপী আউটসোর্সিংয়ে ভারতের আধিপত্য রয়েছে। আইটি ও আইটি সংশ্লিষ্ট পরিষেবার বাজারে গত বছর ভারতের আয় প্রায় ২০ হাজার কোটি ডলার। অন্যদিকে, ফিলিপাইন বিপিও, বিজনেস প্রসেস ম্যানেজমেন্ট (বিপিএম) ও আইটিইএস থেকে প্রায় ৭৫০০ কোটি ডলার আয় করেছে। আউটসোর্সিংয়ে সারা পৃথিবীতে প্রতি পাঁচজনের একজন ভারতীয় নাগরিক। অথচ আমরা এখনও এই ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে আছি।

সাকিফ শামীম বলেন, ফার্মাসিউটিক্যালস, হালকা প্রকৌশলসহ সব জায়গায় আমাদের গবেষণা (আরএনডি) বাড়াতে হবে। এর মাধ্যমে আমরা মৌলিক ওষুধ উৎপাদন ও রপ্তানি করতে পারবো।

তিনি বলেন, ওষুধ এত বড় একটি শিল্প, অথচ এ খাতে কোনো ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজ শিল্প নেই। এটা ভারতে বিপুল পরিমাণ রয়েছে। ওষুধ শিল্পে গবেষণা ও উন্নয়নের (আরএনডি) ওপর জোর দিতে হবে। কারণ, এটি নতুন ও উন্নত ওষুধ আবিষ্কার, অপূর্ণ চিকিৎসা চাহিদা পূরণ, স্বাস্থ্যসেবার মান বৃদ্ধি এবং জনস্বাস্থ্যকে শক্তিশালী করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এর মাধ্যমে দেশ ওষুধ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে পারে, আমদানি নির্ভরতা কমাতে পারে এবং বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান তৈরি করতে পারে।

তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ বর্তমানে এলডিসি (স্বল্পোন্নত দেশ) হিসেবে পেটেন্ট সুবিধা ভোগ করছে, যা ২০৩৩ সাল পর্যন্ত থাকবে। এই সময়ের মধ্যে গবেষণা ও উন্নয়নে জোর দিয়ে নিজেদের সক্ষমতা বাড়াতে পারলে, পরবর্তীতে রয়্যালটি প্রদান করে ওষুধ উৎপাদনের খরচ বাড়ার যে আশঙ্কা আছে, তা মোকাবিলা করা সহজ হবে। এছাড়া দেশীয় গবেষণা ও উন্নয়নের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মানের ওষুধ উৎপাদন করে বিশ্ববাজারে নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করা এবং রপ্তানি বাড়ানো সম্ভব।

বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য রপ্তানি বহুমুখীকরণ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মন্তব্য করে তিনি বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের সিংহভাগই আসে তৈরি পোশাক শিল্প থেকে, যা আমাদের অর্থনীতির বড় একটি শক্তি। তবে আমাদের এই পোশাক খাতের পাশাপাশি অন্য খাতগুলোতেও বিশেষ নজরদারি করা প্রয়োজন। যাতে বাংলাদেশের নতুন রপ্তানি পণ্য ও বাজার খুঁজে বের করা যায়।

সাকিফ শামীম বলেন, তৈরি পোশাকের পর পাট ও পাটজাত পণ্য, মৎস্য খাত, হোম টেক্সটাইল, চামড়া এবং চামড়াজাত পণ্য, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, প্রকৌশল পণ্য ও হিমায়িত খাদ্য- এগুলোই বাংলাদেশের শীর্ষ রপ্তানি খাত। বর্তমানে পোশাকশিল্পে যে বন্ডেড ওয়্যারহাউস লাইসেন্স-সুবিধা রয়েছে, তা রপ্তানিযোগ্য অন্যান্য সব পণ্যের ক্ষেত্রেও একইভাবে নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এলডিসি থেকে উত্তরণের পরবর্তী সময়ে আরও চ্যালেঞ্জ সামনে আসবে। বিশ্বের যেসব দেশ পণ্য রপ্তানি বহুমুখীকরণ করতে পেরেছে, তারা প্রত্যেকেই দেশি-বিদেশি যৌথ বিনিয়োগের মাধ্যমে করেছে। আমাদেরও সেই পথেই যেতে হবে। কারণ, বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো উন্নত প্রযুক্তি নিয়ে আসে। ফলে তারা পণ্য রপ্তানিতে ভালো দাম পায়।

এমএএস/এএমএ

Read Entire Article