‘সে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আনন্দের সঙ্গে কাজ করে গেছে। সকাল, দুপুর, এমনকি রাতে পর্যন্ত ল্যাপটপে লেখালেখি করতো। কিন্তু মৃত্যুর আগের ছয় মাসে কিছুই লিখতে পারেনি। এমনকি কম্পিউটারের কি-বোর্ডের অক্ষরগুলোও ভুলে গিয়েছিল। সে বলতো, ‘যেদিন লিখতে পারবো না, সেদিন আমি চলে যাবো’ ঠিক তাই-ই হয়েছে।’
কথাগুলো বলছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন লেখক, গবেষক, মুক্তবুদ্ধি চর্চার অগ্রসৈনিক এবং বঙ্গবিদ্যাবিশারদ অধ্যাপক গোলাম মুরশিদের স্ত্রী এলিজা মুরশিদ।
অধ্যাপক গোলাম মুরশিদের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে শনিবার (২৩ আগস্ট) ভার্চুয়াল জুম প্ল্যাটফর্মে একটি বিশেষ স্মরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সেখানে লন্ডন থেকে যুক্ত হয়ে আবেগঘন এসব কথা বলেন এলিজা মুরশিদ।
এলিজা মুরশিদ জানান, গোলাম মুরশিদ ডিমেনশিয়া ও পারকিনসন্সে ভুগছিলেন এবং শেষের দিকে তার আত্মজীবনী শেষ করতে না পারার দুঃখ তিনি প্রকাশ করেন।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব ও সঞ্চালনা করেন তার ছাত্র, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. এম. এ. সাত্তার মণ্ডল। সভাপতির বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘তাকে স্মরণ করা আমাদের মনোজাগতিক শক্তি বাড়ায়।’
ষাটের দশকের নানা স্মৃতি তুলে ধরে ড. সাত্তার মণ্ডল বলেন, ‘আমি সৌভাগ্যবান, তার প্রথম দিককার ছাত্রদের একজন হতে পেরেছিলাম। তার জীবনাচরণ, ভাষা, উচ্চারণ এবং জ্ঞানের বহর তরুণ বয়সে আমাকে প্রবলভাবে প্রভাবিত করেছিল।’
তিনি অধ্যাপক মুরশিদের অসমাপ্ত আত্মজীবনী যৌথভাবে পরিমার্জিত সংকলন হিসেবে এবং স্মৃতিকথাগুলো নিয়ে একটি সম্পাদিত স্মারকগ্রন্থ প্রকাশের জন্য প্রস্তাব রাখেন।
অনুষ্ঠানে যুক্ত হয়ে গোলাম মুরশিদের গ্রন্থ ‘হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি’র অনুবাদক শর্বরী সিনহা বলেন, ‘বাংলা সংস্কৃতি নিয়ে অনেক লেখা হলেও এই একটি বই বাংলা সংস্কৃতিকে সামগ্রিকভাবে বুঝতে সাহায্য করে। তিনি আমাকে বহুভাবে সমৃদ্ধ করেছেন।’
রিডিং ক্লাব ট্রাস্টের প্রধান নির্বাহী জুলফিকার ইসলাম বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক লেকচারের সূচনা হয়েছিল গোলাম মুরশিদ স্যারের অনুপ্রেরণায় ও তাকে সঙ্গে নিয়ে।’
গোলাম মুরশিদের বড় বোন ফিরোজা আহমেদ লিলি কানাডা থেকে যুক্ত হয়ে বলেন, ‘তিনি শুধু লেখক নন, ছিলেন ক্রীড়াপ্রেমীও। বিশেষ করে ক্রিকেটে দারুণ আগ্রহী ছিলেন। আমি বিশ্বাস করি, যতদিন বাংলা সাহিত্য থাকবে, ততদিন বড়দাও থাকবেন।’
রাজশাহী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক সৈয়দ জহির সাদেক বলেন, ‘তার লেখা ‘রেনেসাঁস’ বইটি আমাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। তিনি ছিলেন মতানৈক্যের প্রতিও শ্রদ্ধাশীল একজন প্রকৃত গবেষক।’
আবৃত্তিশিল্পী ডালিয়া দাস বলেন, ‘কাজই ছিল তার পরিচয়। তিনি আন্তরিকভাবে যা বিশ্বাস করতেন, তা-ই করতেন। দেশের প্রতি তার অগাধ ভালোবাসা ছিল।’ তার নামে একটি বৃত্তি চালুর প্রস্তাবও তিনি রাখেন।
অনুষ্ঠানে মানবাধিকারকর্মী হামিদা হোসেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি এবং জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, স্কটল্যান্ডসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আত্মীয়স্বজন, ছাত্রছাত্রী, পাঠক ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা অংশ নেন।
প্রভা অরোরার প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিধান চন্দ্র পাল আয়োজকদের পক্ষ থেকে বলেন, ‘গোলাম মুরশিদকে খুব কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। তিনি যা করতেন মনপ্রাণ দিয়ে করতেন। তার জীবনদর্শন ও আদর্শ তরুণ সমাজের জন্য অনুকরণীয়। আমরা আগামী বছর থেকে তাকে ঘিরে আরও বড় পরিসরে স্মরণ আয়োজন করার পরিকল্পনা করছি।’
অধ্যাপক গোলাম মুরশিদ ছিলেন একজন শিক্ষক, বেতার সাংবাদিক, কলাম লেখক এবং সর্বোপরি একজন মানবতাবাদী চিন্তাবিদ। তিনি জন্মগ্রহণ করেন বাংলাদেশের এক গ্রামে, কিন্তু তার কর্মজীবনের বড় সময় কেটেছে লন্ডন ও মেলবোর্নে। শিক্ষকতা করেছেন ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়, লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের এসওএএস এবং নর্থ ওয়েস্টমিনস্টার ইউনিভার্সিটিতে। পরে প্রায় ১৯ বছর বিবিসি লন্ডনে বেতার সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেছেন। গত বছরের ২২ আগস্ট লন্ডনে তিনি মৃত্যুবরণ করেন এবং সেখানেই তাকে সমাহিত করা হয়।
বিএ