জুলাই যোদ্ধা ও বিকেএসপি

৩৬ জুলাই বাংলাদেশের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়। এ দেশের ছাত্র-ছাত্রী, তরুণ-তরুণী, শ্রমিক, কৃষক, গৃহবধূ এবং শিক্ষক-শিক্ষিকাসহ সর্বস্তরের সাধারণ মানুষ প্রমাণ করেছেন যে, তারা চাইলে পর্বতসম বাধা অতিক্রম করতে পারে। হাজার হাজার মানুষের জীবন উৎসর্গ এবং অগণিত মানুষের কম-বেশি আহত হওয়ার মধ্য দিয়ে আমরা পাই একটি নতুন সকাল, একটি নতুন সূর্যকে। আর আমি ঠিক সেই সময়ে, অর্থাৎ ২৭ আগস্ট বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের (বিকেএসপি) মহাপরিচালক হিসেবে যোগদান করি। যোগদানের পরই দেখতে পাই বিকেএসপি ক্যাডেটদের মাঝে ভালো কিছু করার দৃঢ় প্রত্যাশা। তবে মাঝে মাঝে কিছু কিছু ক্যাডেট বিভিন্ন কারণে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। যেমন- ইনজুরি সমস্যা, অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে ব্যর্থ হওয়া, ক্রীড়া ক্ষেত্রে আশানুরূপ ফল না পাওয়া, বিভিন্ন কারণে জাতীয়/বিকেএসপি দলে নিজ অন্তর্ভুক্তিতে ব্যর্থতা ইত্যাদি। আর এসব দেখে এক ভিন্নধর্মী চিন্তা আসে মাথায়। যোগাযোগ করি ব্র্যাক রিহ্যাব সেন্টারের সঙ্গে।  এখানে আহত জুলাই যোদ্ধারা, যারা হাত-পা হারিয়েছেন, তাদের কৃত্রিম অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে নিয়ে আসার চেষ্টা হচ্ছিল। আমি তাদের সঙ্গে কথা বলে ১১

জুলাই যোদ্ধা ও বিকেএসপি

৩৬ জুলাই বাংলাদেশের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়। এ দেশের ছাত্র-ছাত্রী, তরুণ-তরুণী, শ্রমিক, কৃষক, গৃহবধূ এবং শিক্ষক-শিক্ষিকাসহ সর্বস্তরের সাধারণ মানুষ প্রমাণ করেছেন যে, তারা চাইলে পর্বতসম বাধা অতিক্রম করতে পারে। হাজার হাজার মানুষের জীবন উৎসর্গ এবং অগণিত মানুষের কম-বেশি আহত হওয়ার মধ্য দিয়ে আমরা পাই একটি নতুন সকাল, একটি নতুন সূর্যকে। আর আমি ঠিক সেই সময়ে, অর্থাৎ ২৭ আগস্ট বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের (বিকেএসপি) মহাপরিচালক হিসেবে যোগদান করি। যোগদানের পরই দেখতে পাই বিকেএসপি ক্যাডেটদের মাঝে ভালো কিছু করার দৃঢ় প্রত্যাশা। তবে মাঝে মাঝে কিছু কিছু ক্যাডেট বিভিন্ন কারণে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। যেমন- ইনজুরি সমস্যা, অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে ব্যর্থ হওয়া, ক্রীড়া ক্ষেত্রে আশানুরূপ ফল না পাওয়া, বিভিন্ন কারণে জাতীয়/বিকেএসপি দলে নিজ অন্তর্ভুক্তিতে ব্যর্থতা ইত্যাদি। আর এসব দেখে এক ভিন্নধর্মী চিন্তা আসে মাথায়। যোগাযোগ করি ব্র্যাক রিহ্যাব সেন্টারের সঙ্গে। 

এখানে আহত জুলাই যোদ্ধারা, যারা হাত-পা হারিয়েছেন, তাদের কৃত্রিম অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে নিয়ে আসার চেষ্টা হচ্ছিল। আমি তাদের সঙ্গে কথা বলে ১১ অক্টোবর ৭ কৃত্রিম হাত-পা সংযোজিত জুলাই যোদ্ধাকে একদিনের জন্য বিকেএসপিতে আমন্ত্রণ করে নিয়ে আসি। এই জুলাই যোদ্ধারা আমাদের অডিটরিয়ামে তাদের জীবনের কথা, যুদ্ধের কথা, আহত হওয়ার পরে চরম হতাশা, পরবর্তীতে আবার বাঁচার আশা নিয়ে ঘুরে দাঁড়াবার অদম্য ইচ্ছার কথা শোনায়। আমাদের ক্যাডেটরা মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় জুলাই যোদ্ধাদের হার না মানার গল্প শুনে উজ্জীবিত হয়ে ওঠে। 
এই ৭ জনের মধ্যে ছিলেন-  ছাত্র, ছোট ব্যবসায়ী, খুদে দোকানদার, গার্মেন্টস শ্রমিক, রেন্ট-এ-কার ড্রাইভার। 

এখানে মহাপরিচালক হিসেবে আমার লক্ষ্য ছিল বিকেএসপির ক্যাডেটরা যেন অল্পতে ভেঙে না পড়ে, হতোদ্যম না হয়ে যায়, বিষণ্নতায় না ডুবে। বরং জুলাই যোদ্ধাদের গল্প শুনে যেন বিকেএসপি ক্যাডেটরা দেশকে আরও বেশি ভালোবাসতে শিখে, দেশের জন্য বড় কিছু করার স্পৃহা জেগে উঠে। সর্বোপরি দেশকে আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গন থেকে সাফল্য এনে দিতে পারে। দিন শেষে চলে যাওয়ার সময় একজন যোদ্ধা আমাকে প্রশ্ন করলেন যে, তারা কি প্যারা অলিম্পিকে অংশগ্রহণ করতে পারবে? এখান থেকেই আমার দ্বিতীয় পরিকল্পনা শুরু।

আমি আমার পরিচালকের (প্রশিক্ষণ) সঙ্গে কথা বলে আমার দ্বিতীয় পরিকল্পনার কথা আলোচনা করি। এই অধ্যায়ে আমি আর্চারি, টেবিল টেনিস ও শ্যুটিংকে বেছে নেই। একজন হাত-পা হারানো ব্যক্তি এই তিন খেলা সহজে রপ্ত করতে পারবে। আমরা প্রতিটি খেলার জন্য ৪ জন হিসেবে মোট ১২ জুলাই যোদ্ধা নিয়ে বিকেএসপিতে ৩ মাসের প্রশিক্ষণ পরিকল্পনা করি। প্রথম ১ মাস Foundation Training, পরবর্তী ২ মাস Advanced training। সে অনুযায়ী আমরা যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করি ১০ লাখ ৩২ হাজার টাকার বাজেট প্রাপ্ত হই। এখানে প্রশিক্ষণের জন্য আসা যোদ্ধাদের খাবার, বাসস্থান, যাতায়াত বিকেএসপি কর্তৃক বহন করা হয় এবং প্রতিদিন ৪০০/- টাকা হিসেবে পকেট ভাতা প্রদান করা হয়। এভাবেই Foundation Training শেষে বর্তমানে বিকেএসপিতে দুই নারীসহ ১২ জনের Advanced training চলছে।

এবার জানা যাক, এই ১২ জুলাই যোদ্ধার সাহসিকতা, দেশপ্রেম ও কিছু মানুষের পৈশাচিকতার কাহিনি। ওর নাম আমানউল্ল্যাহ, বাড়ি রাঙামাটি জেলার লংগদু উপজেলায়। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হিসেবে পরিবারকে সাহায্যের জন্য পড়ালেখার পাশাপাশি চট্টগ্রাম শহরের একটি হোটেলে ম্যানেজারের কাজ করতেন। ৩ আগস্ট চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লায় প্রথমবার বুলেটে আঘাতপ্রাপ্ত হন। পরবর্তীতে ৫ আগস্ট দুপুরের পরে বিজয় উল্লাস করার সময় কোতোয়ালি থানা এলাকায় বুলেটবিদ্ধ হন। সেখান থেকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ, বেসরকারি হাসপাতাল ঘুরে সর্বশেষ চট্টগ্রাম পাহাড়তলী চক্ষু হাসপাতালে ৭ বার দুই চোখের অপারেশন হলেও চোখের আলো ফিরে পাননি। 

আমজাদ হোসেন ১৯ জুলাই থেকে যাত্রাবাড়ী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। ৫ আগস্ট দুপুর ২টায় আনন্দ মিছিল করার সময় যাত্রাবাড়ীতে পায়ে এবং দুই চোখে গুলিবিদ্ধ হন। প্রথমে যাত্রাবাড়ী বেসরকারি হাসপাতাল, এরপর ঢাকা মেডিকেল কলেজ, শ্যামলী হেলথ কেয়ার হাসপাতাল, নোয়াখালীর গোল্ডেন হাসপাতাল, চট্টগ্রাম পাহাড়তলী হাসপাতাল, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ, পুনরায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ, জাতীয় চক্ষু হাসপাতাল, জাতীয় পঙ্গু হাসপাতালে পায়ের প্লাস্টিক সার্জারি এবং সবশেষে নিউরো হাসপাতালে মাথার অপারেশন করান। কিন্তু দুই চোখের জ্যোতি আর ফিরে আসেনি। 

আল আমিন, বয়স ১৮ বছর। রামপুরা এলাকায় আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে একাধিকবার রাবার ও ছররা বুলেটে আঘাতপ্রাপ্ত। সর্বশেষে ৫ আগস্ট বাম পায়ে গুলিবিদ্ধ হন। প্রচুর রক্তক্ষরণের পর বিভিন্ন হাসপাতালে ঠাঁই হয়নি। সবশেষে স্থান হয় পঙ্গু হাসপাতালে। কিন্তু অপারেশন করে তার পা কেটে ফেলতে হয়েছে। 

মোরসালিন, বয়স ১৭ বছর। গাজীপুর এলাকায় আন্দোলন করতে গিয়ে পায়ে গুলিবিদ্ধ হন ও পরবর্তীতে পা কেটে ফেলতে হয়। 

ইবাত হোসেন, বয়স ১৮ বছর। কালী কুমার ইনস্টিটিউট স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র। ১৯ জুলাই নরসিংদী বেলানগর জেলখানা মোড়ে দুই চোখসহ সারা শরীরে অসংখ্য গুলিবিদ্ধ হয়। প্রথমে নরসিংদী সদর হাসপাতাল, পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ এবং জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে, দুই চোখে মোট ছয়টি অপারেশন করা হয়। বর্তমানে বাম চোখ পুরোপুরি দৃষ্টিশক্তিহীন। ডান চোখে পাঁচ ফুটের মতো আবছা দেখতে পায়। 

মানসুরা, বয়স মাত্র ১৬ বছর। ১৮ জুলাই থেকে মাদারীপুর শহরে আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। এই দিনে দুই চোখ, মাথা ও সারা শরীর রাবার বুলেটে আঘাত প্রাপ্ত হন। অজ্ঞান অবস্থায় মাদারীপুর সদর হাসপাতাল হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ, পরবর্তীতে জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে বাম চোখে ২ বার অপারেশন হয়। বর্তমানে বাম চোখে খুব কম দেখতে পান। 

নুরজাহান আক্তার, ৪ আগস্ট দুপুর ২টা থেকে আড়াইটার দিকে যাত্রাবাড়ীতে ছোটোবোনকে নিয়ে প্রতিবাদ মিছিলে অংশগ্রহণ করেন। হঠাৎ করে শুরু হয় পুলিশের গুলি আর ইট-পাটকেল নিক্ষেপ। দুই বোন রাস্তায় পড়ে যান। ছোট বোনকে তুলতে গিয়ে নুরজাহান চোখ, হাত ও মাথায় গুলিবিদ্ধ হন। পরিস্থিতি এত খারাপ ছিল যে, হাসপাতালেও যেতে পারেননি। বিকেল ৫টার দিকে যাত্রাবাড়ীর বেসামরিক হাসপাতাল হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান। সবশেষ জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট। মোট ২ বার অপারেশন হয়েছে। এখন প্রতিদিন তার শরীর আরও খারাপ হয়ে যাচ্ছে। 

মেরাজউদ্দীন শ্রাবণ, ৫ আগস্ট গাজীপুরের কোনাবাড়ীতে চোখে গুলিবিদ্ধ হন। আনন্দমোহন কলেজে অনার্সের ছাত্র হলেও পরিবারের সচ্ছলতার জন্য গাজীপুরে একটি পোশাক কারখানায় কাজ করতেন। চোখে গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর মৃত ভেবে অন্যান্য লাশের সঙ্গে মর্গে ফেলে রাখা হয়। আমি তার কাছ থেকে শুনেছি, এক বীভৎস বর্ণনা, যা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। পরবর্তীতে ময়মনসিংহ হয়ে জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে চিকিৎসা চলছে। বর্তমানে এক চোখের জ্যোতি নেই, অন্য চোখটিও আঘাতপ্রাপ্ত। 

মিরাজ ইসলাম, বয়স ১৮ বছর। ৪ আগস্ট অন্য সবার সঙ্গে উপস্থিত হন পাবনার লতিফ টাওয়ারের সামনে। পুলিশের গুলি এসে পায়ে লাগে। ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালে পা কেটে ফেলতে হয়। পরবর্তীতে ব্র্যাক রিহ্যাব সেন্টারে কৃত্রিম পা লাগিয়ে দেওয়া হয়।  

রাকিব হাসান, বয়স ২০ বছর। ১৭ জুলাই থেকে নারায়ণগঞ্জের চিটাগাং রোড এলাকায় প্রতিবাদ মিছিলে অংশগ্রহণ করেন। ২০ জুলাই তিনি গুলিবিদ্ধ হন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হয়ে পঙ্গু হাসপাতালে তার পা কেটে ফেলতে হয়। 

এখন আসা যাক, এই প্রশিক্ষণ কর্মসূচির উদ্দেশ্য কী? আমাদের উদ্দেশ্য ১২ জনের মধ্য থেকে ন্যূনতম ২ জনকে ভবিষ্যতে প্যারা অলিম্পিকে অংশগ্রহণের জন্য গড়ে তোলা। পরবর্তীতে এ ধরনের আন্তর্জাতিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় জুলাই যোদ্ধাদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে সারা বিশ্বকে আমাদের জুলাই-আগস্টের ত্যাগ, সাহসিকতা ও বীরত্ব গাঁথাকে জানিয়ে দেওয়া। জাতি হিসেবে আমাদের শক্তি ও সামর্থ্যকে সারা বিশ্বের কাছে আরও মহিমান্বিত করা। 

জাতি হিসেবে আমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী অপ্রাপ্তি অনেক। এর কারণ কিছু সুবিধাভোগী হঠকারী ব্যক্তির কারণে জাতীয় সম্পদের হরিলুট, দেশের ও জনগণের অর্থের যথেচ্ছ অপচয়, কিছু দুশ্চরিত্রের সীমাহীন দুর্নীতি ও অর্থপাচার। এতকিছু Negative পরিচিতির মধ্যেও বিকেএসপি টিম স্বপ্ন দেখে দেশের জন্য কিছু Positive প্রচার। আমরা সারা বিশ্বকে জানিয়ে দিতে চাই যে, বাংলাদেশ স্বপ্ন দেখে ভালো কিছু করার, অন্ধকারময় চোখগুলো সূর্যের আলোর মতো ১৮ কোটি মানুষের চোখের জ্যোতি হয়ে ফিরে আসতে চায়, আমাদের আবার ঘুরে দাঁড়াবার স্বপ্ন দেখাতে চায়, কিছু বিবেকহীন, দুশ্চরিত্র মানুষদের বিবেককে জাগ্রত করতে চায়, অর্থলোভী মানুষদের লোভ সংরবরণ করার শিক্ষা দিতে চায়। আমাদের সবাইকে শুধু এই জ্যোতি হারানো মানুষদের চোখের ভাষাকে বুঝতে হবে হৃদয়ে ধারণ করতে হবে, নীতি এবং নৈতিকতা অনুযায়ী জীবন চালাতে হবে। তবেই একটি সুন্দর, সোনালি, সম্ভাবনাময় বাংলাদেশ গড়ে উঠবে এবং দুর্নীতিমুক্ত এক বাংলাদেশ গড়ে উঠবে।

লেখক : ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, এসজিপি, এসইউপি, পিএসসি, পিএইচডি ও মহাপরিচালক-বিকেএসপি।

What's Your Reaction?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow