জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের সময় রাজধানীর চাঁনখারপুলে পুলিশের গুলিতে শহীদ দশম শ্রেণির ছাত্র শাহরিয়ার খান আনাসের বাবা শাহরিয়ার খান পলাশ প্রথম সাক্ষী হিসেবে তার জবানবন্দি পেশ করেছেন। তাকে জেরা শেষে মামলার কার্যক্রম মঙ্গলবার পযন্ত মূলতবি করেন আদালত। এসময় শাহরিয়ার খান পলাশ বলেন, যারা এই হত্যার সঙ্গে জড়িত তাদের ফাঁসি চাই।
সোমবার (১১ আগস্ট) ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে প্রথম সাক্ষী আনাসের বাবার সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়।
ট্রাইব্যুনালের অন্য দুই সদস্য হলেন, বিচারপতি শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারপতি মহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
আদালতে মামলার সূচনা বক্তব্য উপস্থাপন করেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। সাক্ষ্যগ্রহণ করেন প্রসিকিউটর মোহাম্মদ মিজানুল ইসলাম।
জবানবন্দির সময় আনাসের বাবা বলেন, গত বছরের ৫ আগস্ট আনাস তার মাকে একটি চিঠি লিখে সকালে রাজধানীর গেণ্ডারিয়ার ভাড়া বাসা থেকে বের হয়েছিল। চিঠিতে আনাস লিখেছিল ‘মা আমি মিছিলে যাচ্ছি। যদি না ফিরি তাহলে গর্বিত হইও।’ সেই চিঠিটি তদন্তকারী কর্মকর্তা জব্দ করেছেন এবং তা এই মামলার জব্দতালিকায় বস্তু প্রদর্শনী হিসেবে আছে উল্লেখ করে আনাসের বাবা বলেন, ‘এই চিঠির মাধ্যমে বুঝতে পারি আনাস বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচিতে গেছে। এরপর ওইদিন দুপুর দেড়টার দিকে আনাসের মায়ের মোবাইলে একটি অপরিচিত নাম্বার থেকে কল আসে। ফোন ধরতেই জানতে চাওয়া হয় আমাদের কেউ বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন কর্মসূচিতে গেছে কি না। আমার স্ত্রী বলেন, আমার ছেলে আনাস গেছে। ওই লোকটি তখন দ্রুত মিটফোর্ড হাসপাতালে যেতে বলেন। এই সংবাদ শুনে আমি, আমার স্ত্রী এবং আমার শ্বশুর মিটফোর্ড হাসপাতালে যাই। জরুরি বিভাগের সামনে একটি স্ট্রেচারে রক্তাক্ত অবস্থায় আমার সন্তানের গুলিবিদ্ধ লাশ দেখতে পাই।’
- আরও পড়ুন
- ৮ আসামির বিরুদ্ধে সূচনা বক্তব্য উপস্থাপন শেষে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু
- জুলাই গণহত্যাকারীদের কেউই ছাড় পাবে না: চিফ প্রসিকিউটর
- ‘মা, আমি মিছিলে যাচ্ছি, সরি আব্বুজান’
আনাসের বাবা আরও বলেন, মিডফোর্ড হাসপাতাল থেকে আনাসের ভর্তির কাগজ, সিম ছাড়া মোবাইল ফোন ও মৃত্যু সনদসহ আনাসকে নিয়ে রিকশায় করে বাসায় ফেরেন তারা। ফেরার পর এলাকার লোকজন আনাসের লাশ নিয়ে মিছিল করে। মিছিল থেকে আনাসের মৃত্যুর জন্য শেখ হাসিনার ফাঁসি চাওয়া হয়। ওইদিনই আছরের নামাজের পর আনাসের মৃতদেহ গেন্ডারিয়ার ধূপখোলা মাঠে নেওয়া হয়। তিনি আরও বলেন, ‘সেখানে গিয়ে দেখি শেখ মেহেদী হাসান জুনায়েদ (১৪) নামের আরেক ছাত্রের লাশও জানাজার জন্য আনা হয়েছে। সে-ও ওইদিন চাঁনখারপুল এলাকায় পুলিশের গুলিতে নিহত হয়। দুজনের জানাজা একসঙ্গে হয়। আমরা আনাসকে গোসল করাইনি। তাকে শহীদী মর্যাদায় অর্থাৎ গোসল না করিয়ে রক্তাক্ত পোশাকেই দাফন করা হয়।’
আনাসের সঙ্গে থাকা আন্দোলনকারী রাব্বী হোসেন ও সৌরভ আহম্মেদের বরাত দিয়ে গত বছর ৫ আগস্ট চাঁনখারপুল এলাকার পরিস্থিতির বর্ণনা দেন সাক্ষী সাহরিয়ার খান পলাশ। তিনি বলেন, ‘তারা (আনাস, রাব্বি ও সৌরভসহ আন্দোলনকারীরা) চাঁনখারপুল হয়ে শহীদ মিনারের দিকে যাচ্ছিল। চাঁনখারপুল এলাকায় তারা পুলিশের বাধার মুখে পড়ে। সেখানে হাজার হাজার ছাত্র-জনতা জড়ো হয়। পুলিশ নিরন্ত্র আন্দোলনকারীদের ওপর সাউন্ড গ্রেনেড, টিয়ারশেল, শর্টগান এবং চাইনিজ রাইফেল দিয়ে নির্বিচারে গুলি করে। নিমতলীর নবাব কাটারা গলির ভেতর আনাসকে টার্গেট করে গুলি করে পুলিশ। একটা গুলি আমার ছেলের বুকের বামপাশে বিদ্ধ হয়ে পিছন দিক দিয়ে বের হয়ে যায়। গুলি করা লোকটি এপিবিএনের পোশাক পরা ছিল। আনাস গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর তাকে রাব্বি হোসেন, সৌরভ আহম্মেদসহ আরও কয়েকজন রিকশায় করে মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে যায়। রাব্বিসহ আরও অনেকেই ঘটনাটির ভিডিও করে। পরে ভিডিওগুলো আমাকে দেওয়া হয়। তদন্তকারী কর্মকর্তা আমার কাছ থেকে তা জব্দ করেছেন।’
আনাসসহ ছয়জনকে গুলি করে হত্যার জন্য সাক্ষী সাহরিয়ার খান (পলাশ) আসামিদের দায়ী করে তাদের বিচার ও ফাঁসি দাবি করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে।
আনাসের বাবার সাক্ষ্যগ্রহণের পর আসামি আরশাদ হোসেনের পক্ষে সাক্ষীকে জেরা করেন আইনজীবী সাদ্দাম হোসেন অভি। ইমাজ হোসেনের পক্ষে জেরা করেন আইনজীবী জিয়াউর রশিদ টিটো, আসামি সুজন হোসেন ও নাসিরুল ইসলামের পক্ষে জেরা করেন আইনজীবী আবুল হোসেন।
আর পলাতক আসামিদের পক্ষে জেরা করেন রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী কুতুবুদ্দিন। মঙ্গলবারও এই মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য করেন ট্র্যাইব্যুনাল।
গত বছরের ৫ আগস্ট রাজধানীর চাঁনখারপুল এলাকায় ছয়জনকে গুলি করে হত্যার অভিযোগে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গত ১৪ জুলাই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্র্যাইব্যুনাল-১ ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ আট আসামির বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করেন। তারা হলেন, সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান, সাবেক যুগ্ম কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী, রমনা অঞ্চলের সাবেক অতিরিক্ত উপকমিশনার শাহ্ আলম মো. আখতারুল ইসলাম, রমনা অঞ্চলের সাবেক সহকারী কমিশনার মোহাম্মদ ইমরুল, শাহবাগ থানার সাবেক পরিদর্শক মো. আরশাদ হোসেন, কনস্টেবল মো. সুজন হোসেন, ইমাজ হোসেন ও মো. নাসিরুল ইসলাম। তাদের মধ্যে প্রথম চারজন পলাতক। অন্য চারজন কারাগারে।
এফএইচ/এসএনআর/জিকেএস