ঝুলন্ত আত্মাদের বিদ্রোহ ও সৃষ্টির নতুন ইশতেহার

3 hours ago 2

আরিফুল ইসলাম

প্রযুক্তির খেলায় মানবতা যখন ক্লান্ত হয়ে পড়ে, তখন সৃষ্টিকর্তার এক নীরব ইঙ্গিত ডেকে আনে মহাজাগতিক জাগরণে। কিন্তু সেই জাগরণের অন্তরালে লুকিয়ে থাকে মানবজাতির সবচেয়ে বড় ভুল, যা পৃথিবীকে ঠেলে দেয় মহাপ্রলয় বা নব সৃষ্টির দিকে।

এই ধরুন, সৃষ্টির শুরুতে পানি, তার ওপর অন্ধকার। অন্ধকার থেকে ধোঁয়া, তারপর আলো, আলো থেকে জীব। তারপর সরীসৃপভুক্ত ডাইনোসর। এরপর আসলো ধূমায়িত শিখা থেকে পৃথিবীতে প্রতিনিধিত্বকারী জ্বীন জাতি। যাদের সিভিলাইজেশন সরিয়ে সৃষ্টিকর্তা শুষ্ক ঠনঠনে এবং কাদা মাটি থেকে পৃথিবীতে নিয়ে আসে তার প্রতিনিধিত্বকারী মানুষ। আর তাদের নিষেধ করা হয়, তোমরা যেন আমার (সৃষ্টিকর্তার) সাথে শরিক অর্থাৎ মূর্তি তৈরি করে তার পুজো না করতে। প্রশ্নটা এখানেই, কিন্তু কেন? মানুষ তার নিজের হাতে মূর্তি বানিয়ে তার পুজো করলে সৃষ্টিকর্তার সমস্যা কোথায়?

এ প্রশ্নের উত্তরের জন্য চলুন, আমরা ঘুরে আসি ফিকশনাল ৫৫৫৫ সাল থেকে। মানব সভ্যতা তার সর্বোচ্চ উন্নতির শিখরে পৌঁছানো এক অনিন্দ্য পৃথিবী। যেখানে হ্যাভেনগুলোর সেবার ন্যায় এখানেও পেয়ে থাকে সেসব সেবা। জান্নাতে আঙুর গাছের নিচে শুয়ে থাকা এক জান্নাতি দেখতে পাবে তার ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়া এক পাখি। তা দেখে জান্নাতিটি মনে করবে আহ, এখন যদি ওই পাখিটির কলিজা ভুনা খেতে পারতাম! আর ওমনি পাখিটি জবাই হয়ে তার কলিজা রান্না হয়ে জান্নাতিটির সামনে চলে আসবে।

ঝুলন্ত আত্মাদের বিদ্রোহ ও সৃষ্টির নতুন ইশতেহার

মনে করেন তো, আপনার সামনে থাকা ফুডপান্ডার কথা। যে চাইলে আপনার সামনে মাত্র ১৫ মিনিটের মধ্যে খাবার নিয়ে আসার জন্য প্রস্তুত। জ্যামিতিক হারে পৃথিবী যেভাবে প্রযুক্তির উচ্চ শিখরে পৌঁছে যাচ্ছে সেখানে ফুডপান্ডার ১৫ মিনিট থেকে মাত্র ১.৫ সেকেন্ডে তা হওয়া সম্ভব কি না? আপনি একটু দূরদৃষ্টি সম্পন্ন হলেই বলবেন, অবশ্যই সম্ভব। কিন্তু আরেকটু ভাবলেই পাবেন এমন সেবার পেছনে লুকিয়ে থাকা প্রযুক্তির গোপন রহস্য।

মনে করেন, সে সময়ের কথা, যে সময় গুটি কয়েক ব্যক্তির হাতে বন্দি আমাদের বিশ্ব। তাদের তৈরি একটি কসমিক কম্পিউটিং কোড শুধু অর্থনীতি বা রাষ্ট্রব্যবস্থা নয়, বরং মানুষের ব্যক্তিগত চিন্তা-চেতনাকেও নিয়ন্ত্রণ করছে। পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ তাদের ইচ্ছায় বিশেষ তরঙ্গের মাধ্যমে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। যেন এক বিশাল ঘুমন্ত কারাগারে পরিণত আমাদের অবজারভাবল এ ইউনিভার্স। কোডিংয়ে আমাদের স্বপ্নগুলোও রূপান্তরিত। আমাদের চেতনা তখন একটি প্রোগ্রাম মাত্র। আর পৃথিবী যেন বিশাল এক নীল কারাগার, যেখানে দেহ আছে, কিন্তু নিজের নিয়ন্ত্রণ বলে কিছুই নাই। ক্যালকুলেশনে যে কারো অবস্থান নস্যি মাত্র। তবে ইউনিভার্সাল ট্রুথ বলে একটা কথা আছে, সৃষ্টির সীমা যেখানে শেষ, সৃষ্টিকর্তার খেলা সেখানে শুরু।

একটি শিশু এবং একটি শিশির বিন্দু। শিশুর ছোঁয়ায় শিশির বিন্দুর মধ্যে অদ্ভুত এক আলো, মহাজাগতিক শক্তি। সে আলো তো নিছক কোনো আলো নয়, যেন এক অদম্য শক্তি, যা বিলিয়ন বিলিয়ন বছর ধরে ঘুমিয়ে ছিল আমাদের ইউনিভার্সে। মুহূর্তেই চারপাশে অদৃশ্য কম্পন, যেন ঘুমিয়ে থাকা কোনো এক ঐশ্বরিক যন্ত্রের উত্থান। শিশির বিন্দুতে দৃশ্যমান এক কমপ্লেক্স পাওয়ার ডাইমেনশন—যা অতি ক্ষুদ্র অথচ অসীম ক্ষমতার একটি পাওয়ার পোর্টাল। ওলোট-পালোট করে দিচ্ছে সবকিছু, যেন সাক্ষাৎ দি ফাইনাল স্টেজ অব কিয়ামাহ।

ঘটনার সমান্তরাল, মানব সভ্যতার আরেক প্রান্তে আরেক বৈজ্ঞানিক ও আধ্যাত্মিক গবেষক সাবিব আলবার। যিনি ষড়যন্ত্রকারীদের কৃত্রিম ওই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে দুর্নিবার এক লড়াকু সৈনিক। স্পিরিচুয়াল কমিউনিকেশন-সিজদায় লুটানো সাবিব। মহাবিশ্বের এমন অসহায় আত্মসমর্পণ সাবিবের চোখের অশ্রু মাটিতে পড়তেই সৃষ্ট হয় এক মহাজাগতিক কম্পন, যা বিলিয়ন বিলিয়ন বছর ধরে গড়ে উঠা বাস্তবতার দেয়ালকে করে তুলেছে নড়বড়ে। তিনি বুঝতে পারেন, এই অশ্রু নিছক দুর্বলতার চিহ্ন নয় বরং সৃষ্টিকর্তার পাঠানো এক গ্রিন সিগন্যাল।

অবরুদ্ধ পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত ঘটা দুটি ঘটনা ভিন্ন, কিন্তু বার্তা একই—সৃষ্টির নতুন ইশতেহার... সভ্যতার মুক্তির জন্য কাজ করা আরেক বিজ্ঞানী, ড. ডিউন। বহু বছর ধরে তিনি পৃথিবীর ম্যাগনেটিক ফিল্ড ও মাইন্ড ফিল্ড (কলব) এর সমন্বয় নিয়ে গবেষণা করে আসছিলেন। তিনি বিশ্বাস করেন, এই ফিল্ডের ভেতরে লুকানো আছে মানবজাতির মুক্তির রহস্য। তার গোপন ল্যাবে তিনি ও তার দল এমন এক শক্তিশালী মহাজাগতিক কণিকা ফিল্ড আবিষ্কার করেছেন, যেখানে সৃষ্টিকর্তা ল্যান্ড করতে সক্ষম। কিন্তু অবরুদ্ধকারীরা দ্রুতই বুঝতে পারে তার গবেষণা লব্ধ উদ্ভাবনের। মানবজাতির ভাগ্য তখন এক অনিশ্চয়তার পেণ্ডুলামে দাঁড়িয়ে। হয় ড. ডিউনের আবিষ্কার মানুষকে মুক্তি দেবে, নয়তো অবরুদ্ধকারীদের হাতে তা চিরতরে হারিয়ে যাবে।

অবরুদ্ধকারীরা নিজেদের ক্ষমতা ধরে রাখতে সিদ্ধান্ত নেয় সৃষ্টির সবচেয়ে ভয়ংকর শক্তিকে কাজে লাগানোর কাজ, ঝুলন্ত আত্মাদের দেহবয়ব দেওয়া…!

ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী, আত্মহত্যা বা অকালমৃত্যুর কারণে যাদের আত্মা তার নির্ধারিত সময় ও স্থান থেকে বিচ্যুত হয়, তারা চিরকাল অস্থির অবস্থায় থাকে। ইসলামি ব্যাখ্যায় তারা বারযাখে অর্থাৎ প্রথম আকাশের নিচে ঝুলন্ত থাকে। হিন্দু দর্শনে তারা প্রেত বা ভূত হয়ে পৃথিবীতে ঘুরে বেড়ায়। খ্রিষ্টান বিশ্বাসে তারা পাৰ্গটোরিতে শাস্তি ভোগ করে, আর বৌদ্ধ মতে তারা ক্ষুধার্ত আত্মায় রূপান্তরিত হয়ে কষ্ট ভোগ করে। এরা মূলত এমন আত্মা, যারা কখনো শান্তি খুঁজে পায় না, থাকে ঝুলন্ত।

ঝুলন্ত আত্মাদের বিদ্রোহ ও সৃষ্টির নতুন ইশতেহার

অবরুদ্ধকারীরা ধর্মগুলোর সমন্বয়ে শুরু করে ঝুলন্ত আত্মাদের মুক্ত করার তান্ত্রিক কাজ। অবশেষে সফলতার দ্বার উন্মুক্ত হলে; পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্রগুলো দুর্বল হয়ে পড়তেই ঝুলন্ত আত্মারা একে একে দুনিয়ায় তৈরি সকল মূর্তির মধ্যে প্রবেশ করে। তারা পায় নিজেদের শারীরিক রূপ। নিঃষ্প্রাণ মূর্তিগুলো মুহূর্তে জীবন্ত হয়ে ওঠে। তাদের পাথরের মুখে ফুটে ওঠে ঘৃণা, ক্রোধ আর বিদ্রোহের অভিব্যক্তি। তারা মানুষকে উদ্দেশ্য করে ঘোষণা করে—‘আমরাই নিজেদের সৃষ্টিকর্তা, আমরা আর কারো অনুগ্রহহীন সন্তান নয়। এবার আমাদের পালা।’

জীবন্ত মূর্তিগুলো দখল আর ধ্বংস করতে থাকে গ্রাম থেকে শহর, শহর থেকে দেশ, দেশ থেকে দেশান্তর। মহাদেশ থেকে গ্রহ আর গ্রহ থেকে গ্রহান্তর। আর মানুষকে পরিণত করে রিমোটিং দাসে। এই মূর্তিগুলো বিশ্বাস করত, মানুষই তাদের বন্দিত্বের জন্য দায়ী, তাই প্রতিশোধ নেওয়া তাদের প্রাপ্য। মানুষের তৈরি সভ্যতা, প্রযুক্তি—সবকিছুই মূর্তিদের ক্রোধের আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যেতে থাকে। মানব সভ্যতা একের পর এক ধ্বংস হতে থাকে, পৃথিবী রূপ নেয় এক বিশাল ধ্বংসস্তূপে। মূর্তিগুলো তখন নিজেদের এই নতুন পৃথিবীর শাসক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে শুরু করে। তারা মানুষের তৈরি সব জ্ঞান, শিল্প, সাহিত্য—সবকিছু মুছে ফেলতে শুরু করে, যেন সৃষ্টিকর্তার কোনো চিহ্নই পৃথিবীতে না থাকে।

এই বিদ্রোহে সৃষ্টিকর্তার জন্যও তৈরি হয় বিশাল এক হুমকি। কারণ মানুষ তার আদেশ-নিষেধ ভুলে গিয়ে মূর্তি বানিয়েছিল, আজ সেই মূর্তিগুলোই হয়ে উঠেছে আত্মাদের সেই আশ্রয়স্থল। যখন মানুষের এই অবাধ্যতা সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টিরই ক্ষতির কারণ, তখন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না সৃষ্টিকর্তার।

সৃষ্টিকর্তা ঘোষণা করলেন, যে সৃষ্টির মধ্যে শুদ্ধতার অভাব, তাকে রিসেট করাই শ্রেয়।’ তিনি বললেন, ‘কুন’ আর মুহূর্তেই মহাবিশ্বকে গ্রাস করলো এক মহাবিপর্যয়। পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র এমন এক শক্তি দ্বারা আঘাতপ্রাপ্ত হলো, যা সবকিছুকে শুষে নিতে শুরু করলো। ইতিহাস, সভ্যতা, প্রাণ—সব মুছে যেন একটি কম্পিউটার সম্পূর্ণভাবে ফরম্যাট হয়ে নতুন করে শুরু হচ্ছে। এটি যেন সৃষ্টিকর্তার একটি মহাজাগতিক রিসেট বাটনে চাপ, যেখানে মানুষের ভুল থেকে শুরু হয় নতুন করে নতুন যুগ, নতুন চেতনা, নতুন স্মৃতি ও শুদ্ধ মন। যেখানে সৃষ্টিকর্তা ল্যান্ড করবে নিয়মিত।

নেই অবাধ্যদের পুরনো সে পাপের বোঝা। নেই প্রযুক্তি নির্ভরতা, নেই ক্ষমতার লোভ। কিন্তু ধুমায়িত মহাশূন্যের ভিন্ন ডাইমেনশনে এখনো ফিসফিস করে শোনা যাচ্ছে ঝুলন্ত আত্মাদের সেই কণ্ঠস্বর, ‘আমরা আবারো তোমাদের ভুলের অপেক্ষায়।’

সৃষ্টির সামনে তখনো রয়ে গেছে এক চিরন্তন চ্যালেঞ্জ…

লেখক:
প্রবাসী সাংবাদিক, লেখক ও গবেষক
মেম্বার সেক্রেটারি, বাংলা প্রেস ক্লাব মালয়েশিয়া
ইমেইল: [email protected]

এমআরএম/এমএস

Read Entire Article