বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে হওয়া মামলার নবম সাক্ষী শাহিনা বেগম তার জবানবন্দি পেশ করেছেন। তার সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে পরবর্তী সাক্ষীর জন্য আজ সোমবার দিন ঠিক করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। ট্রাইব্যুনালে ছয় জনের পোড়া দেহের মধ্যে থেকে নিজের সন্তানের লাশ খুঁজে বের করার ঘটনার বর্ণনা দেন শাহিনা বেগম।
তিনি জানান, আমি দেখতে পাই একটি লাশ এমনভাবে পুড়ে গেছে যে, পায়ের একটি মোটা হাড় উঁচু হয়ে আছে এবং সে হাড়ের সঙ্গে একটি পোড়া জুতা ঝুলছে, সামান্য টাচ করলেই জুতাটা পড়ে যাবে। জুতাটা দেখেই আমি বুঝতে পারি যে, এই জুতাটি আমার ছেলের।
রোববার (১৭ আগস্ট) ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারিক প্যানেলে শাহিনা বেগমের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়। ট্রাইব্যুনালের অন্য দুই সদস্য হলেন বিচারপতি শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারপতি মহিতুল হক এনাম চৌধুরী
শাহিনা বেগম তার জবানবন্দিতে বলেন, আমি মোছা. শাহিনা বেগম। বয়স আনুমানিক ৪১ বৎসর। আশুলিয়ায় নারী ও শিশু হাসপাতালে পরিচ্ছন্নতা কর্মী ছিলাম। জুলাই ২০২৪ আন্দোলনে শহীদ সাজ্জাদ হোসেন সজলের আম্মু। ছেলে সাজ্জাদ হোসেন সজল ৫ আগস্ট আশুলিয়ায় বাইপাইল এলাকায় আন্দোলনে যোগ দেয়। আমার ছেলে আন্দোলনে যায় এবং আমি হাসপাতালে ডিউটিতে যাই। হাসপাতালে অনবরত গুলিবিদ্ধ হয়ে লোকজন আসছিল।
তিনি আরও বলেন, আমি তখন বার বার ছেলেকে ফোন করে বলি, বাবা তুমি বাসায় ফিরে আসো। হাসপাতালে অনেক গুলিবিদ্ধ আহত রোগী আসতেছে, তোমার আন্দোলনে থাকার দরকার নাই। তখন সে আমাকে বলে, তুমি এমন স্বার্থপর কেন আম্মু? আমি এখন বাসায় যেতে পারবো না। আমার সামনে চার চারটা লাশ এবং আমি একজন আহতকে ধরে বসে আছি।
শাহিনার বলেন, সকাল ১১টা কি সাড়ে ১১টার দিকে আমার হাসপাতালে দুটি ডেড বডি আসে। অনেক আহত রোগী আসে। তখন ছেলেকে আবার ফোন করি। ছেলে বলে, আমাকে তুমি কীভাবে ফেরত আসতে বলো। আমি বলি তুমি আমার একমাত্র ছেলে। তোমার একটি মেয়ে আছে। তোমাকে আমি ইঞ্জিনিয়ার বানাতে চাই। কিন্তু সে বাসায় ফিরেনি। ছেলে জবাব দেয়, মা আমি যদি মারা যাই, তাহলে হাজার সন্তান তোমার পাশে দাঁড়াবে। তুমি আমার চিন্তা করো না। এরপর আরো দুটি মৃতদেহ হাসপাতালে আসে। আমি দৌড়ে রিকশার কাছে যাই এবং ভাবতে থাকি এই বুঝি আমার ছেলে হাসপাতালে আসলো। এই সময় আরও একজন বুকে গুলিবিদ্ধ আহত ছেলেকে হাসপাতালে আনা হয়। আমি তাকে এক্স-রে রুমে নিয়ে যাচ্ছিলাম। ঐ সময় ছেলেটি তার মাকে ফোন করে এবং বলে আম্মু আমি ভালো আছি। আরেকজন আহত ছেলেকে আমি স্ট্রেচারে করে নিয়ে যাচ্ছিলাম। সেই ছেলেটিও তার পাশে থাকা বন্ধুকে বলছিল, আমার অবস্থা আম্মুকে বলো না, তাকে বলো আমি ভালো আছি। না হলে আম্মু অনেক চিন্তা করবে। এই ভয়াবহ অবস্থা দেখে আমি আমার ছেলেকে বার বার ফোন দিতে থাকি।
- আরও পড়ুন
- আশুলিয়ায় ৬ লাশ পোড়ানোর মামলার তদন্ত শেষ: চিফ প্রসিকিউটর
- হত্যার পরে লাশ আগুনে পুড়িয়ে ফেলা: অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কাফী আটক
- শেখ হাসিনার মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হবে অক্টোবরে
তিনি আরও বলেন, তারপর আবার ছেলেকে ফোন করে বলি, যদি আন্দোলন করতেই চাও তবে এখানে না থেকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যাও, সেখানে তোমার আরও আন্দোলনকারীরা আছে। আমার ছেলে তখন উত্তর দেয়, তুমি কি পাগল হয়ে গেছো আম্মু? আমার ভাই বোনেরা গুলি খাচ্ছে, মারা যাচ্ছে তাদের কে রেখে আমি কীভাবে জাহাঙ্গীরনগরে যাবো?।
শহীদ সাজ্জাদ হোসেন সজলের মা বলেন, সর্বশেষ বেলা পৌনে ২টার দিকে আবার তাকে ফোন দেই। তখন সে আমাকে বলে, তুমি কেন আমাকে ফোন দিয়ে বিরক্ত করছো আম্মু? আমি যদি শহীদ হই তাহলে আমার আইডি কার্ড দেখে আমাকে শনাক্ত করো। ২টা ৫৫মিনিটের দিকে হাসপাতালের ডাক্তার বললো, দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে, শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছে, সজলকে আসতে বলো। তাকে দুই বার ফোন দিয়েছিলাম, ফোন কেটে দিয়েছে। পরে অনবরত রিং করেছি কিন্তু কেউ রিসিভ করেনি। পরে ফোন বন্ধ হয়ে যায়। তখন আমি তার সব বন্ধু-বান্ধবকে ফোন দিয়ে বাইপাইল এলাকায় তার খোঁজ নিতে বলি। তারা বলে অনবরত গুলি হচ্ছে, আমরা খোঁজ নিতে পারছি না। আশুলিয়া থানার সামনে আমরা যেতে পারছি না। আমি নিজে খোঁজ নিতে যেতে পারিনি কারণ হাসপাতালে তখন প্রচুর গুলিবিদ্ধ লোক আসছিল।
তিনি বলেন, সন্ধ্যা আনুমানিক ৭টার দিকে হাসপাতাল থেকে আমি ছেলের খোঁজে নিজেই বের হই। আমার সঙ্গে সজলের এক বন্ধু শান্তকে নিয়ে। আশেপাশে যত হাসপাতাল আছে সব হাসপাতালে ছেলের খোঁজ করি কিন্তু পাইনি। আমি আইসিইউতে ঢুকেও রোগীদের মুখ দেখে ছেলেকে খুঁজেছি। যত বেওয়ারিশ লাশ ছিল তা আমি উল্টেপাল্টে দেখেছি। তারা আমাকে লাশ দেখতে নিষেধ করছিল কারণ তারা বলছিলো আপনি মা, আপনি সহ্য করতে পারবেন না।
তিনি আরও জানান, নিহতদের মাথায়, বুকে গুলি লেগে ছিন্ন হয়ে গেছে। এগুলো দেখলে আপনি পড়ে যেতে পারেন। আমার স্বামীও বিভিন্ন হাসপাতালে ছেলের সন্ধানে খোঁজখবর করে কিন্তু ছেলের সন্ধান পাওয়া যায়নি।
সারাদিন এবং ভোর রাত ৩টা ৫০মিনিট পর্যন্ত খোঁজাখুঁজি করে আমি বাসায় ফিরার উদ্দেশ্যে বাইপাইল মোড়ে আসি। তখন আমি সেখানে লাঠিশোঠা নিয়ে পাহাড়ারত ছাত্রদেরকে দেখতে পাই। তাদের কাছে আমার ছেলের সন্ধান জানতে চেয়ে মোবাইলে থাকা ছবি তাদের দেখাই। তখন এক ছেলে বলে, আন্টি আপনি যদি সহ্য করতে পারেন তাহলে আমি আপনাকে একটা খবর বলতে চাই। তখন আমি বললাম বাবা আমার ছেলেকে পাওয়ার জন্য সব কিছু সহ্য করতে প্রস্তুত আছি, তুমি বলো।
তখন সে ছেলেটি আমাকে বলে, আশুলিয়া থানার সামনে ৬/৭ টি ছেলেকে হত্যা করে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। আপনি সেখানে আপনার ছেলেকে খুঁজে দেখতে পারেন। আমি আশুলিয়া থানায় যেতে চাইলে অন্য ছাত্ররা আমাকে সেখানে যেতে দেয়নি। তারা আমাকে জোর করে বাসায় পাঠিয়ে দেয়। আমি বাসায় গিয়ে তাহাজ্জুদ ও ফজরের নামাজ পড়ে ৬টার দিকে বাসা থেকে আবার বের হই এবং সকাল আনুমানিক ৬টা ৩০মিনটের দিকে আশুলিয়া থানার সামনে যাই। সেখানে গিয়ে একটা পুলিশের পিকআপ গাড়িতে বেশ কয়েকটি পোড়া লাশ দেখতে পাই। অনেক মানুষ লাশগুলোর ছবি ও ভিডিও করছিল। আমি ভিড় ঠেলে সামনে যাই এবং একটা ছবি তুলি। আদালতে সেটি তুলে ধরে জানান এই সেই ছবির প্রিন্ট কপি। আমি দেখতে পাই একটি লাশ এমনভাবে পুড়ে গেছে যে, পায়ের একটি মোটা হাড় উঁচু হয়ে আছে এবং সে হাড়ের সঙ্গে একটি পোড়া জুতা ঝুলছে, সামান্য টাচ করলেই জুতাটা পড়ে যাবে। জুতাটা দেখেই আমি বুঝতে পারি যে, এই জুতাটি আমার ছেলের। এ সময় তিনি কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন আর বলেন আমার সন্তানসহ দুই হাজার মানুষকে যারা হত্যা করেছে সেই আসামিসহ এই হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান কামাল, আইজিপি মামুন, ওবায়দুল কাদের, সাইফুল এমপি, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ এবং পুলিশ লীগের বিচার চাই
এফএইচ/এসএনআর/জিকেএস