টাইফয়েড জ্বর বাংলাদেশের শিশুদের জন্য একটি গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকি। তবে এটি শুধু জ্বর না। বরং সময়মতো চিকিৎসা না হলে এটি অন্ত্রে রক্তপাত, মেনিনজাইটিস বা হার্টের প্রদাহের মতো মারাত্মক জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।
দিন দিন আমাদের শরীরে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স বেড়ে যাওয়ায় এর চিকিৎসা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে, টাইফয়েড কনজুগেট ভ্যাকসিন (টিসিভি) হলো শিশুদের সুরক্ষার জন্য সবচেয়ে কার্যকর হাতিয়ার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুমোদিত এই টিকাটি বাংলাদেশের মতো স্থানীয় কমাতে ও শিশুমৃত্যুর ঝুঁকি এড়াতে অত্যন্ত জরুরি।
তবু টিকা বা ভ্যাক্সিন নিয়ে আমাদের মধ্যে প্রায়ই বিভ্রান্তি কাজ করে। তাই এসব বিষয় নিয়ে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. কাকলী হালদার।
টাইফয়েড কী?
টাইফয়েড জ্বর হলো সালমোনেলা টাইফি নামক ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সৃষ্ট একটি তীব্র সংক্রমণজনিত রোগ। এটি প্রাথমিকভাবে উচ্চ ও দীর্ঘস্থায়ী জ্বর, দুর্বলতা, মাথাব্যথা, পেটে ব্যথা এবং কখনও কখনও কোষ্ঠকাঠিন্য বা ডায়রিয়ার মতো লক্ষণ সৃষ্টি করে।
শিশুদের কেন বেশি হয়? এটি কীভাবে ছড়ায়?
টাইফয়েড প্রধানত দূষিত খাবারের মাধ্যমে ছড়ায়। শিশুরা সাধারণত অনিরাপদ পানি পান বা দূষিত খাবার গ্রহণের মাধ্যমে এই রোগে বেশি আক্রান্ত হয়।
এছাড়া দুর্বল স্যানিটেশন ও স্বাস্থ্যবিধিও গুরুত্বপূর্ণ কারণ। যেখানে স্যানিটেশনের অভাব রয়েছে এবং ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধি, যেমন - সঠিকভাবে হাত ধোয়ার অভ্যাস কম, সেখানে সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি।

সংক্রমণের আরেকটি পথ হলো সংক্রমণ বাহক। যারা টাইফয়েড থেকে সেরে ওঠার পরও ব্যাকটেরিয়া বহন করছেন, তাদের মলের মাধ্যমে এটি ছড়াতে পারে।
জটিলতা কী?
চিকিৎসা না করা হলে টাইফয়েড গুরুতর জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে, যা প্রাণঘাতীও হতে পারে। চিকিৎসা না করলে টাইফয়েডের কারণে অন্ত্র ফেটে রক্তপাত, হৃদপিণ্ড, ফুসফুস ও মস্তিষ্কে প্রদাহসহ প্রাণঘাতী জটিলতা হতে পারে।
সংক্রমণের হার: বাংলাদেশে টাইফয়েডের প্রকোপ তুলনামূলকভাবে বেশি এবং আক্রান্তদের একটি বড় অংশই শিশু ও কিশোর-কিশোরী। একটি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে প্রতিবছর প্রায় ৫ লাখ মানুষ টাইফয়েডে আক্রান্ত হয় এবং ৮ হাজারের মতো মানুষ মারা যায়, যাদের অধিকাংশই শিশু।
গবেষণা ও অবস্থা: টাইফয়েডজনিত শিশুমৃত্যুর হার কমাতে এবং অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের কারণে সৃষ্ট জটিলতা এড়াতে সরকার টাইফয়েড কনজুগেট ভ্যাকসিন (টিসিভি) দেওয়া শুরু করেছে। গবেষণায় দেখা গেছে - এই ভ্যাকসিন বাংলাদেশের শিশুদের জন্য ৮৫% বা তার বেশি সুরক্ষা দিতে পারে। বিশ্বখ্যাত মেডিকেল জার্নাল ল্যানসেট গ্লোবাল হেলথ - এ প্রকাশিত গবেষণায় এই টিকা নেপালে ২০ হাজারের বেশি শিশুর ওপর অত্যন্ত কার্যকর ও নিরাপদ প্রমাণিত হয়েছে।
টাইফয়েড টিকা নিয়ে এত বিতর্ক কেন?
টাইফয়েড টিকা নিয়ে বিতর্কের মূল কারণ সাধারণত গুজব, বিভ্রান্তি এবং ভুল তথ্য। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে সরকারিভাবে যখন এই টিকা দেওয়া শুরু হয়েছে, তখন কিছু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে টিকার কার্যকারিতা, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, এর উৎপাদক বা নিরাপত্তা নিয়ে ভিত্তিহীন তথ্য ছড়িয়ে পড়েছে। গুজব ছড়ানো হচ্ছে টিকাটি পরীক্ষামূলকভাবে শিশুদের ওপর প্রয়োগ করা হচ্ছে বা এটি শিশুদের জন্য ক্ষতিকর।
কিন্ত জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও চিকিৎসকরা বারবার নিশ্চিত করেছেন যে টাইফয়েড কনজুগেট ভ্যাকসিন অত্যন্ত নিরাপদ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুমোদিত এবং আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন দেশে এটি সফলভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
টিকা কিভাবে কাজ করে?
বাংলাদেশে ব্যবহৃত টাইফয়েড কনজুগেট ভ্যাকসিন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক যাচাইকৃত এবং এটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অপরিহার্য ওষুধের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত।
এটি এক ধরণের সাব-ইউনিট টিকা, যেখানে ব্যাকটেরিয়ার একটি অংশকে (Vi ক্যাপসুলার পলিস্যাকারাইড) একটি ক্যারিয়ার প্রোটিনের সঙ্গে যুক্ত করে তৈরি করা হয়। টিকাটি শরীরে প্রবেশ করার পর রোগ সৃষ্টিকারী সালমোনেলা টাইফি ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি করতে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে উদ্দীপিত করে।
এই অ্যান্টিবডিগুলো ভবিষ্যতে ওই ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সংক্রমিত হলে তার বিরুদ্ধে লড়াই করে এবং রোগ প্রতিরোধ করে। কনজুগেট হওয়ায় এটি ছোট শিশুদের মধ্যেও শক্তিশালী এবং দীর্ঘস্থায়ী সুরক্ষা দিতে পারে।
সুরক্ষা কতদিন?
টিসিভি টিকা কয়েক বছর ধরে (গবেষণায় ৫ বছর বা তার বেশি) কার্যকর সুরক্ষা দিতে পারে। এর কার্যকারিতা প্রায় ৮৫% বা তার বেশি।
কোন কোন দেশে এই টিকা দেওয়া হয়?
এই টিকা বিশ্বের অনেক দেশেই ব্যবহৃত হচ্ছে। বিশেষভাবে টাইফয়েডের প্রকোপ বেশি এমন দেশ যেমন- পাকিস্তান এবং নেপালসহ বিশ্বের প্রায় ২১টি দেশ তাদের জাতীয় টিকাদান কর্মসূচিতে টিসিভি অন্তর্ভুক্ত করেছে।
টিকা কি নেওয়া উচিত?
হ্যাঁ, টাইফয়েড টিকা নেওয়া উচিত, বিশেষ করে শিশুদের জন্য। এটি জটিলতা ও শিশুমৃত্যুর ঝুঁকি কমায় এবং অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স জনিত সমস্যা মোকাবিলায় সহায়তা করে। টাইফয়েডের জীবাণু দিন দিন কিছু এন্টিবায়োটিকে প্রতিরোধী হয়ে উঠছে। ফলে ভবিষ্যতে চিকিৎসা করা কঠিন হয়ে যাবে। তাই এই টিকা শিশুদের জীবন বাঁচাবে।
কারা নিতে পারবে?
জাতীয় কর্মসূচি অনুসারে ৯ মাস থেকে ১৫ বছর বয়সী সবাই টিকা নিতে পারবে।
অর্থাৎ ৯ মাসের কম বয়সী শিশু এই টিকা নিতে পারবে না। প্রাপ্তবয়স্ক বা ১৫ বছরের বেশি বয়সীরা চিকিৎসকের পরামর্শে নিতে পারেন।
তবে খেয়াল রাখবেন - ১০০° ফারেনহাইটের বেশি জ্বর থাকলে সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত টিকা দেওয়া যাবে না। এবং আগে টিকা নেওয়ার পর মারাত্মক অ্যালার্জি হলে বা বর্তমানে টাইফয়েডে আক্রান্ত থাকলে টিকা নেওয়া নিষেধ।

আগে টাইফয়েডে আক্রান্ত হলে টিকা নেওয়া যাবে?
হ্যাঁ, আগে টাইফয়েড হলেও টিকা নেওয়া যাবে এবং উচিত। পূর্বে টাইফয়েড হলেও পুনরায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। তাই জ্বর থেকে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠার পর চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী টিকা নেওয়া উচিত।
এই টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলো কী কী?
টাইফয়েড টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সাধারণত মৃদু এবং সাময়িক হয়ে থাকে-
- ইনজেকশনের স্থানে হালকা ব্যথা, ফোলাভাব বা লালচে হওয়া।
- ৯% শিশুর ক্ষেত্রে সামান্য জ্বর দেখা গেছে।
- মাথাব্যথা বা ক্লান্তি। এই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলো সাধারণত কোনো চিকিৎসা ছাড়াই সেরে যায়।
টিকা নিলে কি টাইফয়েড আবার হতে পারে?
হ্যাঁ, টিকা নিলেও টাইফয়েড আবার হতে পারে, তবে ঝুঁকি অনেক কমে যায়। টিকা ১০০% সুরক্ষা দেয় না, তবে এর কার্যকারিতা প্রায় ৮৫% বা তার বেশি। সেই সঙ্গে টিকা রোগের তীব্রতা কমায় এবং জটিলতা সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনাও কমিয়ে দেয়।
তবে টিকা নিলেও সুরক্ষার জন্য টিকার পাশাপাশি ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা এবং নিরাপদ পানির অভ্যাস বজায় রাখা অপরিহার্য।
এএমপি/জিকেএস

10 hours ago
5








English (US) ·