বাংলাদেশে প্রতিবছর এক লাখ ৬৭ হাজার মানুষ নতুন করে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়। বছরে এই রোগে মারা যায় প্রায় এক লাখ সতেরো হাজার মানুষ। ব্যয়বহুল চিকিৎসা নিতে গিয়ে একেকটা পরিবার হয়ে যায় নিঃস্ব। নিরুপায় হয়ে আসে সরকারের সহায়তা নিতে। কিন্তু বিধিবাম চিকিৎসা সহায়তার এই খাতেও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। বরাদ্দ, অর্থছাড় ও প্রাপ্তির দীর্ঘসূত্রিতার মধ্যে মারা যায় রোগী। যদিও সমাজসেবা অধিদপ্তর বলছে, দ্রুতই দেওয়ার চেষ্টা করে তারা।
ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করে ১০ মে ২০২২ সালে মারা যান নোয়াখালীর আব্দুল কাদের কাজী। চিকিৎসা নিয়েছিলেন আহসানিয়া মিশন ক্যানসার হাসপাতালে। রোগের ছেলে ইয়াসিন আরাফাত জাগো নিউজকে বলেন, বাবার চিকিৎসা চালাতে অনেক টাকা খরচ হয়েছে। ২০২১ সালে যখন আহসানিয়া মিশন হাসপাতালে ভর্তি হই এর কিছুদিন পরে ক্যানসার আক্রান্ত রোগীর জন্য সরকারিভাবে যে টাকা দেয় সেটার জন্য অ্যাপ্লাই করি। কিন্তু বাবা বেঁচে থাকতে সে টাকা পাননি। বাবা মারা যাওয়ার ৬ মাস পর সেই টাকা পেয়েছি। এখন টাকা দিয়ে কী করবো।
পাকস্থলীর ক্যানসার আক্রান্ত হয়ে রাজধানীর ইবনে হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন আবুল খায়ের। শারীরিক কষ্টের পাশাপাশি চিকিৎসার ব্যয় নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে আবুল খায়েরের পরিবার।
রোগীর ছেলে ইকবাল হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, গত বছরের শুরুতে বাবা ক্যানসারে আক্রান্ত হয়। শুরু থেকে এখন পর্যন্ত অনেক টাকা খরচ হয়ে গেছে। চিকিৎসকের ভিজিট, ছয়টি ক্যামোথেরাপি, বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার খরচ চালাতে খুব কষ্ট হচ্ছে। গ্রাম থেকে এসে এসে চিকিৎসা করাচ্ছি। কোনো সরকারি হাসপাতালে সিট খালি পাইনি। গ্রামের একজন থেকে শুনে সরকারি এ ফান্ডের জন্য আবেদন করেছিলাম। কিন্তু এখনো টাকার কোনো খোঁজ পাচ্ছি না। আমার বাবার অবস্থা দিন দিন অবনতি হচ্ছে, এই টাকা পেলে হয়তো বাড়তি চিকিৎসা করাতে পারতাম।
চাটখিল উপজেলা সমাজসেবা অফিসার মো. আলী হোসাইন জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের এখানে যত আবেদন আসে, সেগুলো জেলা শহরে পাঠিয়ে দিই। সেখান থেকে যাচাই-বাছাই করে সিলেক্ট করে ঢাকায় পাঠানো হয়। যেই আবেদনটা আসছে সেটা আমরা নোয়াখালী জেলা প্রশাসন অফিসে পাঠিয়ে দিয়েছি।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের পরিচালক (সামাজিক নিরাপত্তা) মোশাররফ হোসেন বলেন, আবেদনপত্র যাচাই-বাছাই হয় এবং জেলা পর্যায়ে টিম আছে, ওই মিটিংয়ে পাস হয়। পাস হওয়ার পর পর আমরা যতদ্রুত সম্ভব চেক হস্তান্তরের চেষ্টা করি। কিন্তু আমাদের অধিদপ্তর থেকে বছরে ৪টা বরাদ্দ যায় এ খাতে। অর্থাৎ তিন মাস পর পর বরাদ্দ দেওয়া হয়। এখন কেউ যদি ওই তিন মাসের শুরুর দিতে আবেদন করেন, স্বাভাবিকভাবে শেষদিকে মিটিংয়ে পাস হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) সহযোগী সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অব ক্যানসার (আইএআরসি) প্রকাশিত হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিবছর এক লাখ ৬৭ হাজার মানুষ ক্যানসারে আক্রান্ত হয়। বছরে এ রোগে মারা যায় প্রায় এক লাখ ১৭ হাজার মানুষ।
আরও পড়ুন
- ক্যানসার আক্রান্তদের বাঁচাতে ও আক্রান্ত হওয়া প্রতিরোধে ৯ সুপারিশ
- চলতি বছরে চালু হচ্ছে চার ক্যানসার হাসপাতাল: অধ্যাপক সায়েদুর রহমান
- বছরে প্রতি লাখে নতুন করে ক্যানসার আক্রান্ত হয় ৫৩ জন
বাংলাদেশে ক্যানসারের বোঝা: জনসংখ্যাভিত্তিক ক্যানসার রেজিস্ট্রি শীর্ষক এক গবেষণায় উঠে এসেছে, দেশে প্রতি লাখে ক্যানসারের আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ১০৬ জন। এছাড়া প্রতিবছর এ রোগে নতুন করে আক্রান্ত হচ্ছেন ৫৩ জন। প্রাথমিকভাবে ৪৬ হাজার ৬৩১টি পরিবারের দুই লাখ এক হাজার ৬৬৮ জন গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত হন। যার মধ্যে ৪৮ দশমিক ৪ শতাংশ পুরুষ এবং ৫১ দশমিক ৬ শতাংশ নারী। মোট ক্যানসার রোগীর সংখ্যা ছিল ২১৪ এবং ক্যানসারের প্রাদুর্ভাব ছিল প্রতি লাখে ১০৬ জন। আর পুরুষদের ক্ষেত্রে প্রতি লাখে ১১৮ জন এবং নারীদের জন্য প্রতি লাখে ৯৬ জন।
কিশোরগঞ্জের হোসেনপুর উপজেলায় ২০২৩ সালের জুলাই মাস থেকে গবেষণাটি পরিচালিত হয়ে আসছে। এ গবেষণায় প্রত্যেক বাড়িতে বিশেষভাবে তৈরি করা ইন্টারনেট ভিত্তিক ক্যানসার নিবন্ধন সফটওয়্যার করে সাক্ষাৎকার গ্রহণের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহণ করা হয়েছে। এক বছর পূর্তিতে একই পরিবারের ফলোআপ পরিদর্শন ২০২৪ সালের জুলাই মাসে শুরু হয়েছে।
দুই লাখ মানুষের ওপর এ গবেষণা পরিচালন করা হয়। বাংলাদেশে ৩৮ ধরনের ক্যানসারের রোগী পাওয়া গেছে। প্রতি লাখে ১০৬ জন ক্যানসারে আক্রান্ত রোগী পাওয়া গেছে। ৯৩ শতাংশ রোগীর বয়স ১৮ থেকে ৭৫ বছর। ক্যানসার রোগীদের মধ্যে দুই দশমিক ৪ শতাংশ শিশু রয়েছে। ৫ দশমিক এক শতাংশ রোগীর বয়স ৭৫ বছরের বেশি। পাঁচটি প্রধান ক্যানসার হলো- স্তন, মুখ, পাকস্থলী, শ্বাসনালি এবং জরায়ু-মুখের ক্যানসার। পুরুষদের পাঁচটি প্রধান ক্যানসার হলো শ্বাসনালি, পাকস্থলী, ফুসফুস, মুখ ও খাদ্যনালির ক্যানসার।
নারীদের পাঁচটি প্রধান ক্যানসার হলো- স্তন, জরায়ুমুখ, মুখ, থাইরয়েড এবং ওভারি (ডিম্বাশয়)। ক্যানসার আক্রান্ত পুরুষ রোগীদের ৭৫ দশমিক ৮ শতাংশ ধূমপায়ী এবং ধোঁয়াহীন পান, জর্দা, তামাক সেবনকারী ৪০ দশমিক ৫ শতাংশ। ক্যানসার আক্রান্ত নারী রোগীদের মধ্যে ৬০ দশমিক ৬ শতাংশ ধোঁয়াহীন পান, জর্দা, তামাক সেবনকারী।
৪৬ শতাংশ রোগীর ক্যানসারের সঙ্গে তামাক সেবনের সম্পর্ক রয়েছে। ক্যানসার আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে ৬০ শতাংশ কম্বাইন্ড চিকিৎসা নিয়েছে এবং ৭ দশমিক ৪ শতাংশ রোগী কোনো চিকিৎসাই নেয়নি। দেশে মোট মৃত্যুর ১২ শতাংশ ক্যানসারে আক্রান্ত রোগী। মৃত রোগীদের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে ফুসফুস, শ্বাসনালি ও পাকস্থলীর ক্যানসার। প্রতিবছর নতুন করে প্রতি লাখে ৫৩ জন রোগী ক্যানসারে আক্রান্ত হয়। আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে ফুসফুস, লিভার ও শ্বাসনালির ক্যানসারের রোগীর সংখ্যা বেশি।
গবেষণায় জনসংখ্যা ৩৮টি বিভিন্ন ধরনের ক্যানসারে আক্রান্ত চিহ্নিত হয়েছে। এদের ৯২ দশমিক ৫ শতাংশ ক্যানসার রোগী ১৮ থেকে ৭৫ বছর বয়সী। ১৮ বছরের নিচে দুই দশমিক ৪ শতাংশ এবং ৭৫ বছরের ঊর্ধ্বে ৫ দশমিক এক শতাংশ।
ক্যানসার আক্রান্তদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পাঁচটি ক্যানসার হলো- স্তন ক্যানসার, মোট আক্রান্তের মধ্যে ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ, ঠোঁট/ মৌখিক গহ্বর ৮ দশমিক ৪ শতাংশ, পেট ৭ শতাংশ, গলা ৭ শতাংশ এবং জরায়ু ৫ দশমিক এক শতাংশ।
আরও পড়ুন
- ‘ডায়াবেটিস-কিডনি-ক্যানসার রোগীদের বিশেষ সতর্ক থাকতে হবে’
- জরায়ুমুখের ক্যানসার সচেতনতায় গণস্বাস্থ্য হাসপাতালের পদযাত্রা
- ক্যানসারে আক্রান্ত জিসানের চিকিৎসার দায়িত্ব নিলেন তারেক রহমান
পুরুষদের মধ্যে, গলার ক্যানসার আক্রান্ত সবচেয়ে বেশি ছিল ১৩ শতাংশ। অন্যান্য প্রধান ক্যানসার ছিল পেট ১০ দশমিক ৪ শতাংশ, ফুসফুস ৮ দশমিক ৭ শতাংশ। ঠোঁট ও মৌখিক গহ্বর ৭ শতাংশ এবং খাদ্যনালি ৬ দশমিক এক শতাংশ।
নারীদের মধ্যে, স্তন ক্যানসার ছিল সবচেয়ে সাধারণ ক্যানসার ৩৬ দশমিক ৪ শতাংশ। এছাড়া জরায়ুর ক্যানসার ১১ দশমিক এক শতাংশ। ঠোঁট ও মৌখিক গহ্বরের ক্যানসার ১০ দশমিক এক শতাংশ, থাইরয়েড ৭ দশমিক এক শতাংশ এবং ডিম্বাশয় ৫ দশমিক এক শতাংশ অন্যান্য প্রধান ক্যানসার ছিল।
নারীদের ক্যানসারে ১৯ শতাংশই নারী প্রজননতন্ত্রে ক্যানসারে আক্রান্ত। যেমন জরায়ু ক্যানসার ১১ শতাংশ, ডিম্বাশয় ৫ শতাংশ, এবং জরায়ু তিন শতাংশ। ক্যানসার রোগের সঙ্গে রোগীদের ১৭ শতাংশ উচ্চ রক্তচাপে, ডায়াবেটিসে ১১ শতাংশ, হৃদরোগ ৬ শতাংশ, দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ তিন শতাংশ, এবং স্ট্রোক দুই শতাংশ।
ক্যানসারে আক্রান্ত পুরুষদের মধ্যে ৭৫ দশমিক ৮ শতাংশ ধূমপায়ী। সর্বমোট ক্যানসারের ৪৬ শতাংশ তামাক (ধূমপান ও তামাকবিহীন) সেবনের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল। ৬০ শতাংশ ক্যানসার রোগী সার্জারি, কেমোথেরাপি এবং রেডিওথেরাপির সংমিশ্রণ চিকিৎসা পেয়েছিলেন। ৭ দশমিক ৪ শতাংশ রোগীকে কোনো চিকিৎসা দেওয়া হয়নি।
এছাড়া ফলোআপে গত ১ জুলাই ২০২৪ থেকে এ বছর ১৪ জানুয়ারি পর্যন্ত ১৩ হাজার ৪১১টি পরিবারের ৫৮ হাজার ৫৩৯ জন অংশগ্রহণকারীর ফলোআপ করা হয়েছিল। এক বছরে নতুন ক্যানসার রোগীর সংখ্যা যুক্ত হয়েছে প্রতি লাখে ৫২ দশমিক ৯ জন। নতুন সংযোজিত তিনটি প্রধান ক্যানসার হলো: ফুসফুস ১৬ দশমিক এক শতাংশ, যকৃৎ ১২ দশমিক ৯ শতাংশ এবং গলা ১২ দশমিক ৯ শতাংশ।
পুরুষদের জন্য, নতুন সংযোজিত ক্যানসারের মধ্যে তিনটি প্রধান ক্যানসার হলো ফুসফুস ১৬ দশমিক এক শতাংশ, যকৃৎ ১২ দশমিক ৯ শতাংশ এবং স্বরযন্ত্রের (গলা) ক্যানসার ১২ দশমিক ৯ শতাংশ।
নারীদের নতুন সংযোজিত ক্যানসার হলো- লিভার (যকৃৎ) ২৩ দশমিক এক শতাংশ, জরায়ুর ক্যানসার ১৫ দশমিক ৪ শতাংশ এবং খাদ্যনালির ক্যানসার ১৫ দশমিক ৪ শতাংশ। মোট মৃত্যুর মধ্যে ক্যানসারে মৃত্যুর কারণ হলো ১১ দশমিক ৯ শতাংশ বা প্রায় ১২ শতাংশ। ক্যানসারে মৃত রোগীদের মধ্যে ছিল ফুসফুসে ক্যানসার ১১ দশমিক ৪ শতাংশ, স্বরযন্ত্র (গলা) ক্যানসার ৮ দশমিক ৫ শতাংশ এবং পেট ক্যানসার ৫ দশমিক ৭ শতাংশ। পুরুষদের মধ্যে মৃত্যুর প্রধান দুটি ক্যানসার হলো ফুসফুস ১৯ শতাংশ এবং স্বরযন্ত্র ১৪ দশমিক ৩ শতাংশ এবং নারীদের মধ্যে মৃত্যুর প্রধান কারণ স্তন ক্যানসার ১৪ দশমিক ৩ শতাংশ এবং পেট ক্যানসার ১৪ দশমিক ৩ শতাংশ।
এসইউজে/এমএএইচ/এমএস