সরকারি কর্মকর্তাদের টিকটক ব্যবহারের কারণে কর্মপরিবেশ ও নিরাপত্তা নিয়ে ক্রমেই উদ্বেগ বাড়ছে। তবুও এক শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যেন কোনোভাবেই এই অশুভ কার্যক্রম থেকে নিবৃত্ত করা যাচ্ছে না। তেমন একজন কর্মকর্তা ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (ডিপিডিসি) সাত মসজিদ ডিভিশনের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী (এস.ডি.ই) সাজেদুল ইসলাম সোহাগ। তিনি এতটাই টিকটক আসক্তিতে মগ্ন থাকেন যে, যখন তখন যেকোনো স্থানে টিকটক করেন। এমনকি তার অফিসিয়াল সময়ে অফিস কক্ষেও টিকটক ভিডিও তৈরি করেন।
আর এসব বিষয় উল্লেখ করেই আসাদুজ্জামান নামক একজন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রনালয় বিষয়ক উপদেষ্টা ও সচিব এবং ডিপিডিসি ব্যাবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) বরাবর আলাদা আলাদাভাবে অভিযোগ দাখিল করেছেন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, দাখিলকৃত অভিযোগ এবং বিভিন্ন তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, অফিস কক্ষে সাজেদুল ইসলাম সোহাগ একাধিক বিনোদনমূলক টিকটক ভিডিও তৈরি ও প্রকাশ করেছেন। এসব ভিডিওর অনেকটিতে আবার ডিপিডিসি’র অফিসিয়াল আইডি কার্ড ও নাম-লোগো সম্বলিত ফিতা দিয়ে গলায় ঝুলানো রয়েছে। যা সরকারি কর্মচারি আচরণ বিধিমালা ১৯৭৯ ও সরকারি কর্মচারি (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা ২০১৮-এর সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডিপিডিসি’র একজন নির্বাহী প্রকৌশলী জানান, বিভিন্ন কর্মকর্তা তাকে বারবার সতর্ক করলেও তিনি এ ব্যাপারে ভ্রুক্ষেপ করছেন না। তাছাড়া প্রকৌশলী সাজেদুল ইসলাম সোহাগের এহেন কর্মকাণ্ড ডিপিডিসি’র শৃঙ্খলা পরিপন্থি ও অসদাচরণের শামিল। যা সংস্থাটির ভাবমূর্তি নষ্ট করছে। তার এই কর্মকাণ্ড কেবল পেশাদারিত্বকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে না, বরং কাজের প্রতি মনোযোগ কমে এবং অপ্রয়োজনীয় কাজে সময় নষ্টের মাধ্যমে জনমনে নেতিবাচক বার্তা ছড়াচ্ছে।
তিনি বলেন, সরকারি কর্মচারী হয়ে অফিস চলাকালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিনোদনের নামে ভিডিও বানানো কিংবা টিকটক করা শুধু দায়িত্বজ্ঞানহীন নয়, এটি প্রশাসনিক শৃঙ্খলার চরম লঙ্ঘন।
এ ব্যাপারে প্রকৌশলী সাজেদুল ইসলাম সোহাগ বলেন, আমি শখের বসে টিকটক করতে করতে এক সময় অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছে। আমার পদমর্যাদা অনুযায়ী এটি করা ঠিক হয়নি। ইতোমধ্যেই টিকটক আইডিটি বন্ধ করে দিয়েছি। তিনি বলেন, এটি আমার একটি ভুল কাজ ছিল। এর কারণে আমার ও ডিপিডিসি’র সুনাম প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। এটি করা আমার মোটেই উচিত হয়নি।
জানা যায়, ২০২২ সালে চট্টগ্রাম বন্দরের এক নিরাপত্তা কর্মকর্তা বরখাস্ত হন রিল ভিডিওর জন্য। ২০২৩ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এক কনস্টেবল সাময়িক বরখাস্ত হন টিকটক বানানোর জন্য। ২০২৪ সালে নোয়াখালীর এক সিনিয়র নার্সের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয় হাসপাতালের ওয়ার্ডে ভিডিও করার কারণে।
সরকারি কর্মকর্তাদের টিকটক ভিডিও তৈরি করা কিংবা ব্যবহারের কারণে নিরাপত্তা ও গোপনীয়তা সংক্রান্ত ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। যা জাতীয় নিরাপত্তার জন্যও হুমকি হতে পারে। তাছাড়া কর্মক্ষেত্রে তাদের টিকটক ব্যবহারের ফলে কাজের প্রতি মনোযোগ কমে যাওয়া এবং অপ্রয়োজনীয় কাজে সময় নষ্ট হওয়ার মতো সমস্যাও দেখা দিতে পারে।
সমাজ বিশ্লেষক ও কলাম লেখক লীনা পারভীন এ ব্যাপারে বলেন, দেশের কিশোর প্রজন্ম নিয়ে আমি খুবই চিন্তিত। তারা যেভাবে টিকটকের প্রতি আসক্তি প্রকাশ করছে তাতে তারা নিজেদের জীবনও অনেক সময় ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে।
তিনি বলেন, সমাজে কোনো আদর্শিক চর্চা না থাকায় বর্তমান প্রজন্ম বিভ্রান্তীতে রয়েছে। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন এখন হয় না বললেই চলে। নেই পাড়ায় পাড়ায় ক্লাব চর্চাও। আর তাই এর থেকে বর্তমান প্রজন্মকে রক্ষার উপায় নিয়ে আমাদের ভাবার সময় এসেছে।
সরকারি কর্মচারীদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উপস্থিতি নিয়ে বিতর্ক নতুন নয়। কিন্তু যখন তা অফিসিয়াল সময় ও দাপ্তরিক পরিচয় ব্যবহার করে হয়, তখন তা কেবল একটি ব্যক্তির নয় পুরো সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নের মুখে ফেলে। এখন দেখার বিষয়, এই টিকটক বিতর্ক প্রকৌশলী সোহাগকে ভাইরাল থেকে বেকার করে দেয় কি না।
এ বিষয় ডিপিডিসির নির্বাহী পরিচালক (এডমিন এন্ড এইচ আর) সোনামনি চাকমা বলেন, তদন্ত সাপেক্ষে সার্ভিস রুল ও বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কোনো প্রকার ছাড় দেওয়া হবে না। আমরা লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। তদন্ত চলছে, দোষী প্রমাণিত হলে অবশ্যই আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।