ট্রাম্প প্রশাসনের ‘উগ্র দক্ষিণপন্থি’ নতুন যুক্তরাষ্ট্র

7 hours ago 3
উগ্র দক্ষিণপন্থি ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন ক্ষমতায় ফেরার পর থেকেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এক অস্থিরতার ছায়া নেমে এসেছে। বিশ্বের রাজনৈতিক ভরকেন্দ্র যেন দুলে উঠেছে। ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে প্রতিদিনের বোমাবর্ষণকে প্রকাশ্য সমর্থন, ইসরায়েলকে ইরান হামলার দুঃসাহসী ইঙ্গিত, ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপট, দক্ষিণ এশিয়ার নীতি, বার্মা অ্যাক্ট কিংবা আর্মেনিয়া-আজারবাইজানের ভূরাজনীতি—সবকিছুতেই ট্রাম্প প্রশাসন তার একতরফা অবস্থান চাপিয়ে দিচ্ছে। এই উগ্র রূপান্তর আসলে নতুন কিছু নয়; শুরু থেকেই অনুমান করা হচ্ছিল, ট্রাম্প রাষ্ট্র পরিচালনায় ফেরার সঙ্গে সঙ্গে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি আগের চেয়ে অনেক বেশি একপেশে, কঠোর ও অনিশ্চিত হয়ে উঠবে। সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের ভিসা বাতিল তারই স্পষ্টতম প্রতিফলন। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত ছয় হাজারেরও বেশি আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীকে আমেরিকা থেকে কার্যত বিতাড়িত করা হয়েছে। প্রশাসনের যুক্তি—মেয়াদোত্তীর্ণ অবস্থায় দেশে অবস্থান, আইন ভঙ্গ, কিংবা অপরাধে জড়িত থাকার কারণে এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। আরও উদ্বেগজনক হলো, কয়েকশ শিক্ষার্থীকে অভিযুক্ত করা হয়েছে তথাকথিত ‘সন্ত্রাসবাদে সমর্থন’ প্রদানের অভিযোগে। প্রথম দর্শনে এটি কঠোর আইন প্রয়োগের দৃষ্টান্ত মনে হতে পারে; কিন্তু গভীরে গেলে প্রতীয়মান হয়—এটি আসলে ‘একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক প্রকল্প’, আদতে জায়নবাদী ধৃষ্টতা যেখানে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের সচেতনভাবেই লক্ষ্যবস্তু করা হচ্ছে। ফিলিস্তিন ইস্যুকে ঘিরে মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্র-ছাত্রীদের আন্দোলন ট্রাম্প প্রশাসনের অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রো-প্যালেস্টাইন আন্দোলনে যুক্ত থাকা শিক্ষার্থীদের ওপর যে দমননীতি কার্যকর হয়েছে, তা এরই প্রমাণ। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র মাহমুদ খালিল কিংবা টাফটস বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক রুমেইসা ওজতুর্কের গ্রেপ্তার এই অমানবিক বাস্তবতাকে সামনে নিয়ে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষা ও গবেষণার স্বাধীনতাকে তার শক্তি হিসেবে তুলে ধরেছে। কিন্তু আজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব হয়ে গেলে সেগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়; বরং এক ধরনের নিয়ন্ত্রিত শিবিরে পরিণত হবে। হার্ভার্ডে গ্র্যাজুয়েটদের ঘিরে যে সংকট তৈরি হয়েছে, তা এই বৃহত্তর দ্বন্দ্বের প্রতীক। অন্যদিকে, আমেরিকার এই নীতির প্রতিক্রিয়া বিশ্বব্যাপী শিক্ষা ব্যবস্থার ভারসাম্য বদলে দিতে পারে। আমেরিকা দীর্ঘকাল বিশ্বমানের মেধার কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হয়ে এসেছে। নোবেল বিজয়ীদের বড় একটি অংশই কোনো না কোনো সময় মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন বা গবেষণা করেছেন। আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের অবদান ছাড়া আমেরিকার বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও সংস্কৃতি আজকের উচ্চতায় পৌঁছাতে পারত না। অথচ আজ তাদের ওপর অবিশ্বাস চাপিয়ে দিয়ে প্রশাসন নিজের ভবিষ্যৎ প্রতিযোগিতামূলক শক্তিকেই ক্ষয় করছে। এর বিপরীতে কানাডা, ইউরোপ ও এশিয়ার অনেক বিশ্ববিদ্যালয় বিকল্প গন্তব্য হিসেবে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে। এর ফলে মার্কিন গবেষণা ও উদ্ভাবনের নেতৃত্ব ধীরে ধীরে ক্ষয়প্রাপ্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। এটি কেবল একটি প্রশাসনিক পদক্ষেপ নয়; বরং একটি রাজনৈতিক বার্তা। শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে ট্রাম্প প্রশাসনের বার্তা স্পষ্ট—যে কেউ প্রতিবাদ করবে, যে কেউ ইসরায়েলের গণহত্যার বিরুদ্ধে কথা বলবে, সে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসের ক্ষেত্রে ‘অবৈধ’ হয়ে যাবে। অর্থাৎ, আমেরিকায় থাকতে হলে শিক্ষার্থীদের নীরব থাকতে হবে, প্রতিবাদ করতে হলে তাদের নিজ দেশে ফিরে যেতে হবে। তবে এখানে প্রশ্ন থেকেই যায়—এ ধরনের পদক্ষেপ আমেরিকাকেই শেষ পর্যন্ত বিপদে ফেলবে না কি? যুক্তরাষ্ট্র আজ যে নির্লজ্জভাবে মানবাধিকার উপেক্ষা করছে, তা কেবল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন নয়, বরং নিজ দেশের গণতান্ত্রিক ভিত্তিকেও দুর্বল করে দিচ্ছে। স্বল্পমেয়াদে এই পদক্ষেপ উগ্র দক্ষিণপন্থি জায়নবাদী ভোটব্যাংককে খুশি করতে পারে; কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এর ফল হবে আত্মঘাতী। ন্যায়ভিত্তিক ও স্বচ্ছ বিচারপ্রক্রিয়ার নিশ্চয়তা রেখে কোনো শিক্ষার্থী সত্যিই যদি অপরাধে জড়িত হয়, তবে তাকে যথাযথ প্রমাণের ভিত্তিতে এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ড অনুযায়ী বিচার করার কথা। কিন্তু সেটা না করে বর্তমানে কয়েকজন ব্যক্তির ওপর আরোপিত অপরাধের মিথ্যা দায় হাজারো আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীর ঘাড়ে চাপিয়ে তাদের ভিসা বাতিল করা হচ্ছে। নানা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবাদী শিক্ষার্থীদের নির্বিচারে বহিষ্কারও করা হচ্ছে। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসন মানতে চাইছে না ক্ষমতার অতি প্রয়োগ অগণতান্ত্রিক ও বৈষম্যমূলক পদক্ষেপ হিসেবে যে শিক্ষার্থীরা অপরাধী নয়—তাদের অপরাধী বানানোর অপরাজনীতির সূচনা করেছে। গণতান্ত্রিক চেতনার পরিপন্থি এই নীতির মাধ্যমে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্বাধীন মতপ্রকাশকে দমন করা, রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগ করে শিক্ষাক্রম বা নিয়োগনীতিতে হস্তক্ষেপ করা উচ্চশিক্ষার মূল দর্শনকে বিপর্যস্ত করবে নিঃসন্দেহে।  যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘকাল ধরে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রতীক হিসেবে নিজেকে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরেছে। আজ যদি তারা সেই মূল্যবোধ থেকে বিচ্যুত হয়, তবে তাদের বৈশ্বিক ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন হবে। যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্যে হলেও এখন আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট সুরক্ষা নীতি গড়ে তোলা জরুরি। রাজনৈতিক প্রতিশোধ বা নির্বিচারে আইনি হয়রানির শিকার না হয়ে তারা যেন নিরাপদ পরিবেশে শিক্ষা লাভ করতে পারে, সেই নিশ্চয়তা দিতে হবে। এই নীতি কেবল শিক্ষার্থীদের নয়, বরং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেও আশ্বস্ত করবে, যেহেতু তাদের গবেষণা ও একাডেমিক সুনাম অনেকাংশে নির্ভর করে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের ওপর। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো, যদি যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের জন্য অনিরাপদ হয়ে ওঠে, তবে কানাডা, জার্মানি, জাপান কিংবা দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশগুলো সেই শূন্যস্থান পূরণ করতে পারে। এতে যেমন ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষার্থীরা নতুন শিক্ষার পরিবেশে নিজেদের স্বপ্ন পূরণ করতে পারবে, তেমনি বিশ্বব্যাপী জ্ঞানচর্চা ও গবেষণার নতুন কেন্দ্রও গড়ে উঠতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের এহেন নীতি হয়তো সাময়িকভাবে কিছু রাজনৈতিক লাভ দেবে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে সে হারাবে প্রতিভাবান তরুণদের অবদান এবং বৈশ্বিক বৌদ্ধিক নেতৃত্বের আসন। এজন্যই ট্রাম্প প্রশাসনের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত এবং তাদের শিক্ষা, জ্ঞান ও স্বাধীন মতপ্রকাশকে ভয় পাওয়ার পাশাপাশি দমনের রাজনীতি আমেরিকার ভবিষ্যতের জন্যও ভয়ংকর। জ্ঞান বিকাশ ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার গলা টিপে ধরা তাদের জন্য এককথায় আত্মবিনাশের পথে হাঁটা।  গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং মুক্ত জ্ঞানের বিপরীতে ট্রাম্প প্রশাসনের উগ্র দক্ষিণপন্থি রাজনীতির রূপান্তর যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও প্রতিষ্ঠিত ঐতিহ্যকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দিচ্ছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বজুড়ে তারা যে সফট পাওয়ার তৈরি করেছিল সেখানে তাদের ব্র্যান্ড হয়ে দাঁড়ায় মানবতার পক্ষে দাঁড়ানো, জ্ঞানের মুক্তিকে রক্ষা করা এবং আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন পিছিয়ে পড়া গোষ্ঠীর পাশে দাঁড়িয়ে তাদের নিরাপদ ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা। ট্রাম্প প্রশাসনের নীতি তাদের জায়নবাদী ভোটব্যাংককে উচ্ছ্বসিত করলেও বহুবছর ধরে গড়ে তোলা সফট পাওয়ারকে তাসের ঘরের মতো ধসিয়ে দিতে খুব একটা সময় নেবে না। ফিলিস্তিনে গণহত্যার পক্ষে ট্রাম্প প্রশাসনের যে নীতি তাতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রচলিত রাজনৈতিক অবস্থান অনেকটা অবনমিত হয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে দীর্ঘদিনে গড়ে ওঠা যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক অবস্থান ও সফট পাওয়ার অনেকটাই কর্পূরের মতো হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে।  লেখক : ড. মো. আদনান আরিফ সালিম, গবেষক ও কন্টেন্ট ক্রিয়েটর। সহযোগী অধ্যাপক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়। 
Read Entire Article