ট্রাম্পের ‘চাঁদাবাজির’ প্রস্তাবে কী করবে ইউক্রেন

3 hours ago 4

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন প্রস্তাব ইউক্রেনের জন্য এক কঠিন পরীক্ষায় পরিণত হয়েছে। যদি ইউক্রেন ‘হ্যাঁ’ বলে, তাহলে তা দেশটির ভবিষ্যৎ বিক্রির শামিল হবে। আর যদি ‘না’ বলে, তাহলে মার্কিন সামরিক সহায়তা বন্ধ হয়ে যাবে, যা রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়াকে আরও কঠিন করে তুলবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে— ইউক্রেন কি ট্রাম্পের ‘অন্যায়’ শর্ত প্রত্যাখ্যান করে নিজেদের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে পারবে, নাকি চাপে পড়ে আপস করতে বাধ্য হবে?

ট্রাম্পের ‘নির্যাতনমূলক চুক্তি’ 

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ট্রাম্প প্রশাসন ইউক্রেনের জন্য এমন একটি প্রস্তাব নিয়ে এসেছে, যা কার্যত এক ধরনের ‘নির্যাতনমূলক চুক্তি’। এই চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, মার্কিন সহায়তার বিনিময়ে ইউক্রেনকে তার খনিজসম্পদ, বন্দর ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক খাত থেকে অর্জিত লাভের একটি বিশাল অংশ আমেরিকাকে ছেড়ে দিতে হবে।

তবে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি এই শর্তকে ‘অন্যায়’ বলে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন, সামরিক সহায়তা ছাড়া কোনো চুক্তি ইউক্রেনের জন্য গ্রহণযোগ্য নয়।

সহযোগিতা নাকি শোষণ? 

ট্রাম্প প্রশাসনের এই পরিকল্পনা মূলত একটি বিনিয়োগ তহবিল তৈরির নামে ইউক্রেনের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ দখলের কৌশল। নতুন চুক্তির শর্ত অনুসারে—ইউক্রেনকে তার ভবিষ্যৎ রাজস্বের ৫০% মার্কিন নিয়ন্ত্রণাধীন বিনিয়োগ তহবিলে জমা দিতে হবে। এই তহবিলের পরিমাণ ৫০০ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত না পৌঁছানো পর্যন্ত ইউক্রেনকে অর্থ প্রদান চালিয়ে যেতে হবে। 

যদিও ট্রাম্প প্রশাসন দাবি করছে যে, এই অর্থ তাদের ইউক্রেনকে দেওয়া সহায়তার সমপরিমাণ, কিন্তু বাস্তবে আমেরিকা এ পর্যন্ত ইউক্রেনকে এই পরিমাণের এক-চতুর্থাংশেরও কম দিয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি কোনো সাধারণ অর্থনৈতিক সহযোগিতা নয়, বরং এক ধরনের ‘রাজনৈতিক চাঁদাবাজি’। ইউক্রেনীয় কর্মকর্তারা একে ‘আলোচনা নয়, বরং শোষণমূলক চুক্তি’ বলে উল্লেখ করেছেন। তারা আশঙ্কা করছেন, ইউক্রেন যদি এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে, তবে আমেরিকা কঠোর প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা নিতে পারে, যার মধ্যে—সামরিক সহায়তা বন্ধ করা, যা রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধরত ইউক্রেনের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর হবে। স্টারলিংক স্যাটেলাইট পরিষেবা বন্ধ করা, যা ইউক্রেনের সামরিক ও যোগাযোগ ব্যবস্থার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

ইউক্রেনের সংকট ও বিকল্প পথ 

জেলেনস্কির প্রশাসনের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো, তারা যদি চুক্তি না মেনে চলে, তাহলে কী পরিণতি হবে? ট্রাম্প প্রশাসন সরাসরি রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনা করতে পারে, যা ইউক্রেনের জন্য ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে। মার্কিন সহায়তা পুরোপুরি বন্ধ হলে ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা দুর্বল হয়ে পড়বে, ফলে রাশিয়ার অগ্রযাত্রা সহজ হয়ে যাবে। 

অন্যদিকে, যদি ইউক্রেন এই চুক্তিতে সই করে, তাহলে জনগণ প্রবল বিক্ষোভে ফেটে পড়তে পারে, কারণ এটি দেশের সার্বভৌমত্ব বিক্রির শামিল।
এক ইউক্রেনীয় কর্মকর্তা বলেছেন, আমরা যদি এই শর্ত মেনে নিই, তাহলে জনগণ আমাদের ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেবে, এমনকি গণরোষের শিকারও হতে হতে পারি।

ট্রাম্প প্রশাসনের চাপপ্রয়োগ কৌশল 

এই চুক্তি চাপিয়ে দেওয়ার জন্য ট্রাম্প প্রশাসন বিভিন্ন কৌশল নিয়েছে— চলতি মাসের ১২ ফেব্রুয়ারিতে মার্কিন অর্থমন্ত্রী স্কট বসেন্ট কিয়েভে গিয়ে ইউক্রেনকে মাত্র এক ঘণ্টার মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষর করতে চাপ দেন। মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে একটি নতুন চুক্তির খসড়া দেওয়া হয়, যেখানে কিছুটা ভালো শর্ত থাকলেও সামরিক সহায়তার নিশ্চয়তা ছিল না।

২০ ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেন আরও কঠোর শর্তযুক্ত একটি ‘চূড়ান্ত চুক্তি’ পায়, যেখানে বলা হয়, আগের সব আলোচনার শর্ত বাতিল করতে হবে এবং নতুন শর্তগুলোই মানতে হবে। ট্রাম্প প্রশাসন পরিষ্কার করে দিয়েছে— ইউক্রেন যদি এই প্রস্তাব না মানে, তাহলে তাদের আরও কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে।

ইউক্রেনের সামনে কী পথ খোলা? 

ইউক্রেনের হাতে খুব বেশি বিকল্প নেই— যদি চুক্তি স্বাক্ষর করে : তাহলে দেশের গুরুত্বপূর্ণ খনিজ ও বন্দর ব্যবসার একটি বড় অংশ মার্কিন নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। এটি তাদের অর্থনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য বড় হুমকি। যদি চুক্তি প্রত্যাখ্যান করে : তাহলে সামরিক সহায়তা বন্ধ হতে পারে, যা রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধরত ইউক্রেনের অস্তিত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ। 

এমন পরিস্থিতিতে ইউক্রেন চেষ্টা করছে তুলনামূলকভাবে কম ক্ষতিকর বিকল্প বেছে নিতে। তারা চাইছে, আগের ‘ভালো চুক্তি’ নিয়ে আলোচনা পুনরায় শুরু হোক, যেখানে কিছুটা ন্যায্যতা ছিল। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসনের অবস্থান পরিবর্তনের সম্ভাবনা কম।

ট্রাম্পের দেওয়া চুক্তি আসলে ইউক্রেনের জন্য একটি ফাঁদ। এটি শুধু অর্থনৈতিক শোষণ নয়, বরং দেশটির সার্বভৌমত্ব ও ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার জন্যও হুমকি। যদিও ট্রাম্প প্রশাসন এটিকে অর্থনৈতিক সহযোগিতা হিসেবে প্রচার করছে, বাস্তবে এটি এক ধরনের ‘রাজনৈতিক চাঁদাবাজি’।

এখন দেখার বিষয়— ইউক্রেন এই চুক্তিকে দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করতে পারে, নাকি পরিস্থিতির চাপে একপ্রকার বাধ্য হয়ে ট্রাম্পের শর্ত মেনে নিতে বাধ্য হয়।

Read Entire Article