প্রায় ৪০ ঘণ্টা ধরে ভোট গণনার পর অবশেষে ঘোষণা হলো জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) নির্বাচনের ফলাফল। মাত্র ১১ হাজার ভোটের হিসাব করতে তিনদিন সময়—এটা নিঃসন্দেহে বিস্ময়কর। শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হলো শিবিরপন্থি প্যানেল। অথচ ফলাফল আসলে অনেকটা আগেই অনুমেয় ছিল। কারণ ভোট চলাকালীন ছাত্রদল এবং পরে আরও কয়েকটি প্যানেলের সরে দাঁড়ানো পুরো প্রক্রিয়াটিকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে দিয়েছিল।
নির্বাচনের দিন সকাল থেকেই অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। ভোটকেন্দ্রে অনুপ্রবেশ, বাধা, এমনকি প্রশাসনের সরাসরি হস্তক্ষেপের অভিযোগ ছিল শিক্ষার্থীদের মুখে। দুপুরে আরও তিনটি প্যানেল নির্বাচন বর্জন করে। একজন কমিশনারসহ চারজন শিক্ষক নির্বাচন কমিশন থেকে পদত্যাগ করেন। তাদের অভিযোগ—পরিস্থিতি এতটাই একপেশে হয়ে গেছে যে কমিশনের ভেতরে থেকেও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। প্রশ্ন জাগে, ভোট গণনায় এত বিলম্ব কি কেবল কারিগরি জটিলতা, অনভিজ্ঞতা, নাকি আগেভাগেই নির্ধারিত ফলাফলকে বৈধতার আবরণ দেওয়ার প্রয়াস?
বাংলাদেশের গণতন্ত্র বোঝার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বরাবরই একটি আয়না। এখানে যে প্রবণতা দেখা যায়, জাতীয় রাজনীতিতে কিছুদিন পরই তার প্রতিফলন ঘটে। ডাকসুর পর এবার জাকসুর নির্বাচনও সেই সত্যকে আরও স্পষ্ট করে সামনে আনলো। ডাকসুতে কারচুপির অভিযোগ ছিল, তবে তখনো একটা আনুষ্ঠানিকতা বজায় ছিল। বিএনপিপন্থিরা ফলাফলে অসন্তুষ্ট হলেও নির্বাচিতদের অভিনন্দন জানিয়েছিল—অন্তত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি আস্থা বজায় রাখার চেষ্টা ছিল। কিন্তু জাকসুতে সে পথ আর খোলা থাকেনি। এবার অভিযোগের মাত্রা এতটাই তীব্র হয়েছে যে বৈধতার ছায়াটুকুও অটুট রাখা যায়নি।
পাঁচটি প্যানেলের প্রার্থীর সরে দাঁড়ানো, কমিশনের ভেতর থেকে শিক্ষকদের পদত্যাগ— সব মিলিয়ে জাকসুর ফলাফলের প্রতি আস্থার ভরাডুবি ঘটেছে। প্রশাসনের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। কর্মকর্তাদের অসুস্থ হয়ে পড়া কিংবা একজন পোলিং অফিসারের মৃত্যুর মতো ঘটনাও এই নির্বাচনের জটিলতা নতুন মাত্রা দিয়েছে। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচনে এতটা চাপ ও বিতর্ক—এ কেবল ছাত্র রাজনীতির সংকট নয়, বরং গোটা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার সংকেত।
ডাকসু হোক বা জাকসু—এসব নির্বাচন কেবল ছাত্র সংসদের নেতৃত্ব বাছাই নয়। এগুলো জাতীয় রাজনীতির প্রতিচ্ছবি, পূর্বাভাস। প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি যখন বিশ্ববিদ্যালয়কে ব্যবহার করছে মহড়া হিসেবে, তখন জনগণের সামনে প্রশ্ন স্পষ্ট—বাংলাদেশ কি ন্যায়সঙ্গত নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখবে, নাকি প্রশাসন-নিয়ন্ত্রিত কারচুপির রাজনীতি আমাদের আবারও অচলাবস্থার দিকে ঠেলে দেবে?
এখন প্রশ্ন হলো—এ কি কেবল জাহাঙ্গীরনগরের নির্বাচন, নাকি জাতীয় নির্বাচনের মহড়া? বহুদিন ধরেই শোনা যাচ্ছিল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ন্ত্রণের কৌশল নিয়েছে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক শক্তি। এবার সেটি বাস্তবতায় দাঁড়িয়েছে। প্রশাসনের সক্রিয় সহযোগিতা ছাড়া এমন নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয় যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জায়গায় কারচুপিকে স্বাভাবিক করা যায়, তবে জাতীয় নির্বাচনে একই প্রক্রিয়া চালানো সহজ হয়ে যাবে।
জনগণের মনে তাই শঙ্কা—আজকের জাকসু, কালকের জাতীয় নির্বাচন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ছাত্র আন্দোলন সবসময় অগ্রদূতের ভূমিকা পালন করেছে। মুক্তিযুদ্ধ থেকে নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থান পর্যন্ত প্রতিটি অধ্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ ছিল সূতিকাগার। এমনকি সাম্প্রতিক ২০২৪ সালের ছাত্র গণআন্দোলনও সেই ঐতিহ্যেরই পুনরাবৃত্তি। অথচ সেই একই প্রাঙ্গণ আজ যদি কারচুপির পরীক্ষাগার হয়ে ওঠে, তবে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ স্বাভাবিক।
অতএব, ডাকসু হোক বা জাকসু— এসব নির্বাচন কেবল ছাত্র সংসদের নেতৃত্ব বাছাই নয়। এগুলো জাতীয় রাজনীতির প্রতিচ্ছবি, পূর্বাভাস। প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি যখন বিশ্ববিদ্যালয়কে ব্যবহার করছে মহড়া হিসেবে, তখন জনগণের সামনে প্রশ্ন স্পষ্ট—বাংলাদেশ কি ন্যায়সঙ্গত নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখবে, নাকি প্রশাসন-নিয়ন্ত্রিত কারচুপির রাজনীতি আমাদের আবারও অচলাবস্থার দিকে ঠেলে দেবে?
এখন সিদ্ধান্ত জনগণের। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ভবিষ্যৎ দেখতে হবে—যেখানে জাকসুর নির্বাচন হয়তো জাতীয় রাজনীতিরই একটি ক্ষুদ্র অনুরণন মাত্র।
লেখক : ব্রিটেনপ্রবাসী কলামিস্ট।
এইচআর/এমএফএ/জেআইএম