সপ্তাহকাল ধরে জাতীয় রাজনীতির জায়গায় ডাকসু স্থান করে নিয়েছে গুরুত্ব বিবেচনায়।সবশেষে ৯ সেপ্টেম্বর নির্বাচন হওয়ার পর স্বাভাবিকভাবেই ডাকসু আলোচনা ঝিমিয়ে পড়ার কথা ছিলো।কিন্তু ডাকসু নির্বাচনের চমকে দেওয়া ফল আলোচনাটা দীর্ঘায়িত করে দিয়েছে।হয়তো আরও কিছুদিন মুখে মুখে থাকবে ডাকসু নির্বাচন। রাজনৈতিক নীতি-কৌশল নির্ধারণেও ডাকসু নির্বাচন নিয়ামক হিসেবে কাজ করবে।
নির্বাচনের দিন যেসব আলোচনা-সমালোচনা ও প্রার্থীদের অভিযোগ পাল্টা অভিযোগ মিনিটে মিনিটে পরিবর্তন হয়েছে,ঠিক তেমনটা না হলেও এর প্রভাব বিষয়ে আলোচনার একটা ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে।যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের বাইরে থাকেন, তাদের প্রায় সবাইকেই চমকে দিয়েছে এর ফল।সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যেভাবে ইসলামী ছাত্র শিবিরকে লক্ষ্য করে সমালোচনার ঝড় বইছিলো,তাতে অনেকেরই মনে হয়েছিল হয়তো তারা দুই চারটা আসন পেতে পারে কিংবা হল সংসদগুলোতে কিছু আসনও পেতে পারে।কিন্তু নির্বাচনের ফল দেখে তাদের হতবাক হওয়ার কথা।
আলোচনায় আসছে ইসলামী ছাত্র শিবিরের এই বিজয়ের পেছনে কারণ কি?বাংলাদেশের রাজনীতির ভবিষ্যৎ ভাবনায় মনে করি এই কারণগুলো বিশ্লেষণ হওয়া জরুরী। স্বাধীনতার পর ৫৪ বছরের ইতিহাসে ইসলামী ছাত্র শিবির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিকাংশ সময়ই গুপ্ত সংগঠন হিসেবে রাজনীতি করেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে জামায়াত-শিবিরের ভূমিকা নিয়ে সাধারণ ছাত্র সমাজে তাদের প্রতি অনাস্থা ছিলো।বিশেষ করে একাত্তরে মানবতা বিরোধীদের বিচারের পর তাদের কোনঠাসা হয়ে থাকতে হয়।
এমন পরিস্থিতিতে কোন কারণে জামায়াতের ছায়া সংগঠন হিসেবে ছাত্র শিবির এতটা সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হলো। বিএনপি তাদের দলীয় চিন্তা থেকে একটা নেরেটিভ তৈরি করেছে।তাদের সোজাসাপ্টা বক্তব্য হচ্ছে-ডাকসু নির্বাচনে ইঞ্জিনিয়ারিং হয়েছে। ভোটের দিন ছাত্রদল প্রকাশ্যে এবং ক্ষোভের সঙ্গে অভিযোগ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন পক্ষপাতিত্ব করেছে।তাদের অভিযোগ প্রকাশকালে তাদের বডি ল্যাংগুয়েজ নিয়েও দুদিন ধরেই সমালোচনা হচ্ছে।তারপরও নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ ভিপি প্রার্থী উমামাকেও করতে দেখা যায়।দুটি পক্ষই নির্বাচন বর্জনের কথাও ঘোষণা করে।যদিও তাদের এই ঘোষণা এসেছে নির্বাচনের ফল প্রকাশের সময়।
তাদের অভিযোগ আমলে নিলে বলতে হবে,নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে কিংবা পক্ষপাতিত্ব হয়েছে।প্রশ্ন কিন্তু থেকে যায়,একটা নির্বাচনে কারচুপি কিংবা পক্ষপাতিত্ব হলে বিজয়ী আর বিজিত প্রার্থীর মধ্যে হয়তো দুয়েক ফুট ব্যবধান থাকতে পারে। কিন্তু ব্যবধানটা এত বেশি যে,শুধু কারচুপি মাধ্যমে এটা অর্জন করা সম্ভব নয়।তার মানে কিন্তু এই নয় যে নির্বাচনে কোনো কারচুপি হয়নি।তবে যারা নির্বাচন দেখেছেন কিংবা অংশ নিয়েছেন,তারা দেখেছেন পুরোদিন ছিলো একটা ঈদের উৎসবের মতো। শত শত শিক্ষার্থী প্রচণ্ড গরম উপেক্ষা করে লাইন ধরে ভোট দিচ্ছে। একটি নির্বাচনে ৮০% এর বেশি ভোট প্রদান চারটি খানেক কথা নয়। সুতরাং নির্বাচনের সততা নিয়ে সামান্য কিছু বিতর্ক থাকলেও সবাই মেনে নিয়েছে সুন্দর পরিবেশে একটি ভোট উপহার দিতে পেরেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ৪০ হাজার শিক্ষার্থী।
যারা ইঞ্জিনিয়ারিং এর কথা বলেন,তাদের মন্তব্যকে মুখ বুঝে মেনে নেয়া তাই কঠিন।তবে বিশ্লেষণ হতে পারে একটা চিহ্নিত স্বাধীনতা বিরোধী দলের ছাত্র সংগঠন কিভাবে ছাত্রদের মন জয় করতে সক্ষম হলো।জুলাই অভ্যুত্থানের সময়ের কথা বলা যায়।ইসলামী শিবির বরাবরই দাবি করে জুলাই অভ্যুত্থানের সামনের কাতারের লোক ছিলো তারা।পরিকল্পনা থেকে শুরু করে বাস্তবায়নেও তারা ছিলো অগ্রগামী।তারপরও তখন কিন্তু সাধারণ মানুষ কিংবা সাধারণ ছাত্ররাও তাদের নেতৃত্বের স্থান দিতে দ্বিধাগ্রস্থ ছিলো। তবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কিন্তু আন্দোলন চলাকালেই বলেছিলেন এই আন্দোলন পরিচালনা করছে জামায়াত ও শিবির।
জুলাই অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব নিয়ে দ্বিধা থাকার পরও অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী ও সমর্থক শিক্ষার্থীরা ইসলামী ছাত্র শিবিরকে বেছে নিয়েছে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের ভুল পথে চলার কারণে।একইভাবে বলা যায়, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃস্থানীয়দের সংগঠনগুলোর বেলাতেও।৫ আগস্টের পর ছাত্রদল এবং বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছাত্ররা গোটা দেশের মানুষের শুভেচ্ছা পাওয়ার পরিবর্তে অনেকেই তাদের প্রতি বিরক্তই হয়েছে।ছাত্রদলের সংগঠন বৃহৎ।তারা গ্রামে গঞ্জে বিস্তৃত। সেই স্থানীয় কিংবা কেন্দ্রীয় নেতাদের চাঁদাবাজি,দখলবাজির খবর এতই বেশি প্রচার পেয়েছে যে সাধারণ শিক্ষার্থী যারা জুলাই অভ্যুত্থানের চেতনাকে ধারণ করেন তাদের কাছে ছাত্রদলের গ্রহণযোগ্যতা অস্বাভাবিক হ্রাস পেয়ে যায়।এরমধ্যে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রধান অংশ এনসিপির অনুসারী ছাত্র সংগঠন বাগছাস বিষয়েও সাধারণ শিক্ষার্থীদের মনোভাবে সম্পূর্ণ উল্টে গেছে।এরসঙ্গে যুক্ত হয়েছে তাদের অনৈক্য ও বিভাজন। ব্যাপকভাবে দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ।অন্যদিকে ইসলামী শিবিরের অবস্থাটা বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে,তারা নীরবে কৌশলে পথ চলেছে।তাদের সংগঠন ছাত্রদলের সমান নয়।এবং তাদের নেতিবাচক কাজগুলো প্রকারান্তরে ওইভাবে প্রকাশ পায়নি।সেটা তাদের কৌশলগত কারণে।
ছাত্রদলের অবস্থাটা হচ্ছে একবারে খেয়াঘাট থেকে বাজার হাট সবই দখলে নিয়ে বিরাগভাজন হয়েছে মানুষের চোখে।কিন্তু জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্র শিবির নেতিবাচক যা করেছে সেটা ওইভাবে দৃষ্টিগোচর হওয়ার মতো নয়।১০ সেপ্টেম্বর একটি টেলিভিশন চ্যানেলে টকশোতে একজন বললেন,জামায়াতে ইসলামী দখল করেছে ব্যাংক,প্রশাসন ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আর বিএনপি ছাত্রদল করেছে গ্রামে গঞ্জের হাট ঘাট টেম্পু স্ট্যান্ড থেকে বাস স্ট্যান্ড। যা সহজেই চোখে পড়ে। যে কারণে প্রচণ্ড বিরাগভাজন হয়ে পড়েছে সাধারণ মানুষের কাছে। এর প্রভাব পড়েছি ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রদল ও বাগছাস এর নির্বাচনী ফল এ।
আলোচনায় আসছে ডাকসুর এই নির্বাচনী ফল জাতীয় রাজনীতি বিশেষ করে ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচনে কোনো প্রভাব ফেলবে কি না। কিংবা অন্য বিশ্ববিদ্যালয়েও কতটা প্রভাব ফেলতে পারে।ডাকসু নির্বাচন কিংবা নেতৃত্ব জাতীয় রাজনীতিকে কতটা প্রভাবিত করে এর ব্যখ্যা কিন্তু বিভিন্নভাবে হতে পারে।অন্তত স্বাধীনতা লাভের পর এর আগে ৮টি ডাকসু হয়েছে।দীর্ঘদিন ডাকসু অস্তিত্বহীন ছিলো। দেখা যেতে পারে ওই সময় কী ঘটেছে। শুরুর দিকে যদি তাকাই দেখতে পাবো মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের নেতৃত্বাধীন ডাকসুর কথা।প্রচণ্ড প্রতাপ ছিলো ওই ডাকসুর।বাস্তবতা দেখা গেলো মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমদের মূল দল ক্ষমতার কাছাকাছিও যেতে পারেননি।একইভাবে মাহমুদুর রহমান মান্না,আখতারুজ্জামানের ডাকসুর কথাও ধরা যায়।মাহমুদুর রহমান মান্না সেই সময় জাসদ ছাত্রলীগ থেকে ভিপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। তার মূল দল জাসদ কিন্তু ক্ষমতার কাছাকাছিও যেতে পারেনি।
আবার অন্যচিত্র দেখা যেতে পারে,আমান উল্লাহ আমান ও খায়রুল কবির খোকনের নেতৃত্বাধীন ডাকসুর দাপটে শুধু এরশাদকেই বিদায় নিতে হয়নি।তাদের মূল দল বিএনপিকেও ক্ষমতায় দেখা গেছে। ফলে ডাকসুর প্রভাবকে এক তরফা বিচার করার সুযোগ নেই।
অন্যদিকে এবার ইসলামী ছাত্রশিবিরের বিজয়ের বিশ্লেষণ করলে আরেকটি দিকে যেতে হবে।অধিকাংশ ডাকসু নেতৃত্ব ছিলো ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের বিরোধী শিবিরের। এবার ডাকসু নেতাদের প্রতিপক্ষ কিন্তু বর্তমান সরকার নয়। বরং তাদের মূল দল জামায়াতে ইসলামীকে সরকারের অন্যতম সহযোগী হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। সুতরাং বর্তমান ডাকসুকে সরকার বিরোধী আন্দোলন করে জনগণের দৃষ্টিতে দ্রুত যাওয়ার সুযোগ কম।অর্থাৎ তারা সরকারকে প্রভাবিত করার ক্ষেত্রে সুযোগ পাবে কম। জনপ্রিয়তা পাওয়ার সহজ পথকে তারা ব্যবহার করতে পারছে না।
দেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মাঝে অনুষ্ঠিত মোটামুটি গ্রহণযোগ্য ডাকসু নির্বাচন হয়েছে,এটা স্বীকার করলেও বলতে হবে,জাতীয় রাজনীতিতে এর প্রভাব খুব একটা পড়বে বলে মনে হয় না।কারণ ছাত্রদল কিংবা বিএনপি ডাকসু নির্বাচন থেকে অবশ্যই শিক্ষা নেবে।ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রদলের মধ্যে যে ওভার কনফিডেন্স দেখা গেছে, সেটা তাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে এটুকু নিশ্চয়ই বুঝতে পারবে। এই অহমবোধ যে মূল দলটিকে ক্ষতিগ্রস্থ করবে,বিএনপি অন্তত ডাকসু নির্বাচনের ফল থেকে শিক্ষা নেবে।বিএনপি এখন তাদের জনপ্রিয়তাকে পুনরু্দ্ধারে চেষ্টা করবে এমন সম্ভাবনাই বেশি।যদি এমনটা তারা করে তাহলে আগামী নির্বাচনের বিজয়টা হবে তাদের আকাঙ্ক্ষার সমান, না হলেও কাছাকাছি। যদি ব্যত্যয় ঘটে তাহলে ডাকসুর মতো না হলেও অনাকাঙ্ক্ষিত ফল হয়ে যেতে পারে।
লেখক-সাংবাদিক,শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক।
এইচআর/এএসএম