ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদকে (ডাকসু) যারা অরাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান বলছে তারা হয় বিভ্রান্ত হয়ে, না হয় একটা গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে এটা বলছে। ডাকসুকে একটা রাজনীতি বর্জিত, অরাজনৈতিক বা ডিপ পলিটিক্যালাইজ সত্তা হিসেবে কেউ তুলে ধরার চেষ্টা করছে।
কথাগুলো বলেছেন স্বাধীনতার পর ডাকসুর প্রথম সহ-সভাপতি (ভিপি) মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম।
আগামী ৯ সেপ্টেম্বর ডাকসু নির্বাচন। সেই নির্বাচন নিয়ে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেছেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জেসমিন পাপড়ি।
জাগো নিউজ: আপনার সঙ্গে ডাকসুর সম্পর্ক কীভাবে গড়ে উঠেছিল?
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: ডাকসুর সঙ্গে আমার সম্পর্ক ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার অনেক আগে থেকে। কারণ ডাকসু এমন একটা প্রতিষ্ঠান, যেটা ছিল সব ছাত্র সমাজের একটা মিলনকেন্দ্র, একটা সংগ্রামের কেন্দ্র। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার আগে থেকেই ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলাম, তখন থেকেই আমি ডাকসুর সঙ্গে জড়িয়ে পড়ি।
জাগো নিউজ: আপনি প্রথম যখন ডাকসু নির্বাচনে অংশ নেন? তখন নির্বাচন প্রক্রিয়া কেমন ছিল এবং আপনার রাজনৈতিক অবস্থান কী ছিল?
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: মুক্তিযুদ্ধের আগে আগে, প্রথম সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে ডাকসু ভিপি, জিএস ও অন্যরা নির্বাচিত হন। ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের পরে এটা শুরু হয়। এর আগে ছিল পরোক্ষ নির্বাচন। একেকবার একেকভাবে হতো; জাতীয় প্রতিনিধি হিসেবে যারা নির্বাচিত হতেন, তারা মিলে বসে তাদের কর্মকর্তা নির্বাচন করতেন। প্রত্যক্ষ নির্বাচন, যেটা হয় ১৯৭০ সালে, সেখানে আমি জেনারেল ক্যান্ডিডেট ছিলাম। কিন্তু সম্ভবত ৬০ ভোটে বা এর আশপাশে ভোটে আমি হেরে গিয়েছিলাম।
- আরও পড়ুন
- ভিপি পদে লড়া ৪৩ প্রার্থীর অধিকাংশই ‘আড়ালে’, আলোচনায় ৯ মুখ
- ভিপিই ডাকসুর ‘প্রধান নির্বাহী’, সম্পত্তির দায়িত্বে জিএস
- ডাকসুর কাজ কী, জানেন না অনেক শিক্ষার্থী
- ভোটে সরগরম ঢাবি-রাবি-জাবি, ‘ছাত্রসংসদ’ আইনই নেই ৪৬ বিশ্ববিদ্যালয়ে
কিন্তু তারপরে, মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে ছাত্র সমাজের ভেতরেও বামপন্থি চিন্তা, র্যাডিক্যাল চিন্তাগুলো ছড়িয়ে পড়ে। এবং আমি নিজেও বামপন্থি ধারায় একেবারে যুক্ত হয়ে যাই। কোনো সময় আমি ছাত্রলীগ বা আওয়ামী লীগের সঙ্গে ছিলাম না; আমি ছাত্র ইউনিয়ন, ন্যাপ এবং কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে জড়িয়ে কাজ করেছি। মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে, যখন দেশ স্বাধীন হয় এবং প্রথম নির্বাচন আসে, সেই নির্বাচনে ছাত্ররা আমাকে ওভারওয়েল্মিং মেজরিটিতে ভোট দিয়েছিল। ছাত্রলীগ তখন দুই ভাগে বিভক্ত ছিল—জাসদ ছাত্রলীগ ও মুজিববাদী ছাত্রলীগ। এই দুই অংশের মিলিত ভোটের চেয়ে বেশি পেয়ে আমি নির্বাচিত হই।
জাগো নিউজ: মুক্তিযুদ্ধের পর ডাকসুর নেতৃত্বে আপনার প্রধান লক্ষ্য কী ছিল এবং কী ধরনের কর্মসূচি আপনি নিয়েছিলেন?
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: মুক্তিযুদ্ধের পর, আমরা দেশকে সমাজতন্ত্রের ধারায় গড়ে তোলার সংগ্রামকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য আওয়াজ তুললাম। অজস্র ঘটনা রয়েছে। আমাদের লড়াই কায়েমি স্বার্থবাদীদের বিরুদ্ধে। ভুয়া রেশন কার্ড উদ্ধার অভিযান চালানো, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ—এ লড়াইয়ের অংশ। ভিয়েতনাম সংহতি জানাতে গিয়ে আমাদের দুজন ছাত্র বন্ধু, মতিউল ইসলাম ও মির্জা কাদের, ১৯৭৬ সালের ১ জানুয়ারি পুলিশের গুলিতে নিহত হন। এটাই স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম হত্যাকাণ্ড এবং এর বিরুদ্ধে আমরা বিশাল আন্দোলন করেছি। বেআইনি অস্ত্র উদ্ধার অভিযান, নানান ষড়যন্ত্রের বিপরীতে সংগ্রাম, ঘুস-দুর্নীতি-সরকারের অপকর্মের বিরুদ্ধে সংগ্রাম—এসব মুক্তিযুদ্ধপরবর্তী পরিস্থিতির অংশ।
ডাকসুর নেতৃত্বে আমাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল— আমি এক বক্তৃতায় বলেছিলাম, পাকিস্তানিরা আমাদের কাছ থেকে অনেক সময় চুরি করে নিয়েছিল; সেই হারানো সময়কে পুনরুদ্ধার করতে হবে। পুনরুদ্ধার করে দেশকে যত দ্রুত সম্ভব লক্ষ্যভিত্তিক গড়ে তোলার উপাদান হিসেবে তৈরি হতে হবে। সুতরাং, ছাত্র ভাই-বোনরা, ওভারটাইম লেখাপড়া করেন, ওভারটাইম লাইব্রেরিতে কাজ করেন, দুই বছরের কোর্স যেন দুই বছরেই শেষ করেন, যাতে দেশ গড়ার সৈনিক হিসেবে ঘুরে দাঁড়াতে পারো।
ছাত্রদের একটি অংশ অটো প্রমোশনের দাবি করেছিল— ‘আমরা যুদ্ধ করেছি, পড়াশোনা করতে পারিনি, বিনা পরীক্ষায় পাস করানো হোক।’ এই দাবির বিরুদ্ধে আমি দৃঢ় অবস্থান নিয়েছিলাম; ডাকসু অফিস ছেড়ে দেওয়ার মতো দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিই। পরীক্ষায় নকলের বিরুদ্ধেও অভিযান চালাই, কিন্তু কোনো ফল পাইনি। তা সত্ত্বেও আমি চাইছিলাম শিক্ষার্থীরা যাতে পড়াশোনায় আরও মনোযোগ দেয়—সেই দিকে নজর দেয়।
- আরও পড়ুন
- ৯ সেপ্টেম্বরই হচ্ছে ডাকসু নির্বাচন
- ডাকসু নির্বাচনে অন্য কোনো প্যানেলের সঙ্গে জোটে যাচ্ছে না ছাত্রদল
- নিরাপদ ক্যাম্পাস গড়ার আগ পর্যন্ত আমরা থামবো না: সাদিক কায়েম
- ভোট চাইতে এলে বিরিয়ানি-ফলমূল-নাশতা আনতে দরজায় নোটিশ!
একটি নিয়ম চালু করেছিলাম— একাডেমিক বছর শুরু হলেই প্রথম দিন সব ছাত্র-শিক্ষক তাদের পরিচ্ছন্ন ডিপার্টমেন্টে একত্রিত হবে। শিক্ষকদের উত্তরক্ষেত্রে শুভেচ্ছা জানানো হবে—কেউ ফুল দেবে, কেউ সালাম করবে, কেউ পায়ে ধরে সালাম নিতে পারে—কোনো অসুবিধা নেই। এরপর ছাত্র ও শিক্ষক মিলে মিছিল করে শহীদ মিনারে পুষ্পাঞ্জলি অর্পণ করবে। কারণ এই শিক্ষাজীবন শুরু হয়েছে শহীদদের আত্মত্যাগে। এর মাধ্যমে ছাত্রদের ভেতরে এক মৌলিক দায়িত্ব—নিজেকে দেশগড়ার কারিগর হিসেবে তৈরির ইচ্ছে জাগ্রত করার চেষ্টা করেছি।
জাগো নিউজ: অনেকদিন পর ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ডাকসুর ঐতিহাসিক গৌরব ও প্রাসঙ্গিকতা এখনো কতটা রয়েছে বলে মনে করেন?
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: ডাকসুর সেই বাস্তবতা, গৌরব এখনো আছে। বরং নতুন বাস্তবতায়, নতুন প্রযুক্তি ও আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স যুগে তা শক্তিতে সম্প্রসারিত হয়েছে। বৈশ্বিক শক্তির ভারসাম্য যেমন পরিবর্তিত হয়ে—বাইপোলার থেকে ইউনিপোলার, এখন আবার মাল্টিপোলার হয়েছে, তেমনি আমাদের দেশেও রাজনৈতিক বাস্তবতা বদলেছে। বর্তমানে ভারতের রাজনৈতিক বাস্তবতায় বিজেপি সরকার হিন্দুত্ববাদের একটি শক্তিশালী স্লোগান নিয়ে এগোচ্ছে, যাকে আমি হিন্দু জামায়াতে ইসলামী বলি। এই বিষয়গুলো মিলিয়ে এখন আমাদের সামগ্রিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতায় নতুন কিছু উপাদান যুক্ত হয়েছে। একদিকে কিছু অগ্রগতি হচ্ছে, অন্যদিকে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যও বাড়ছে। ফলে একটি জটিল নতুন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। এমন সময়ে ডাকসুর ভূমিকা রাখার সুযোগ আছে।
যেমন একটি গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী ফ্যাসিস্ট শাসনের পতন হলো। তারপর একটি সংস্কারের কথা উঠেছে। কিন্তু সবচেয়ে বড় প্রশ্ন- পরিবর্তন হবে সামনের দিকে নাকি পেছনের দিকে?
যদি দেশের ব্যবস্থা যে কোনোভাবে পেছনের দিকে নেওয়ার চেষ্টা হয়, তা জাতিকেই ধ্বংসের পথে নিয়ে যাবে। ১৯৭১–এ মুক্তিযুদ্ধে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছিলাম, আমাদের স্বপ্নকে ভিত্তি করেই দেশ গড়েছিলাম। সেই স্বপ্ন নিঃসন্দেহে সম্প্রসারণ ও নতুন গভীরে নিয়ে যাওয়া এবং সেই বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে।
জাগো নিউজ: ডাকসু নির্বাচনে ৪৫ জন ভিপি প্রার্থী রয়েছেন, যাদের মধ্যে অনেকেই স্বতন্ত্র এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক প্যানেলের অংশ। অনেকের দাবি, ডাকসু নির্বাচন অরাজনৈতিক হওয়া উচিত। আপনি কী মনে করেন?
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: ডাকসুকে যারা অরাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান বলছে তারা হয় বিভ্রান্ত হয়ে, না হয় একটা গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে এটা বলছে। ডাকসুকে একটা রাজনীতি বর্জিত, অরাজনৈতিক বা ডিপ পলিটিক্যালাইজ সত্তা হিসেবে কেউ তুলে ধরার চেষ্টা করছে। এই চেষ্টা হলো বিশ্বব্যাপী ‘রাষ্ট্রের কোনো কাজ নাই, রাষ্ট্রকে এনজিওদের কাছে হস্তান্তর করে দেওয়া’ ধারণার অংশ। অর্থাৎ সুশীল সমাজ দেশ শাসন করবে। দেশ শাসন করা হলো সর্বোচ্চ রাজনৈতিক কর্তব্য। যদি বলা হয় যে অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের হাতে বা গোষ্ঠীর হাতে দেশ শাসনের দায়িত্ব দিতে হবে। এটা তো কন্ট্রাডিকশন হয়ে গেলো।
কেউ খাবে, কেউ খাবে না এ অবস্থা থেকে দেশকে মুক্ত করার জন্য যাতে সংগ্রাম সামনের দিকে অগ্রসর না হয়, ডাকসুকে ডিপলিটিক্যালাইজেশন সেই চেষ্টার অংশ। তবে অতি রাজনীতিকরণও খুব মারাত্মক।
- আরও পড়ুন
- হত্যাচেষ্টা মামলায় ডাকসুর ভিপি প্রার্থী জালাল কারাগারে
- ডাকসু ও হল সংসদে ভোটার সংখ্যা ৩৯৯৩২, ছাত্রী ৪৭ শতাংশ
- ছাত্রনেতা থেকে জাতীয় রাজনীতিতে, ডাকসু ভিপিদের অতীত-বর্তমান
- ডাকসু নির্বাচনে প্রচারে মানতে হবে যেসব নিয়ম
রাজনীতিকরণ আর অতিরিক্ত দলীয়করণ—এই দুইয়ের মধ্যে একটা গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য রয়েছে। দলীয় স্বার্থে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কিংবা সমাজের রাজনৈতিক চেতনা ও অধিকার প্রয়োগকে এক করে ফেলা কখনোই উচিত নয়। রাজনৈতিক চেতনা গঠন ও সচেতনতা বাড়ানো এক জিনিস, আর দলীয় বৃত্তের মধ্যে পড়ে পড়াশোনা বা নেতৃত্বের জায়গাগুলো দখলে রাখার চেষ্টা আরেক জিনিস।
যদি কেউ মনে করে যে, ‘ডাকসুতে আমি না জিতলে সংসদ সদস্য হতে পারবো না’ কিংবা ‘ছাত্র সংসদে আমার এলাকা না থাকলে আমি ক্ষমতায় যেতে পারবো না’— তাহলে সেটা একটি ভুল এবং ক্ষতিকর দৃষ্টিভঙ্গি। এটা ক্ষমতার প্রশ্নে দলীয় রাজনীতির বিকৃত প্রতিফলন।
ছাত্ররাও একেকজন নাগরিক এবং সংবিধান অনুযায়ী প্রত্যেক নাগরিকেরই রাজনৈতিকভাবে সচেতন হওয়ার অধিকার আছে। পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে কেবল ‘বইয়ের পোকা’ বানানোর জায়গা না ভেবে দেশপ্রেম, রাজনৈতিক সচেতনতা, নেতৃত্বের প্রস্তুতি এবং সমাজ বদলের স্বপ্ন দেখার জায়গা হিসেবেও গড়ে তুলতে হবে। উচ্চশিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত শুধু পেশাজীবী তৈরি করা নয়, বরং দায়িত্ববান, সচেতন নাগরিক তৈরি করা।
ডাকসুর নির্বাচন নিয়মিত হওয়া উচিত। ডাকসু কনস্টিটিউশনের প্রয়োজনীয় সংশোধন করে কাঠামো আরও দৃঢ় করা দরকার। ছাত্র সমাজ শুধু নেতা তৈরি করে না; আগামী পথপ্রদর্শক তৈরির একটি মঞ্চ। শিক্ষাজীবনের অংশ হিসেবেই ছাত্র সংসদ অধিকারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
জাগো নিউজ: বলা হয় ডাকসু আগামী রাজনৈতিক নেতা তৈরির একটা প্রথম ধাপ। এ বিষয়ে আপনার ভাবনা কী?
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: ডাকসুকে নেতা তৈরির একমাত্র ক্ষেত্র ভাবলে সমস্যা হয়। এতে মনে হয় যেন শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাই নেতৃত্ব দিতে পারবে, অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কিংবা শ্রমিক-কৃষকদের মতো যারা লেখাপড়ার সুযোগ পায়নি, তাদের কোনো ভূমিকা থাকবে না। এটি মৌলিক অধিকার লঙ্ঘনের মতো।
ছাত্র পরিচয় গুরুত্বপূর্ণ হলেও সব ছাত্র একশ্রেণি বা চেতনার প্রতিনিধি নয়। কেউ পেশাগত উন্নতির স্বপ্ন দেখে, আবার কেউ ক্ষমতা ও সুবিধাভোগের লোভে রাজনীতিতে জড়ায়। আজকের বাস্তবতায় দেখা যায়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ওভার-পলিটিক্যালাইজেশনের ফলে নির্বাচিত ছাত্রদের বদলে গ্যাং বা মাস্তানরা মুখপাত্র হয়ে বসে থাকে। এতে সাধারণ ছাত্রদের রাজনৈতিক অংশগ্রহণ বাধাগ্রস্ত হয়।
সুতরাং, নেতৃত্ব গঠনের পথটা শুধুই ডাকসু বা একটি নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা হওয়া উচিত সব শ্রেণির মানুষের অংশগ্রহণে, বৈচিত্র্য ও সাম্যের ভিত্তিতে।
জাগো নিউজ: এবার আমরা দেখছি ছাত্রলীগের মতো একটি বড় রাজনৈতিক সংগঠন নির্বাচন থেকে অনুপস্থিত, আর শিবির বেশ জমজমাট প্রচারণায় নেমেছে। আপনি বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: ছাত্রলীগই তো জামায়াতে ইসলাম-শিবির। শিবিরই তো ছাত্রলীগ। এটা তো তাদের নিজস্ব কনফেশনের ভেতর দিয়ে জানা গেছে।
বাস্তবে ছাত্রলীগ, ছাত্রদল, শিবির—এসব দলই মূলত একই ধরনের রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ, যারা দীর্ঘদিন ক্যাম্পাসে দখলদারত্ব করেছে। তাই কে এখন নির্বাচনে আছে, কে নেই—এ প্রশ্নের চেয়েও বড় প্রশ্ন হলো: এই পুরোনো ছাত্র সংগঠনগুলো আদৌ ছাত্রদের প্রতিনিধিত্ব করে কি না? তারা কি ছাত্রদের নিরাপত্তা, গণতন্ত্র, অধিকার—এ বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করছে, নাকি দলীয় স্বার্থে ক্যাম্পাসকে ব্যবহার করছে?
দুঃখজনকভাবে, প্রচারমাধ্যমও শুধু এই বড় দলগুলোর কথাই তুলে ধরে। ফলে যারা সত্যিকারের পরিবর্তনের জন্য সংগ্রাম করছে—তারা আড়ালে পড়ে যাচ্ছে। অথচ এদের অনেকেই জেল খাটছে, হামলার শিকার হচ্ছে।
- আরও পড়ুন
- ডাকসু নির্বাচন: স্বচ্ছতা-সংস্কার প্রশ্নে শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা
- ডাকসু নির্বাচনে ১১ প্যানেলে লড়ছেন যারা
- ডাকসুতে ভোট দিতে একজন ভোটার সময় পাবেন ৮ মিনিট
- বুথ সংখ্যা বাড়লেও বাড়ছে না কেন্দ্র সংখ্যা
আজকের ছাত্র রাজনীতিতে দেখা যায়, পুরোনো রাজনৈতিক দলগুলো কেবল তাদের গোষ্ঠীগত স্বার্থ রক্ষা করতে চায়। এরা বারবার নিজেদের নতুন সংস্করণে হাজির করলেও ভেতরে সেই ঘুণে ধরা পুরোনো কাঠামোই থেকে যায়। আমরা যদি সত্যিকারের পরিবর্তন চাই, তাহলে এমন প্রগতিশীল ও অগ্রসরমুখী বিকল্প রাজনীতি গড়ে তুলতে হবে, যা দেশের মানুষকে পেছন দিকে টেনে নিয়ে যাবে না।
জাগো নিউজ: আপনারা যখন ইলেকশন করতেন, তখন ছাত্ররা কী বিষয় বিবেচনায় নিয়ে আপনাদের ভোট দিত বলে মনে করেন?
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: ছাত্ররা প্রথমে দেখত প্রার্থী কেমন মানুষ; তারা আদর্শবান, ত্যাগী, সৎ, শিক্ষিত ও চিন্তাশীল কি না। আমরা যারা বামপন্থি ছাত্র রাজনীতিতে যুক্ত ছিলাম, আমাদের চিন্তাভাবনায় ছিল শোষণমুক্ত সমাজ গঠনের প্রত্যয়, সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে অবস্থান এবং নীতিগত স্পষ্টতা। এসবই ছাত্রদের কাছে গুরুত্ব পেত।
আমরা সবসময় বলতাম, ছাত্ররাজনীতি কেবল সংগঠন বা ব্যানারনির্ভর নয়, এটা আদর্শের প্রশ্ন। তুলনামূলকভাবে, ছাত্রলীগ জাতীয়তাবাদী ধারায় থাকলেও তারা অনেক সময় সরকারি অবস্থানের সঙ্গে আপস করত।
আমার মতে, এসব ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে হয়। যেমন ’৬৯-এর গণআন্দোলন শুধু ছয় দফার ভিত্তিতে নয়, ছাত্রদের দেওয়া ১১ দফার ভিত্তিতেই গড়ে উঠেছিল। সেই ১১ দফা ছিল আরও অগ্রসর ও শোষণবিরোধী।
জাগো নিউজ: এখনকার ডাকসু ভোটারদের উদ্দেশে কিছু বলতে চান?
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: আমি শুধু এটুকু বলবো—নির্ভয়ে, বিবেক ও মনের বিবেচনায় এবং যাদের আপনি নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে যোগ্য মনে করেন, তাদেরই ডাকসুর নেতৃত্বে নির্বাচিত করুন। এ বিষয়েও সচেতন হোন—বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসু কনস্টিটিউশন প্রয়োজনে পরিবর্তন করে, তার কর্তৃত্বকে আরও প্রসারিত ও গভীর করার সংগ্রাম চালিয়ে নিতে হবে।
ডাকসু নির্বাচন যেন প্রতি বছর নিয়মিতভাবে হয়—এমন সম্ভাবনা তৈরি করতে হবে এবং তা শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই নয়, সব উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিশ্চিত করতে হবে।
- আরও পড়ুন
- রাকসুতে ভিপি পদে প্রথমবার নারী প্রার্থী হিসেবে লড়ছেন তাসিন
- ধানমন্ডি ৩২ ‘মন্দ’ হলেও ব্যালট নম্বর ৩২ একেবারে উল্টো: রাফিয়া
- শিক্ষার্থীদের প্রধান চাহিদা নিরাপদ ক্যাম্পাস ও যোগ্য নেতৃত্ব
- ডাকসু নির্বাচন ঘিরে ক্যাম্পাসে উৎসবের আমেজ
আমার দৃঢ় বিশ্বাস, বাংলাদেশের ছাত্রসমাজ সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে সঠিক রায় দেবে—তবে শর্ত একটাই, যেন কোনো বাইরের হস্তক্ষেপ না থাকে। কারণ, বাইরে থেকে চাপ দিলে ন্যায্য রায়ের বিকৃতি ঘটে।
কিন্তু আমি শুনেছি, ইতোমধ্যে কয়েকটি গুরুতর সমস্যা তৈরি হয়েছে—পোলিং বুথের সংখ্যা খুবই সীমিত। যদি সেখানে দীর্ঘ লাইন হয় এবং সবাই ভোট দিতে না পারে, তাহলে ফলাফল প্রকৃত ছাত্রদের মতের প্রতিফলন নাও হতে পারে। আবার, সেমিস্টার পরীক্ষার সময়সূচি নির্বাচন দিনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সময়সূচি পরিবর্তন না করায় অনেক শিক্ষার্থী অংশ নিতে পারবে না। ফলে গণতান্ত্রিক প্রতিনিধিত্ব ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এই প্রক্রিয়ায় যদি কোনো অশুভ উদ্দেশ্য থেকে থাকে, তবে সেটা এখনই সংশোধন করা উচিত।
জেপিআই/এমএমএআর/এমএফএ/এএসএম