তবু হাল ছেড়ে দেওয়া যাবে না

4 hours ago 5

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব ছড়ায়, কিন্তু শুধু গুজব নয়—অপ্রিয় সত্যও ছড়িয়ে পড়ে। চিকিৎসার নামে বাণিজ্য আর স্বাস্থ্যসেবার নামে লুটপাট করে শত শত কোটি টাকার মালিক হওয়ার ঘটনা, কোটি কোটি টাকা দিয়ে বড় পদ কেনা ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় পৌঁছানোর লোভ, ডাক্তার ও স্বাস্থ্য বিভাগের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের ঘুষ–দুর্নীতির কেলেঙ্কারি, এমনকি ২০০ কোটি টাকার চেক নেওয়া—এসব কোনো গল্প নয়, নগ্ন বাস্তবতা।

এই চক্র এবং আরও অসংখ্য চক্র দেশের আনাচে–কানাচে সক্রিয়। এদের ছাড় দেওয়া মানে দেশকে ছারখার হতে দেওয়া, অথচ বাংলাদেশে এখন সেটাই স্বাভাবিক ব্যাপার। এই অসুস্থ স্বাভাবিক ব্যাপারগুলোকে অস্বাভাবিক উপায়ে হলেও সুস্থ স্বাভাবিকে ফিরিয়ে আনা ছাড়া কোনো পথ নেই। কিন্তু তা কী সম্ভব হবে যদি চাঁদাবাজি আর দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদদের হাতেই রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয়?

ভাবুন তো, যারা সারাজীবন নিজের দক্ষতায় কোনো প্রকৃত সমাজকল্যাণমূলক কাজ করেনি, যাদের সিভিতে রয়েছে শুধু রাজনৈতিক কোটা, পরিবারতন্ত্রের প্রভাব, দুর্নীতি ও অবৈধ সম্পদ, আর সর্বোপরি ক্ষমতার অপব্যবহার—তাদের হাতেই কি আমরা নতুন সমাজ ও রাষ্ট্রের আশা করব? এটি নিঃসন্দেহে এ যুগের সবচেয়ে ভয়াবহ অথচ হাস্যকর এক রসিকতা। কিন্তু দুঃখজনক সত্য হলো, আমি এতক্ষণ যা বললাম তা রসিকতা নয়—অপ্রিয় সত্য।

এখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে। কিন্তু জাতি কি কোনো পরিবর্তনের আলামত দেখছে? রাস্তাঘাটে এখনো অদৃশ্য যুদ্ধক্ষেত্রের মতো ভয়ের পরিবেশ, সন্ত্রাস ও দমননীতি অব্যাহত। দুর্নীতি, চাঁদাবাজি ও সহিংসতা একই হারে চলছে। তাহলে কে গ্যারান্টি দেবে যে আসন্ন নির্বাচন হবে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ? কে নিশ্চয়তা দেবে যে ভোটচুরি হবে না, রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতার অপব্যবহার করবে না, কিংবা প্রশাসন সত্যিই শক্তিশালী ও নিরপেক্ষ ভূমিকা নেবে? বাস্তবতা হলো—অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও জনগণকে কোনো সুনির্দিষ্ট গ্যারান্টি দিতে পারছে না। তাই জনগণের আস্থা ক্রমশ ক্ষয় হচ্ছে।

এখানে আরও বড় প্রশ্ন—যদি সত্যিই জনগণ ক্ষমতার উৎস ও মালিক হয়, তবে মনোনয়ন প্রক্রিয়ায় এত অনিয়ম কেন? কেন বাংলাদেশে একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী জিততে পারে না? বাস্তবে দেখা যায়, জনগণের ভোটে আসলে কী যায় আসে না। ফল নির্ধারণ হয় চারটি গেটে—মনোনয়ন, প্রচার ও অর্থায়ন, ভোটদিনের পরিবেশ, আর ফল গণনা–বিচার প্রক্রিয়া। মনোনয়নের দরজা অর্থের তালায় বন্দি, যেখানে ত্যাগ ও যোগ্যতা নয়, টাকা আর প্রভাবশালী চক্রই ঠিক করে কে প্রার্থী হবে। প্রচারের মাঠে দলীয় প্রার্থী রাষ্ট্রীয় যন্ত্র, প্রতীক, সংগঠন ও বিপুল অর্থের সুবিধা ভোগ করে, আর স্বতন্ত্র প্রার্থী পড়ে যায় অসম প্রতিযোগিতায়।

ভোটের দিনে কেন্দ্র দখল, এজেন্ট বের করে দেওয়া, প্রশাসনের পক্ষপাত আর সহিংসতা ভোটারদের ইচ্ছাকে স্তব্ধ করে দেয়। শেষে গণনা ও ফল প্রকাশে স্বচ্ছতার অভাব এবং আপত্তি জানানোর অকার্যকর ব্যবস্থা জনগণের ভোটকে আরও অসহায় করে তোলে। এ অবস্থায় বলা যায়, বর্তমান কাঠামোয় জনগণের ভোটকে প্রায় অকার্যকর করে রাখা হয়েছে, আর ফলাফল নির্ধারিত হয় গেটকিপারদের সমীকরণে। তাই ‌‘জনগণই ক্ষমতার উৎস’—এই বাক্যটি এক দুর্নীতিগ্রস্ত ও দরিদ্র রাষ্ট্রে কেবল স্লোগান হয়ে দাঁড়িয়েছে, বাস্তবতা নয়।

কিন্তু তবু হাল ছেড়ে দেওয়া যাবে না। পরিবর্তন ঘটাতে হলে নাগরিকদের ভেতর থেকেই নতুন শক্তি তৈরি করতে হবে। অপ্রিয় সত্যকে স্বীকার করা, দুর্নীতি ও অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সক্রিয় অংশগ্রহণ, বিকল্প নেতৃত্বকে সমর্থন, এবং প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে জবাবদিহি দাবি করা—এগুলো হবে প্রথম পদক্ষেপ। শুধু ভোট দেওয়া যথেষ্ট নয়; সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জাগরণ গড়ে তুলতে হবে, যেখানে মানুষ নৈতিক মূল্যবোধে উদ্বুদ্ধ হবে এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হবে।

নৈতিক নেতৃত্ব বিকাশ, স্বাস্থ্য–শিক্ষা–প্রশাসন ও বিচারব্যবস্থার সংস্কার, সংস্কৃতি ও শিক্ষার মাধ্যমে দুর্নীতিবিরোধী চেতনা বিস্তার, এবং অর্থনৈতিক ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সম্পদ কুক্ষিগতকরণ রোধ ও সমান সুযোগ নিশ্চিত করাই হতে পারে মুক্তির রূপরেখা।

রোডম্যাপ নয়, বাস্তব পরিবর্তনই জাতির প্রয়োজন। আর সেই পরিবর্তনের চাবিকাঠি লুকিয়ে আছে নাগরিকদের সক্রিয় ভূমিকা, নৈতিক নেতৃত্ব এবং জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলার মধ্যে। আমরা যদি অপ্রিয় সত্যকে গুজব নয় বরং পরিবর্তনের চালিকা শক্তি হিসেবে গ্রহণ করতে পারি, তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সুস্থ স্বাভাবিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হবে। অন্যথায়, এই অপ্রিয় সত্য আমাদের কাছে নিছক কথার ফুলঝুরি নয়, বরং জাতির পতনের দলিল হয়ে থাকবে।

যদি মনোনয়নপত্রই টাকার প্রমাণ হয়ে দাঁড়ায়, অর্থাৎ যোগ্যতা, দক্ষতা, নৈতিকতা বা জনকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডের কোনো মূল্য থাকে না, তাহলে নির্বাচিত প্রার্থী জনগণের ইচ্ছার প্রতিনিধি নয়, বরং পুঁজিবল ও প্রভাবশালী চক্রের প্রতিনিধি। ভোটার যতই অংশগ্রহণ করুক, তার ভোটের ক্ষমতা বাস্তবে কার্যকর হয় না। এভাবেই দেখা যায় যে ‘জনগণই ক্ষমতার মালিক’ কথাটি বাস্তবে শূন্য ও প্রতীকী।

সর্বোপরি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান দায়িত্ব ছিল একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা। কিন্তু বাস্তবতা দেখাচ্ছে, সন্ত্রাস, দুর্নীতি, মনোনয়ন–দুর্নীতি, স্বতন্ত্র প্রার্থীর জয় অসম্ভব এবং প্রশাসনের পক্ষপাতসহ নানা প্রতিবন্ধকতা সেই লক্ষ্যকে ব্যর্থ করেছে। এ অবস্থায় ভোটাররা শক্তিশালীভাবে অংশগ্রহণ করলেও, একমাত্র ভোটের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় পরিবর্তন সম্ভব নয়। তাই পরিবর্তনের দায়িত্ব এখন নাগরিকদের নিজের হাতে।

জনগণকে সচেতন, সক্রিয় ও ঐক্যবদ্ধ হতে হবে; নৈতিক নেতৃত্বকে সমর্থন করতে হবে; স্বাস্থ্য, শিক্ষা, প্রশাসন ও বিচার ব্যবস্থার স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে; সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও শিক্ষামূলক আন্দোলনের মাধ্যমে দুর্নীতিবিরোধী চেতনা বিস্তার করতে হবে; এবং অর্থনৈতিক ন্যায়নীতি নিশ্চিত করতে হবে।

এই ধাপে ধাপে করণীয় বাস্তবায়ন করলে, আমরা কেবল অপ্রিয় সত্যের শিকার নই, বরং সেটিকে পরিবর্তনের চালিকা শক্তি হিসেবে ব্যবহার করে একটি সুস্থ স্বাভাবিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারব। রোডম্যাপ নয়—বাস্তব পরিবর্তনই জাতির মুক্তির চাবিকাঠি, আর সেই চাবিকাঠি লুকিয়ে আছে সক্রিয় নাগরিক, নৈতিক নেতৃত্ব এবং জবাবদিহিমূলক প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে তোলার মধ্যে।

রহমান মৃধা
গবেষক ও লেখক
(সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন)
[email protected]

এমআরএম/এমএস

Read Entire Article