মানুষ সামাজিক ও পারিবারিক প্রাণী। সমাজের ক্ষুদ্রতম একক হলো পরিবার, আর পরিবারের ভিত্তি বাবা ও মা। তারা শুধু জীবনের সূচনাকালেই থাকেন না, তাঁরা আমাদের চরিত্র, নৈতিকতা, শিক্ষা ও মানবিকতার প্রথম শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। কিন্তু আজকের দ্রুত পরিবর্তনশীল ও প্রযুক্তিনির্ভর সমাজে এক ভয়াবহ প্রবণতা দেখা যাচ্ছে—অনেক তরুণ নিজের বাবা-মাকে যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করছে না। কেউ কেউ তাদের মতামতকে অবজ্ঞা করে, কেউ ব্যস্ততার অজুহাতে সময় দিতে চায় না, আবার কেউ কেউ বৃদ্ধাবস্থায় তাঁদের অবহেলা করে, এমনকি শারীরিকভাবে নির্যাতন করে। অথচ বাবা-মার সম্মান করা শুধু নৈতিক দায়িত্ব নয়, বরং এটি ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা এবং মানবতার অন্যতম প্রধান শর্ত।
ইসলাম ধর্মে বাবা-মার প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা এক অনন্য মর্যাদা পেয়েছে। কোরআনে আল্লাহ তায়ালা একাধিক স্থানে বাবা-মার প্রতি সদ্ব্যবহার করার আদেশ দিয়েছেন। সূরা আল-ইসরায় (১৭:২৩) আল্লাহ বলেন— “তোমার প্রভু আদেশ দিয়েছেন যে, তোমরা একমাত্র তাঁরই ইবাদত করবে এবং বাবা-মার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করবে। তাদের একজন অথবা উভয়ে যদি বার্ধক্যে উপনীত হয়, তবে তাদেরকে ‘উহ্’ পর্যন্ত বলো না, তাদের ধমক দিও না, বরং তাদের সঙ্গে সম্মানজনক কথা বলো।”
এই আয়াত শুধু শারীরিক সেবা নয়, মানসিক সম্মানের গুরুত্বও স্পষ্ট করে ব্যাখ্যা করে। আল্লাহ এমনকি ‘উহ্’ বলাও নিষিদ্ধ করেছেন—যা ইঙ্গিত দেয়, বাবা-মার প্রতি সামান্য বিরক্তি প্রকাশ করাও অন্যায়।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “জান্নাত মায়েদের পায়ের নিচে।” (সহিহ নাসাঈ, হাদিস: ৩১০৪) আরেক হাদিসে তিনি বলেন, “তোমার মা, তারপর তোমার মা, তারপর তোমার মা, তারপর তোমার বাবা।” (সহিহ বুখারি ও মুসলিম)
এই হাদিসগুলো স্পষ্টভাবে দেখায়, বাবা-মার প্রতি শ্রদ্ধা শুধু নৈতিক নয়—এটি ইমানের অংশ। যে ব্যক্তি বাবা-মাকে অসম্মান করে, তার জন্য আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন কঠিন হয়ে পড়ে।
হিন্দু ধর্মগ্রন্থ মনুস্মৃতি (২/২২৭)-তে বলা হয়েছে, “যে সন্তান তার পিতা-মাতাকে সম্মান করে না, সে ধর্ম, অর্থ ও কাম—কোনো লক্ষ্যই অর্জন করতে পারে না।” তাছাড়া মহাভারত-এও বলা হয়েছে, “মাতা পিতা গুরু দেব”—অর্থাৎ, মা, বাবা ও গুরু—এই তিনজনই পৃথিবীতে দেবতাস্বরূপ। তাদের অবমাননা করা মানে ধর্মের বিরোধিতা করা।
ভগবদ্গীতা (৬:৩২)-তেও পরোক্ষভাবে বলা হয়েছে, “যে অন্যের মধ্যে নিজের মতোই ভালোবাসা ও সম্মান দেখতে পায়, সে প্রকৃত যোগী।” এর অর্থ, যিনি নিজের জন্মদাতা ও লালনকারী বাবা-মার প্রতি ভালোবাসা দেখাতে জানেন না, তিনি কখনো প্রকৃত ধর্মনিষ্ঠ হতে পারেন না।
যিশু খ্রিস্ট বলেছেন, “যে তার পিতা বা মাতাকে সম্মান করে না, সে ঈশ্বরের ভালোবাসা বুঝতে পারে না।” (Mark 7:10)
অতএব, ইসলাম, হিন্দু ও খ্রিস্ট—সব ধর্মেই এক কথা বলা হয়েছে, বাবা-মাকে অসম্মান করা মানে নিজের মানবিকতার অবমাননা করা।
মনে রাখতে হবে বাবা-মা হলেন সেই মানুষ, যাদের নিঃস্বার্থ ভালোবাসা ও ত্যাগের ওপর ভিত্তি করে একটি মানুষ তার জীবনের প্রথম ধাপ পাড়ি দেয়। একজন বাবা সন্তানের জন্য নিজের কষ্ট ভুলে কাজ করে, আর একজন মা সন্তানের হাসির জন্য নিজের ঘুম ও শান্তি বিসর্জন দেন। তাই বাবা-মার প্রতি কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধা শুধু আবেগ নয়, এটি দায়িত্ব ও নৈতিকতার দাবি।
প্রিয় তরুণরা—তোমরা তোমাদের বাবা-মাকে অসম্মান করো না। মনে রেখো, আজ যাদের তুমি অবহেলা করছ, একদিন তোমরাও তেমনই বয়সে পৌঁছাবে, আর তখন তোমাদের সন্তানেরা তোমাদের সাথে কঠিন অসৌজন্যমূলক আচরণ করবে। ভুলে যেও না বাবা-মার প্রতি সম্মান কোনো দুর্বলতা নয়, এটি শক্তির প্রতীক। এটি মানবিকতার চূড়ান্ত প্রকাশ।
যে সমাজে তরুণরা বাবা-মাকে সম্মান করে, সেই সমাজে শৃঙ্খলা, মূল্যবোধ ও সহানুভূতি টিকে থাকে। কিন্তু যখন প্রজন্ম তাদের শেকড় ভুলে যায়, তখনই সমাজ ভেঙে পড়ে। তবে আধুনিক সমাজে অনেক তরুণ মনে করে, তাদের বাবা-মা পুরোনো চিন্তার মানুষ। প্রযুক্তির যুগে তারা নিজেদের বেশি জ্ঞানী ভাবতে শুরু করেছে। সোশ্যাল মিডিয়ার আসক্তি, ব্যক্তিস্বাধীনতার অপব্যাখ্যা, আর আত্মকেন্দ্রিক জীবনযাপন—সব মিলিয়ে তারা বাবা-মার প্রতি শ্রদ্ধা হারিয়ে ফেলছে। কেউ কেউ বৃদ্ধ বাবা-মাকে বোঝা মনে করে। অথচ ইসলাম স্পষ্টভাবে বলেছে—“তুমি যখন ছোট ছিলে, তখন তোমার মা-বাবা যেমন তোমাকে যত্ন করেছিল, তুমিও তাদের তেমনি যত্ন করো।” (সুরা আল-ইসরায় ১৭:২৪)
যে সন্তান বাবা-মাকে সম্মান করে, সে জীবনে শান্তি ও বরকত পায়। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেছেন, “আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো এবং তোমার পিতা-মাতার প্রতিও কৃতজ্ঞ হও।” (সুরা লুকমান ৩১:১৪)
যে ব্যক্তি কৃতজ্ঞ, তার প্রতি আল্লাহ আরও দয়া করেন। পৃথিবীতেও দেখা যায়, যে সন্তান বাবা-মাকে সম্মান করে, সে সমাজে সবার ভালোবাসা অর্জন করে।
হিন্দু ধর্মে বলা হয়েছে, “পিতৃভক্তি পরম ধর্ম।” আর খ্রিস্টধর্মে শেখানো হয়েছে, “যে অন্যকে ভালোবাসে, সে ঈশ্বরকেও ভালোবাসে।” বাবা-মার প্রতি ভালোবাসা ও সম্মান এই ভালোবাসারই প্রথম ধাপ।
তরুণদের উচিত বাবা-মার প্রতি বিনয়ের সাথে আচরণ করা, তাদের কথা মনোযোগ দিয়ে শোনা এবং তাদের অনুভূতির মর্যাদা দেওয়া, এমনকি মতভেদ থাকলেও তা শ্রদ্ধার সঙ্গে প্রকাশ করা।
আর একটি কথা মনে রাখা প্রয়োজন যে বাবা-মার প্রতি শ্রদ্ধা মানে অন্ধভাবে সব কিছু মেনে নেওয়া নয়। ইসলাম ও অন্যান্য ধর্মও বলে—যদি তারা তোমাকে অন্যায়ের পথে আহ্বান করে, তবে তা অনুসরণ করো না; কিন্তু তবুও তাদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করো। (সূরা লুকমান ৩১:১৫) এতে বোঝা যায়, শ্রদ্ধা মানে বিনয় ও সহানুভূতি, তা অন্ধ আনুগত্য নয়।
আমাদের তরুণ প্রজন্ম সমাজের ভবিষ্যৎ। কিন্তু সেই ভবিষ্যৎ আলোকিত হবে তখনই, যখন তারা তাদের অতীতকে, অর্থাৎ তাদের বাবা-মাকে, সম্মান করতে শিখবে। বাবা-মা শুধু জন্মদাতা নন—তারা সন্তানের জীবনযুদ্ধের প্রথম সহযাত্রী। তাদের প্রতি অবমাননা করা মানে নিজের শেকড় কেটে ফেলা।
তাই, প্রিয় তরুণরা—তোমরা তোমাদের বাবা-মাকে অসম্মান করো না। মনে রেখো, আজ যাদের তুমি অবহেলা করছ, একদিন তোমরাও তেমনই বয়সে পৌঁছাবে, আর তখন তোমাদের সন্তানেরা তোমাদের সাথে কঠিন অসৌজন্যমূলক আচরণ করবে। ভুলে যেও না বাবা-মার প্রতি সম্মান কোনো দুর্বলতা নয়, এটি শক্তির প্রতীক। এটি মানবিকতার চূড়ান্ত প্রকাশ।
আসো, আমরা সবাই এমন এক সমাজ গড়ে তুলি, যেখানে প্রতিটি সন্তান তার বাবা-মাকে সম্মান করবে, আর প্রতিটি পরিবার হবে শান্তি, ভালোবাসা ও আশীর্বাদের নীড়।
লেখক : “দ্য আর্ট অব পার্সোনাল ফাইনান্স ম্যানেজমেন্ট, আমি কি এক কাপ কফিও খাবো না, দ্য সাকসেস ব্লুপ্রিন্ট ইত্যাদি বইয়ের লেখক, করপোরেট ট্রেইনার, ইউটিউবার এবং ফাইনান্স ও বিজনেস স্ট্র্যাটেজিস্ট।
[email protected]
এইচআর/এমএস

8 hours ago
5









English (US) ·