তামাকের আগ্রাসন দীঘিনালায়, হুমকিতে জনস্বাস্থ্য

4 hours ago 6

তামাক চাষের আখড়ায় পরিণত হয়েছে খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলা। ৫ ইউনিয়নের ফসলি জমি, স্কুল, কলেজ ও মাইনী নদীর তীর থেকে সর্বত্র ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়েছে তামাক চাষ। এতে মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়েছে জনস্বাস্থ্যসহ কৃষি ব্যবস্থা।

জানা গেছে, সরকার আইন প্রণয়ন করলেও মাঠপর্যায়ে প্রয়োগ না থাকায় দেশি-বিদেশি কোম্পানিগুলো তামাকচাষিদের উদ্বুদ্ধ করেই চলছে। তামাক চাষে নিরুৎসাহিতকরণে সরকারি-বেসরকারি কোনো সংস্থাও খুব একটা এগিয়ে আসছে না। তামাক চাষিরা বলছেন, তামাকের বিকল্প ফসল চাষ করলে বিক্রয়ের নিশ্চয়তা কম, অনেক সময় লোকসান হয়। 

তামাক কোম্পানি সূত্রে, পার্বত্য জেলাগুলোর আবহাওয়া ও মাটি তামাক চাষের জন্য বেশ উপযোগী। অন্যান্য অঞ্চল অপেক্ষা ফলন বেশি, গুণে ও মানে উন্নত। ফলে পার্বত্যাঞ্চলের নদীর চরাঞ্চল ধানি ফসলের জমি-স্কুলঘেঁষে, এমনকি বাড়ির আঙিনায় তামাক চাষ করা হয়। এ কারণে তামাক কোম্পানিগুলো পার্বত্যাঞ্চলে ভিড় করে। 
তবে তামাক চাষে ক্ষতিকারক ওষুধ ব্যবহারে চাষিদের চর্মরোগ, ক্যানসার, শ্বাসকষ্টসহ নানা ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এ ছাড়া তামাক ক্ষেতে যেসব সার ও কীটনাশক ব্যবহার করা হয়, সেগুলো মাটির জন্য ক্ষতিকর।  

সূত্র বলছে, এক সময় তামাকের আখড়া ছিল রংপুর ও কুষ্টিয়া অঞ্চলগুলোতে; কিন্তু এখন দীঘিনালায় কোম্পানির অনুকূলে ৫০০ থেকে ৭০০ চাষি ৪৭১ হেক্টর ফসলি জমিতে তামাকের আবাদ করছেন। উপজেলার মেরুং এলাকা থেকে প্রথমে তামাকের আবাদ আরম্ভ হয়। 

স্থানীয়রা বলছেন, তামাক চাষে গুটি কয়েক লোক লাভবান হলেও সামগ্রীকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন এলাকাবাসী। দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। ধ্বংস হচ্ছে বনাঞ্চল। দীঘিনালায় তামাক চুল্লি রয়েছে ৭ শতাধিক। একটি তামাক চুল্লিতে ৭০০ থেকে ৮০০ টন লাকড়ির প্রয়োজন হয়। চুল্লিগুলোতে কাঠের জোগান দিতে প্রতিদিন বিভিন্ন যানবাহনে করে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে বনাঞ্চলের কাঠ। তামাক চুল্লির চিমনি দিয়ে বের হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে বিষাক্ত কার্বন ডাই-অক্সাইড মিশ্রিত নিকোটিন। বসতবাড়ির কাছাকাছি লোকালয় ও বিদ্যালয়ের পাশেই গড়ে তোলা হয়েছে অনেক বিষাক্ত তামাকের চুল্লি। এরপরও কোম্পানিগুলোর সার্বিক ব্যবস্থাপনায় চাষিদের প্রয়োজনীয় সার, বীজ, কীটনাশকসহ আগাম ঋণের সুবিধা দেওয়ায় তামাক চাষে তারা আগ্রহী হন। 

দীঘিনালা কৃষি অফিসের তথ্যে, এ বছর উপজেলায় প্রায় ৪৭১ হেক্টর তামাক চাষ করা হচ্ছে। গত বছর ছিল ৪৩০ হেক্টর। গত বছরের তুলনায় এ বছর ৪১ হেক্টর বেশি জমিতে তামাক চাষ করা হয়েছে। তবে দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় এখনো নেওয়া সম্ভব হয়নি।

মেরুং ইউনিয়নের তামাক চাষি কামাল হোসেন বলেন, তামাক চাষে কোম্পানি আমাদের অগ্রিম লোন দেয় ও সার, বীজ, কীটনাশক দেয়। উৎপাদন করার পর আবার তারাই কিনে নেয়। তাই আমাদের তামাক পাতা বিক্রয়ের নিশ্চয়তা আছে। অন্যদিকে অন্যান্য কৃষি ফসল যেমন, ভুট্টা, আখ, সূর্যমুখী ফুল, আলুসহ অন্যান্য শাক-সবজি চাষাবাদ করলে বিক্রয়ের নিশ্চয়তা নেই। উৎপাদিত সে ফসল কম দামে বিক্রয় করায় লোকসান গুনতে হয়। বিক্রয়ের নিশ্চয়তা থাকলে তামাক ছেড়ে অন্যান্য কৃষি ফসল চাষ করব।

দীঘিনালা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শাহদাত হোসেন বলেন, কৃষি অফিসের মাধ্যমে কৃষককে ধারণা দেওয়া হয়, তামাক চাষ করলে মাটির দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি হয়, এক পর্যায়ে ফসল উৎপাদন ব্যাহত হতে পারে। আবার তামাক চুল্লিতে প্রচুর কাঠ পোড়ানোর ফলে বনের গাছপালা কমে যাচ্ছে। এতে পরিবেশে বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। 

তিনি আরও বলেন, তামাক কোম্পানিগুলো কৃষকদের তামাক চাষে অগ্রিম সার, কীটনাশক, ওষুধ ও দাদনের টাকা দেয়। একই সঙ্গে তামাক ক্রয়ের নিশ্চয়তা দেয়। ফলে কৃষকের তামাক পাতা উৎপাদন করতে বেশি খরচ না হওয়ায় প্রচুর লাভ হয়। পাশাপাশি অন্য কৃষিপণ্য উৎপাদন করতে অনেক পুঁজি বিনিয়োগ করতে হয়, কিন্তু অনেক সময় বাজার মন্দা থাকায় উৎপাদিত ফসল বিক্রি করতে পারে না তারা। এতে লোকসান হয়। এসব কারণে তামাক চাষ করতে কৃষক আগ্রহী। 

দীঘিনালা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স কর্মকর্তা তনয় তালুকদার বলেন, তামাক চাষ স্বাস্থ্যের জন্য অবশ্যই ক্ষতিকর। তামাকচাষির শ্বাসকষ্ট, ক্যানসার, হজমশক্তি কমে যাওয়াসহ নানা ধরনের দীর্ঘমেয়াদি রোগ হতে পারে। এসব রোগের হাত থেকে বাঁচতে তামাক চাষ ছেড়ে দিতে হবে। একই সঙ্গে তামাকের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে সবাইকে সচেতন করতে হবে।

Read Entire Article