তিন শব্দপুত্র

1 month ago 10

'দূরবীন', 'মানবজমিন' আর 'পার্থিব' উপন্যাসত্রয়ী আচমকা উড়ে এলো ওয়েবে ভর করে। ভেসে উঠল স্ক্রিনে।

চোখ বাঁকিয়ে, নিজেকে সরু আর লম্বা করে মানবজমিনকে ধমক দিয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ দূরবীন বলল, 'আমার জায়গা তুমি দখল করতে চাও কেন? আমিই সেরা। আমাকে আগে আসন নিতে দাও।'

'আমার জন্মসাল ১৯৮০ দশকের প্রথম দিকে আর তোমার ১৯৭০ দশকের শুরুতে। সেই অর্থে তুমি প্রায় দশ বছরের সিনিয়র। বড়ো হিসেবে তোমাকে সম্মান করতে পারি, সেরা হিসেবে নয়। আমিই সেরাসৃষ্টি, আমার শিল্পরূপ জগৎ-সংসার থেকে কখনো বিলীন হবে না।' গর্বিত ভঙ্গিতে বলল মানবজমিন।

'আমার মধ্যে আছে মানুষের মন, সম্পর্কের সূক্ষ্ম সামাজিক-মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব, সংকটও। বাইরের পৃথিবীর চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো ব্যক্তির বিশাল মনোজগৎ দেখার সুযোগ পাওয়া। আমি শব্দের ঘাড়ে চড়েবসা সেই দূরবীন যার মাধ্যমে পাঠক দেখতে পায় ব্যক্তিগত মনোজগতের গহনরূপ, একাকীত্ব। জীবনের অর্থ খুঁজে পায় তারা। আত্মসচেতন হয়ে নতুনরূপে জেগে উঠতে পারে। সুতরাং আমিই মহৎ, আমিই বড়ো, বয়োজ্যেষ্ঠ। আমার শিল্পরূপই স্থায়ী, জীবনঘনিষ্ঠ। আমার মধ্যে লুকিয়ে আছে আত্মবিশ্লেষণ ও মনস্তত্ত্বের অনন্য স্বরূপ।'

হো হো করে হেসে উঠলো মানবজমিন। হাসির দাপটে কেঁপে উঠলেও নীরবতা ভঙ্গ করে পার্থিব বলল, 'বিকৃত উল্লাস মানায় না হে মানবজমিন, মেজো ভাইয়া। মানলাম তোমার মধ্যে আছে জীবনের অস্তিত্ব বা মানবমাটির ভেতর গেড়ে বসা শেখড়বাকল অনুসন্ধানের অভিপ্রায়। চরিত্রদের অতীত এবং সম্পর্কের গভীরতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছো তুমি; প্রেম-বিশ্বাস-সন্দেহ এবং সম্পর্কের দায়বদ্ধতা নিয়েও জীবনখোঁড়া আলো ছেঁকে তুলে এনেছো। ঠিক আছে। তাই বলে সিনিয়রকে অবজ্ঞা করবে? বড়োদের মর্যাদা এবং অভিজ্ঞতা মাথায় তুলে রাখতে হয়। তাহলে জুনিয়রদের মর্যাদা বেড়ে যায়। ছোটোরা আরও ভালো কিছু উপহার দিতে পারে যুগের চাহিদা অনুযায়ী।'

লম্বা চোখ ছোট করে খুশি হয়ে প্রশান্ত মনে দূরবীন বলল, 'তোমার ভেতরটাও আমি দেখতে পেলাম, প্রিয় পার্থিব। মানুষের ভোগবাদীসত্তা আর শূন্যতার ভেতর থেকে নৈতিকআলো নিয়ে তুমি জেগে উঠেছো। ভোগবাদী সমাজ এবং মানুষের অর্থলিপ্সার জীবনঘনিষ্ঠ আখ্যান উপহার দিয়ে ইতিবাচকভাবে সে-আলো ছড়িয়ে দিতে পেরেছো। পাঠক তোমার খারাপ চরিত্রগুলো দেখে দেখে নিজেদের মধ্যে লুকিয়ে থাকা বাজে বৈশিষ্ট্য দেখার সুযোগ পাবে। খারাপের ভেতর থেকে তাদের নৈতিক শিক্ষা উন্নততর হবে। ১৯৯৪ সালে তোমার জন্ম হলেও সম্মান করতেই হবে তোমাকে। বয়সে ছোট্ট হয়েও আমার অন্যচোখ খুলে দিয়েছো তুমি। নিশ্চয়ই মানবজমিনের জীবন জিজ্ঞাসার ভেতরেও অন্য জীবনদর্শন ঢুকে গেছে? কি বলো, মেজো?'

'ঠিক বলেছো। আমরা বড়োরা কেবল নিজেদের গৌরবগাথা নিয়ে ডুবে থাকি, ছোটোরা যে আরও গৌরবময় কিছু উপহার দিতে পারে ভাবি না।'

আচমকা তিন সহোদরের মাঝে উড়ে এসে হাজির হলেন ওদের শব্দজনক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। গভীর তৃপ্তি নিয়ে বললেন, 'দূর থেকে তোমাদের কথোপকথন শুনছিলাম।

তোমাদের মধ্যে সমঝোতা হয়েছে দেখে ভালো লাগছে আর তাই আড়াল থেকে সামনে উপস্থিত হলাম। তোমরা তিনজনই আমার সন্তানতুল্য। আমার কাছে সবার মূল্যই সমান। পাঠক ও তোমাদের তিনজনকে মর্যাদার সঙ্গে গ্রহণ করেছে। ভবিষ্যতই বলে দিবে তোমাদের মধ্যে কে টিকে থাকবে, কে থাকবে না। তবে আমি আশাবাদী তিনজনের জন্যই। তোমাদের জন্য আমার আশীর্বাদ রইল।'

লেখক: মনোচিকিৎসক, কথাসাহিত্যিক।

এইচআর/জেআইএম

Read Entire Article