তৃতীয় লিঙ্গের হয়েও সমাজ-মানুষের সেবায় মুন্নী‎

11 hours ago 5

‘তৃতীয় লিঙ্গ’ এই শব্দটি শুনলে কিছুটা আতঙ্কিত হোন সবাই। নিশ্চয়ই আপনার চোখে ভেসে উঠেছে রাস্তায় বাসে-ট্রেনে চলতে পথে কিছু ‎তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের জোর করে টাকা আদায় করা, টাকা না দিলে নানানভাবে মানুষকে হয়রানির প্রতিচ্ছবি।

‎তবে এর বিপরীত চিত্রও আছে সমাজে, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষেরা বাংলাদেশের অবহেলিত জনগোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত। তারা আবহমানকাল ধরে পারিবারিক, সামাজিক, শিক্ষা, বাসস্থান, চিকিৎসা এবং নিরাপত্তাসহ বিভিন্নভাবে চরম বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার হয়ে আসছেন।

পাশাপাশি তাদের একটি অংশ অসামাজিক ও অশ্লীল আচরণের মাধ্যমে মানুষকে অস্বস্তিকর করে তুলছেন। যারা বিভিন্ন সড়কের গুরুত্বপূর্ণ এলাকায়, বাসাবাড়ি, বিভিন্ন যানবাহন এবং সামাজিক অনুষ্ঠানে জোর করে টাকা তুলে জনজীবনকে অস্বস্তিকর করে তুলছেন। ‎বিশেষ করে ছাত্রী এবং নারীদের সামনে অশ্লীল আচরণের ভয় দেখিয়ে টাকা নেন। ঈদ ও বিভিন্ন দিবসে তাদের এসব কর্মকাণ্ড আরও বেড়ে যায়।

‎তাই সমাজের পিছিয়ে পড়া অবহেলিত এই জনগোষ্ঠীকে মূল ধারায় ফিরিয়ে আনতে টেকসই জীবনমান উন্নয়নে সরকারি-বেসরকারিভাবে উদ্যোগ নেওয়া বিশেষ প্রয়োজন। এছাড়া সমাজের বিত্তবান, শিল্পপতি, ব্যবসায়ী এবং সচেতন নাগরিকদেরও এগিয়ে আসতে হবে। আধুনিক এই যুগে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা এখন সময়ের দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে। দিন দিন তারা যেমন বিপর্যয় দিকে যাচ্ছেন, তেমনি সমাজের জন্যও ক্ষতিকর হয়ে উঠছেন।

‎এদিকে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ হয়েও পরিবার ও সমাজের শত প্রতিবন্ধকতার মাঝেও সফল হয়েছেন অনেকে। তাদের একজন মুন্নী আক্তার। হয়েছেন জনপ্রতিনিধি, সমাজের এবং মানুষের দেখভালের দায়িত্ব নিয়েছেন তিনি। মুন্নী জামালপুর জেলা হিজরা কল্যাণ সংস্থার সভাপতি এবং জেলার দেওয়ানগঞ্জ উপজেলা পরিষদের সাবেক মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান।

মুন্নী বলেন, ‎‘আমিও সমাজের উন্নয়নে অংশীদার হতে চাই। তাই তো সবশেষ উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করি। যেখানে সাধারণ মানুষের ভালোবাসায় মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত হয়। তবে সেবা করার তেমন সুযোগ হয়নি। ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর সব প্রতিনিধিদের কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়।’

‎তিনি আরও বলেন, ‘জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়ার পর সবাই আমাকে ফুলের মালা দিয়ে সংবর্ধনা দিয়েছে। ভোটারসহ সব শ্রেণির মানুষ যে সম্মান দিয়েছে তা আমার জীবনে সেরা প্রাপ্তি। তখন মনে হয়েছে আমি অবহেলিত নই, এই সমাজেরই একজন। আমার এই পর্যন্ত আসতে অনেক কটু কথা ও অপমানিত হয়েছি।’

‎কর্মসংস্থানের প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরাও সমাজের সাধারণ মানুষের মতো কাজ করে জীবিকা-নির্বাহ করতে চাই, কারো উপর বোঝা হয়ে থাকতে চাই না। পরিবার ও সমাজের কাছে উপহাস এবং কৌতুকের পাত্র হয়ে বাচঁতে চাই না। পরিবারের দায়িত্বভার আমরাও নিতে চাই। এজন্য সুযোগ ও কাজের পরিবেশ করে দিতে হবে।’

‎‘ছোট দোকান বা ব্যবসা করার জন্য সরকারি বা বেসরকারিভাবে ঋণের ব্যবস্থা করার জোর দাবি করছি। আমাদের সহায়তার জন্য সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন সংগঠন এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠান, বিত্তবানদের এগিয়ে আসা অনুরোধ করছি। তারা এগিয়ে আসলেই হিজরা সম্প্রদায় ভালো কিছু করতে পারবে।’

তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের কর্মসংস্থানের প্রয়োজন ও দেশের অর্থনৈতিক চাকা সচলে তারাও ভূমিকা রাখতে পারে। এই সমাজে দীর্ঘদিন ধরে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষেরা অপমানিত, লাঞ্ছিতসহ বিভিন্নভাবে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। পরিবার ও সমাজের কাছে মূল্য না পেয়ে সমাজ সভ্যতা থেকে ছিটকে পড়ে অবহেলিত জীবনযাপন করছেন। ফলে বাসাবাড়ি, বাস-ট্রেনে ঘুরে ঘুরে টাকা তুলছে, বাড়ি বাড়ি গিয়ে বাচ্চা নিয়ে নাচানাচি করছে। কেউ কেউ যৌন পেশাতেও লিপ্ত হচ্ছেন। এছাড়া অনেকেই এক শ্রেণির মানুষের কাছে বিনোদনের পাত্র হয়ে দাঁড়িয়েছেন।

‎শুধু তাই নয় কেউবা অপরাধমূলক কাজেও যুক্ত হচ্ছেন। একটা মানুষ যখন বেকার থাকেন, তখন তিনি ধীরে ধীরে বিভিন্ন অপরাধে জরিয়ে পড়েন। কিন্তু এর দায়ভার সমাজের প্রতিটা মানুষকেই নিতে হবে। কারণ তাদের জীবনমান পরিবর্তনের জন্য আদিকাল ধরে কোনো মানুষ চেষ্টা করেনি। কোনো প্রতিষ্ঠান বা সংস্থাও এগিয়ে আসেনি। বর্তমানে কিছু প্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসলেও তা চোখে পড়ার মতো নয়। সমাজের প্রতিটা সচেতন মানুষের নিজ অবস্থা থেকে এগিয়ে আসতে হবে। তবেই এই জনগোষ্ঠীর মানুষের জীবনমান পরিবর্তনের সম্ভব।

মুন্নীর মতো তৃতীয় লিঙ্গের অনেকেই আছেন যারা প্রকাশ্যে বা গোপনে পরিবার ও সমাজের জন্য কিছু করছেন। এছাড়া কেউ কেউ নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে অন্যদের মতো বাঁচার চেষ্টা করছেন। তবে সঠিক সুযোগ সুবিধা না পাওয়ায় তারা ঘুরে দাঁড়াতে পারছেন না।

আরও পড়ুন
শেয়াই পিঠা বাগেরহাটের শীতকালীন ঐতিহ্য
শাপলার সৌন্দর্যে ভরপুর গোপালগঞ্জের বিল

কেএসকে/জেআইএম

Read Entire Article