উচ্চ আদালতের সাংবিধানিক ক্ষমতাকে অবজ্ঞা করে এখতিয়ার বহির্ভূত ও অযাচিত মন্তব্য করার অভিযোগে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীদের তোপের মুখে পড়েছেন আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের এ শিক্ষকের ‘যোগ্যতা’ নিয়ে প্রশ্ন তুলে তাকে তুলোধুনো করেছেন আইনজীবীরা।
একই সঙ্গে আগামী ৩১ অক্টোবরের মধ্যে বিচার বিভাগ নিয়ে ‘আপত্তিকর বক্তব্য’ প্রত্যাহার করে ক্ষমা চাইতে তাকে আলটিমেটাম দেওয়া হয়েছে।
বুধবার (২৯ অক্টোবর) সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির দক্ষিণ শামসুল হক চৌধুরী হলে আয়োজিত প্রতিবাদ সমাবেশ থেকে এমন প্রতিক্রিয়া জানান আইনজীবীরা। উচ্চ আদালতের জামিন দেওয়া নিয়ে আইন উপদেষ্টার নগ্ন হস্তক্ষেপের তীব্র বিরোধিতা করে সুপ্রিম কোর্ট বারের আইনজীবীরা এ প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করেন।
আইনজীবীরা বলেন, আসিফ নজরুল উচ্চ আদালতের বিচারিক কার্যক্রম সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা রাখলে বিচার বিভাগ নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করতে পারতেন না। একজন ‘স্কুলশিক্ষক’ আইন উপদেষ্টা হতে পারেন কি না? তার আইন উপদেষ্টা হওয়ার যোগ্যতা আছে কি না? একজন ‘স্কুলশিক্ষককে’ আইন উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ কেন দেওয়া হয়েছে, তার জবাব প্রধান উপদেষ্টাকে দিতে হবে।
গত ২৩ অক্টোবর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সংবাদ সম্মেলনে উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বিচারিক কার্যক্রমে উচ্চ আদালতের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।
আরও পড়ুন
পাঁচ ঘণ্টায় ৮০০ মামলার শুনানি কীভাবে সম্ভব, প্রশ্ন আইন উপদেষ্টার
ওই সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, উচ্চ আদালতের একটি বেঞ্চ একদিনে ৪-৫ ঘণ্টায় প্রায় ৮০০ মামলায় জামিন দিয়েছেন। জামিন উনি দিতেই পারেন। কিন্তু ৪-৫ ঘণ্টায় ৮০০ মামলা শোনা কি সম্ভব? এটি আসলে বিচারিক বিবেচনায় ছিল কি না—এরকম আরও কিছু কিছু প্রসঙ্গ উঠেছে। আমাদের মনে হয় বিষয়গুলো বিবেচনা করে আমরা কয়েক সপ্তাহের মধ্যে এ আইনটি (সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় অধ্যাদেশ, ২০২৫) চূড়ান্ত করার পদক্ষেপ নিতে পারবো।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক আসিফ নজরুলের ওই বক্তব্যের সমালোচনা করে প্রতিবাদ সমাবেশে আইনজীবীরা বলেন, আইন উপদেষ্টার বক্তব্য প্রত্যাহার করে তাকে ক্ষমা চাইতে সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে।
বক্তব্য প্রত্যাহার না করলে আসিফ নজরুলের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ আনতে প্রধান বিচারপতির কাছে আর্জি জানান আইনজীবীরা। অন্যথায়, তারা নিজেরাই মামলা করবেন। এমনকি উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলনের হুঁশিয়ারিও দেওয়া হয়।
আইন উপদেষ্টার বক্তব্যের প্রসঙ্গ টেনে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সৈয়দ মামুন মাহবুব বলেন, আপনি সিনিয়র আইনজীবীদের সঙ্গে বসেন, আমাদের সঙ্গে বসেন, চা খান। বিচার বিভাগ নিয়ে অসম্মানজনক বক্তব্য প্রত্যাহার করুন। এতে আপনি ছোট হবেন না।
প্রতিবাদ সমাবেশ থেকে আইনজীবীরা বলেন, আপনি শিক্ষক মানুষ, ভালো কথা। সুপ্রিম কোর্ট সম্পর্কে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা উদ্ধত্যপূর্ণ। এ বক্তব্যের জন্য আপনাকে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইতে হবে। এ বক্তব্যের জন্য অ্যাটর্নি জেনারেল অফিস থেকে প্রতিবাদ জানানো উচিত ছিল। কারণ, তারাও তো আদালতে ছিলেন। তারা তো আপত্তি তোলেননি।
অনুষ্ঠানে অ্যাডভোকেট হাসান তারেক চৌধুরী বলেন, উচ্চ আদালতের বিচারপতিরা স্বাধীন কি না? গণঅভ্যুত্থানের দাবি ছিল স্বাধীন বিচার বিভাগ। আজ স্বাধীন বিচার বিভাগ আক্রান্ত। বিচার বিভাগের ওপর যখন আঘাত আসবে, তখন আমরা ঐক্যবদ্ধ।
বক্তব্য প্রত্যাহারের সময় বেঁধে দিয়ে সৈয়দ মামুন মাহবুব বলেন, ৩১ অক্টোবরের মধ্যে আইন উপদেষ্টা তার বক্তব্য প্রত্যাহার না করলে আমরা পরবর্তী পদক্ষেপ নেবো। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, আইনের শাসন নিয়ে কোনো দ্বিমত পোষণ করা যাবে না।
গ্রন্থগত বিদ্যা প্রয়োজনের সময় কাজে লাগে না—এ কথা উল্লেখ করে আইনজীবী সুরাইয়া বেগম বলেন, আসিফ নজরুল আইনের শিক্ষক, তিনি হাইকোর্ট সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা রাখেন না। ধারণা রাখলে এ রকম বক্তব্য দিতেন না। আজ পর্যন্ত তিনি অসৌজন্যমূলক বক্তব্য প্রত্যাহার করেননি। হাইকোর্ট স্বাধীন, বিচারকরা কী আদেশ দিয়েছেন, সেটা তাদের বিষয়। আশা করি, সুপ্রিম কোর্ট এ বিষয়ে আদালত অবমমাননার মামলা করবে, নইলে আমরাই করবো।
তিনি বলেন, যে বিচার বিভাগে আইনজীবীদের সম্মান নেই, সেই বিচার বিভাগে বিচারপতিদেরও সম্মান নেই। আইনজীবী ও বিচারপতিদের সম্মান না থাকলে বিচার বিভাগ ধ্বংস হয়ে যাবে। শিক্ষকতা আর বিচার বিভাগ এক নয়। আসিফ নজরুল যেন আইনজীবীদের শেখাতে না আসেন। সুপ্রিম কোর্টের একজন জুনিয়র আইনজীবীও তাকে শেখানোর যোগ্যতা রাখেন।
আরও পড়ুন
হুটহাট করে জামিন দেবেন না: বিচারকদের আসিফ নজরুল
আইনজীবী এ বি এম রফিকুল হক রাজা বলেন, আসিফ নজরুল যে বক্তব্য রেখেছেন, তা স্বাধীন বিচার বিভাগের ওপর হস্তক্ষেপ; আমরা তা মেনে নেবো না।
আরেক আইনজীবী গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিক বলেন, আইন উপদেষ্টার পদে থাকার আর অধিকার নেই। তিনি বিচার বিভাগের ওপর হস্তক্ষেপ করেছেন। তিনি পদত্যাগ না করলে তার বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলা করতে হবে। তার কি আইন উপদেষ্টা হওয়ার যোগ্যতা আছে?
আইনজীবী মোহাম্মদ মহিউদ্দিন আহমাদ বলেন, আমরা যারা ফৌজদারি মামলা নিয়ে কাজ করি, তাদের বেঁচে থাকার একমাত্র উপায় জামিন। রায় বা আদেশে ভুল হলে উচ্চ আদালত দেখবে। স্কুল মাস্টারি করা, আর আইনচর্চা করা এক কথা নয়।
প্রতিবাদ সমাবেশে সভাপতির বক্তব্যে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহ আহমেদ বাদল বলেন, আজ আইনজীবীরা জেগে উঠেছে। আইন উপদেষ্টার বক্তব্য আদালত অবমাননার শামিল। ৩১ অক্টোবরের মধ্যে সুপ্রিম কোর্ট সুয়োমটো রুল না দিলে ২ নভেম্বর থেকে আমরা আইন উপদেষ্টার পদদ্যাগ দাবিতে কঠোর আন্দোলনে যাবো।
ব্যারিস্টার এম আশরাফুল ইসলামের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে এম খালেদ আহমেদ, কেএম জাবের, হুমায়ুন কবির, সজীব মাহমুদ, সৈয়দা আসিফা আশরাফী পাপিয়া, আবদুল কুদ্দুস বাদল, ইয়ারুল ইসলাম প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।
এফএইচ/এমকেআর/এএসএম

2 hours ago
3









English (US) ·