থাইরয়েড সমস্যাগুলো প্রায়ই কেন ধরা পড়ে না বলছেন বিশেষজ্ঞ

2 hours ago 2
বিশ্বজুড়ে লাখ লাখ মানুষ থাইরয়েড সমস্যায় ভুগছেন, কিন্তু তাদের প্রায় ৬০ শতাংশই জানেন না যে তাদের এই সমস্যা আছে। হালকা হাত কাঁপা থেকে শুরু করে ধীরে ধীরে মাথার ঝাপসা ভাব— ডাক্তাররা বলছেন, এসব উপেক্ষা করবেন না। গলার নিচে ছোট্ট একটা অংশে থাকা থাইরয়েড গ্রন্থি চুপচাপ শরীরের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ নিয়ন্ত্রণ করে— যেমন হৃদস্পন্দন, হজম, হাড়ের স্বাস্থ্য আর মস্তিষ্কের কাজ। আরও পড়ুন : বারবার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে? এখনই সতর্ক হোন! আরও পড়ুন : চোখের নীরব বিপদ ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি এত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকলেও, বেশিরভাগ মানুষ বুঝতেই পারেন না কখন থাইরয়েডে সমস্যা দেখা দিচ্ছে। নিউ জার্সির ইনস্পাইরা হেলথ-এর এন্ডোক্রিনোলজিস্ট ড. জোডি ফক্স মেলুল বলেন, ‘থাইরয়েডের লক্ষণগুলো এমনভাবে দেখা দিতে পারে, যেগুলো আপনি স্ট্রেস, বার্ধক্য বা ব্যস্ততার অংশ ভেবে এড়িয়ে যান।’ যেমন রাতে ঘুম না হওয়া, অকারণে দুশ্চিন্তা বা রাগ বা কফির কাপ ধরার সময় হাতে সামান্য কাঁপুনি। এমন ছোট ছোট লক্ষণগুলোকে গুরুত্ব দেওয়া জরুরি, কারণ গবেষণা বলছে, থাইরয়েডের চিকিৎসা না করালে তা হৃদরোগ, হাড় ভেঙে যাওয়া, বন্ধ্যাত্ব, এমনকি মস্তিষ্কের সমস্যা পর্যন্ত তৈরি করতে পারে। ওহাইওর ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিকের এন্ডোক্রিনোলজিস্ট ড. রাভালি ভীরামাচানেনি বলেন, ‘থাইরয়েড সমস্যা এত বেশি মানুষের হয় যে ব্যাপক স্ক্রিনিং ও সচেতনতা বাড়ানো খুবই জরুরি, কারণ এটি জীবনের মান ও দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যের উপর বড় প্রভাব ফেলতে পারে।’ থাইরয়েড কী এবং এর সমস্যার প্রভাব কেন শরীরজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে? প্রজাপতির মতো আকৃতির, মাত্র দুটি আঙুলের সমান এই থাইরয়েড গ্রন্থিটি গলার অ্যাডামস অ্যাপলের নিচে অবস্থান করে। এটি T4, T3 এবং ক্যালসিটোনিন নামক হরমোন তৈরি করে, যা শরীরের প্রায় প্রতিটি কোষের শক্তি ব্যবহারের প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে। এই হরমোনগুলো শরীরের মেটাবলিজম, তাপমাত্রা, হৃদস্পন্দন, হজম, মস্তিষ্কের কার্যকারিতা, পেশির শক্তি— সব কিছুর ওপর প্রভাব ফেলে। ড. ভীরামাচানেনি বলেন, ‘থাইরয়েড হরমোন হচ্ছে শরীরের ইঞ্জিনের অ্যাক্সেলেটরের মতো।’ যখন থাইরয়েড খুব বেশি হরমোন তৈরি করে (হাইপারথাইরয়েডিজম), তখন শরীর যেন বেশি গতিতে চলে। আবার খুব কম হরমোন তৈরি হলে (হাইপোথাইরয়েডিজম), শরীরের কার্যক্রম খুব ধীর হয়ে যায়। ফলে মেজাজ খারাপ হওয়া, ঘুমের সমস্যা, ক্লান্তি, ওজন ওঠা-নামা, অতিরিক্ত গরম বা ঠান্ডা লাগা, হার্টবিট বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি সমস্যা দেখা দিতে পারে। থাইরয়েড সমস্যা কখনো কখনো অটোইমিউন রোগের কারণেও হয়, যেমন হাশিমোটো’স ডিজিজ বা গ্রেভস’ ডিজিজ— যেখানে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভুল করে থাইরয়েড গ্রন্থিকে আক্রমণ করে। ড. মেলুল বলেন, ‘থাইরয়েডের সমস্যায় আপনি ক্লান্ত হতে পারেন, মনোযোগ হারাতে পারেন, কাজ বা সন্তান লালন-পালনে পিছিয়ে পড়তে পারেন, এমনকি যেসব কাজ একসময় আনন্দ দিত, সেগুলোও আর ভালো না লাগতে পারে।’ মস্তিষ্কের ক্ষয়েও থাইরয়েডের ভূমিকা থাকতে পারে গবেষণায় দেখা গেছে, থাইরয়েড সমস্যা ডিমেনশিয়া (স্মৃতিভ্রংশ)-এর ঝুঁকি বাড়ায়, বিশেষ করে ভাসকুলার ডিমেনশিয়ার। এমনকি হালকা ধরনের হাইপারথাইরয়েডিজমেও আলঝেইমার রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়। এই ঝুঁকি বেশি হয় বয়স্কদের জন্য, যাদের মাঝে লক্ষণ তেমন স্পষ্ট না থাকলেও ভেতরে ভেতরে স্থায়ী ক্ষতি হতে পারে। সমস্যা এত বেশি, তবুও মানুষ জানে না গবেষণা বলছে, জীবনকালে প্রতি ১০ জনের একজনের এই সমস্যা হতে পারে। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে সংখ্যাটা আরও বেশি, বিশেষ করে কিশোর-কিশোরী এবং বয়স্কদের মধ্যে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, ৬৫ বছরের বেশি বয়সীদের মধ্যে প্রতি ৪ জনে ১ জনের থাইরয়েডে সমস্যা থাকতে পারে। আরও পড়ুন : মাইগ্রেনের ৭ অজানা কারণ আরও পড়ুন : শরীরের ৯ লক্ষণে বুঝবেন অতিরিক্ত চিনি খাচ্ছেন কিনা তবে এত লোকের হলেও, বেশিরভাগ মানুষ জানেনই না যে তাদের থাইরয়েড সমস্যা আছে। কারণ এর লক্ষণগুলো অনেকটা স্ট্রেস, বিষণ্ণতা, বার্ধক্য বা ক্লান্তির মতো মনে হয়। আরেকটা জটিলতা হলো— কেউ কেউ খুব বেশি সমস্যায় পড়েন, আবার অনেকেই একেবারেই লক্ষণহীন থাকেন। আগে ধরা পড়লে চিকিৎসা সহজ ও কার্যকর ভালো খবর হলো— থাইরয়েড সমস্যা (হাইপার বা হাইপো) একবার ধরা পড়লে চিকিৎসা সহজ এবং প্রভাবশালী হয়। ড. বারবেসিনো বলেন, ‘অনেক রোগীকে দেখি, যারা মাসের পর মাস খারাপ লাগা, দুর্বলতা বা চিন্তার অস্পষ্টতা নিয়ে ভুগছেন, কিন্তু চিকিৎসার পর কয়েক সপ্তাহেই আবার স্বাভাবিক হয়ে উঠছেন।’ সঠিক সময়ে চিকিৎসা নিলে হৃদস্পন্দন নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়, হাড় দুর্বল হওয়া কমে, ঘুম ভালো হয়, মন ভালো থাকে, এমনকি স্মৃতিভ্রংশের মতো জটিলতা থেকেও রক্ষা পাওয়া যায়। তবে যদি চিকিৎসা না হয়, তাহলে কিছু ক্ষতি স্থায়ী হয়ে যেতে পারে। যেমন, হালকা হাইপারথাইরয়েডিজম আগে ধরা পড়লে একজন বৃদ্ধ ব্যক্তির স্থায়ী হার্টের সমস্যা (অ্যাট্রিয়াল ফাইব্রিলেশন) এড়ানো যেত। কী লক্ষণ দেখলে সাবধান হবেন যেহেতু থাইরয়েড সমস্যা অনেক সময় অন্য রোগের মতো আচরণ করে, তাই লক্ষণগুলোর একটা প্যাটার্ন খুঁজে পাওয়া দরকার। যেসব লক্ষণ লক্ষ করবেন - উদ্বেগ বা রাগ যেন কমছেই না - ঘুমের সমস্যা - ওজন কমে যাচ্ছে, কিন্তু খাওয়া ঠিকঠাক - হাত কাঁপা - ঘন ঘন প্রস্রাব - অতিরিক্ত ঘাম - গলার নিচে ফোলা বা চোখ ফুলে যাওয়া, চোখ বড় হয়ে যাওয়া বা ঝাপসা দেখা - নারীদের ক্ষেত্রে পিরিয়ড অনিয়মিত বা গর্ভধারণে সমস্যা চিকিৎসা কীভাবে শুরু হয় একটি সাধারণ রক্ত পরীক্ষায় থাইরয়েড হরমোনের মাত্রা দেখে বোঝা যায় সমস্যা আছে কি না। মাঝে মাঝে আলট্রাসাউন্ড বা অন্য ইমেজিংও লাগতে পারে। যদি পরীক্ষায় হরমোন স্বাভাবিক দেখা যায়, তাহলে অন্য কারণগুলো খতিয়ে দেখতে হয়। চিকিৎসার ধরন নির্ভর করে সমস্যার ধরন ও মাত্রার উপর। ওষুধ, রেডিওআয়োডিন থেরাপি বা কখনো কখনো সার্জারি দরকার হতে পারে। আরও পড়ুন : হঠাৎ শরীর ফুলে যাচ্ছে? হতে পারে ভেতরে লুকানো বড় কোনো সমস্যা আরও পড়ুন : ডায়াবেটিস সম্পর্কে জানুন তবে চিকিৎসা শুরু করার আগে আপনার লক্ষণ ও সন্দেহ নিয়ে চিকিৎসকের সঙ্গে খোলাখুলি আলোচনা করতে হবে। থাইরয়েড সমস্যা অনেকেরই হয়, কিন্তু সেটা ধরা পড়ে না কারণ এর লক্ষণ অনেক সাধারণ রোগের মতোই হয়। তবে একটু সতর্ক থাকলে সহজেই ধরা পড়ে, আর চিকিৎসায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভালো ফল পাওয়া যায়। তাই নিজেকে নিয়ে সন্দেহ হলে পরীক্ষা করান, সচেতন থাকুন। সূত্র : ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিক
Read Entire Article