নোয়াখালীর হাতিয়া থানায় দায়ের হওয়া মামলা সালিশের মাধ্যমে তুলতে বাধ্য করার অভিযোগ উঠেছে থানার ওসি এ কে এম আজমল হুদার তালোই (বোনের শ্বশুর) মো. কামাল উদ্দিনের (৭২) বিরুদ্ধে। এমনকি সংঘটিত যেকোনো ঘটনায় মামলা হবে কি হবে না সেটাও তিনি নির্ধারণ করেন বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হাতিয়া থানা এবং ডাকবাংলো সংলগ্ন সৎ ছেলে (স্ত্রীর আগের সংসারের ছেলে) মেজর মো. ফয়সাল বিন মির্জার বাসভবন ‘ক্যাসকেড ব্লু’তে বসবাস করেন মো. কামাল উদ্দিন। তিনি থানায় দায়ের হওয়া বেশিরভাগ অভিযোগ এ বাড়িতে বসে টাকার বিনিময়ে বাদী-বিবাদীর স্বাক্ষরযুক্ত খালি স্ট্যাম্প জমা নিয়ে সালিশ করেন। কেউ তার প্রস্তাবে রাজি না হলে মিথ্যা মামলায় হয়রানির ভয় দেখান।
মো. কামাল উদ্দিন হাতিয়ার জাহাজমারা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মৃত আছাদুল হকের ছেলে। তিনি ৫ আগস্টের আগে নিষ্ক্রিয় থাকলেও বর্তমানে বিএনপির প্রকৌশলী ফজলুল আজীম গ্রুপের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। হাতিয়া থানার বর্তমান ওসি এ কে এম আজমল হুদা এই কামাল উদ্দিনের সৎ ছেলে তানভীরের স্ত্রীর বড় ভাই।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, কামাল উদ্দিন মামলার আসামিদের থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে বিচার প্রার্থীদের জোরপূর্বক সালিশে বসাতে বাধ্য করেন। কেউ তার প্রস্তাবে রাজি না হলে ওসির তালোই পরিচয়ে মিথ্যা মামলায় জড়ানোর হুমকিও দেন। এমন কিছু কলরেকর্ড জাগো নিউজের হাতে এসেছে। যাতে টাকা নিয়ে সালিশ করা, খালি স্ট্যাম্প জমা নিয়ে জিম্মি করাসহ মিথ্যা মামলায় আসামি করার হুমকির যথেষ্ট প্রমাণ মিলেছে।
আরও পড়ুন-
- স্কুলমাঠে দুই ছাত্রকে হাতুড়িপেটা
- সিরাজগঞ্জে উঠে এলো ৯৫ অনিয়ম-দুর্নীতির চিত্র
- রুমিন ফারহানার সমর্থকদের মহাসড়ক অবরোধ, বিক্ষোভ এনসিপির
রাশেদা বেগম (৪৮) নামে জাহাজমারা ইউনিয়নের এক ভুক্তভোগী বলেন, ‘গত মঙ্গলবার (১৯ আগস্ট) সকালে ১০-১১ জন সন্ত্রাসী আমাদের বসতঘরে হামলা চালায়। এসময় আমি এবং আমার স্বামী আনোয়ার হোসেনকে পিটিয়ে জখম করে। এ ঘটনায় ৬ জনের নামোল্লেখ করে ওইদিন হাতিয়া থানায় অভিযোগ দিলে পুলিশ মামলা রুজু করে (নম্বর-১৪) । এরপর থেকে ওসির আত্মীয় কামাল উদ্দিন আসামিদের থেকে টাকা নিয়ে আমাদের ফোন করে ৫০ হাজার টাকা দিতে চান এবং মামলা তুলে নিতে চাপ দেন। অন্যথায় আমাদের বিরুদ্ধে একাধিক মিথ্যা মামলা দেওয়ার ভয় দেখান।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ভুক্তভোগী জানান, থানায় দায়ের হওয়া সকল অভিযোগ ও মামলার কপি কামাল উদ্দিন সংগ্রহ করেন। পরে বাদী-বিবাদীদের ডেকে দুই পক্ষ থেকে খালি স্ট্যাম্প ও টাকা জমা নিয়ে সালিশ করেন। ছেলে মেজর ও ওসির আত্মীয় হওয়ার সুবাদে ভুক্তভোগী বিচারপ্রার্থীরা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হলেও কিছু বলার সাহস পান না। অন্যদিকে ‘ক্যাসকেড ব্লু’কে মেজর হাউজ ঘোষণা দিয়ে সেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যাবে না বলে মামলার দাগি আসামিদের নিরাপদ আশ্রয়ও দেন কামাল উদ্দিন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অভিযুক্ত কামাল উদ্দিন স্ট্যাম্প ও টাকা জমা নিয়ে সালিশ করার বিষয়টি জাগো নিউজের কাছে স্বীকার করেন। তবে তিনি দাবি করেন, বাদী-বিবাদীরা বিরোধ মীমাংসার স্বার্থে তার কাছে সালিশ নিয়ে যান। সুষ্ঠু সমাধানের জন্য স্বাক্ষর করা খালি স্ট্যাম্প ও বিরোধের ধরন অনুযায়ী টাকা জমা নেন তিনি। সালিশ শেষে আবার তা প্রাপ্ত ব্যক্তিকে ফিরিয়েও দেওয়া হয়।
থানায় মামলা হলে পুলিশ তদন্ত করবে, আপনি রাশেদা বেগমের মামলা তুলে নিতে চাপ দিচ্ছেন কেন? জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, 'বাদী-বিবাদী দুই পক্ষই আমার খুব কাছের। বাদীপক্ষ যেহেতু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাই দুই পক্ষকে ডেকে সমাধান করার চেষ্টা করেছি। তবে ওসি আমার আত্মীয় হলেও তার দোহাই দিয়ে কোনো কিছু আমি করি না এবং সালিশ করে কোনো টাকাও নিই না।'
থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এ কে এম আজমল হুদা জাগো নিউজকে বলেন, মো. কামাল উদ্দিন আমার দূরসম্পর্কের তালোই (বোনের শ্বশুর)। তবে আমি এসব জানার পর তাকে থানায় আসতে নিষেধ করেছি। তার কোনো তদবির যাতে কেউ না শোনে এ ব্যাপারে আমি সবাইকে সতর্ক করেছি। ভুক্তভোগীরা যাতে সরাসরি থানায় এসে আমার সঙ্গে কথা বলে এ বিষয়টি সবাইকে বলা হয়েছে।
নোয়াখালী জেলা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) মো. সাহাদত হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, এ ধরনের খালি স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর নেওয়া আইনত দণ্ডনীয়। তবে গ্রাম্য সালিশকে আদালত সাধুবাদ জানালেও খালি স্ট্যাম্প ব্যবহার করে কাউকে জিম্মি করে টাকা নিলে ভুক্তভোগী আদালতে মামলা দিতে পারেন।
এফএ/এমএস